শাহরিয়ার কবিরের
আত্মজীবনীমূলক সাক্ষাৎকারের
শেষ পর্ব ‘সাপ্তাহিক’-এর
এবারের ঈদুল আযহা সংখ্যায়
ছাপা হয়েছে।
সেটি পড়তে গিয়ে অবাক হলাম।
দেশের সবচেয়ে বড় মৌলবাদ,
সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মানুষটি বলছেন,
‘কেউ যদি আমাকে নাস্তিক
বলে আমি অবশ্যই তার
বিরুদ্ধে মামলা করব।’
লেখাটি পড়তে গিয়ে অবাক
হয়েছি। আর এর
সঙ্গে তুলনা করেছি আমাদের
বর্তমান নাস্তিকদের সঙ্গে।
এরা যে স্ট্যান্ডবাজি,
নিজেদের
কুতুবিয়ানা প্রচারটাকেই বড়
করে দেখেন,
তা একেবারে স্পষ্ট। বাস্তবে,
বাংলাদেশের
মতো একটি মুসলিম
রাষ্ট্রে যদি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হয়,
তাহলে হতে হবে ভীষণ
কৌশলী এবং দায়িত্বশীল।
শাহরিয়ার কবিরের
মধ্যে সেটা দেখা যাচ্ছে। আর
আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের
সঙ্গে মিলে হোক, আর
যেভাবে হোক, এই
কৌশলী মনোভাবের কারণেই
তিনি এই
সমাজে মোল্লাতন্ত্রের
বিকাশের
বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে পারছেন।
সাক্ষাৎকার পড়ে মনে হয়েছে,
আনিস রায়হান তাকে ধর্ম
সম্পর্কে কথা বলার জন্য জোর
করেছিলেন। আহমদ শরীফ, হুমায়ুন
আজাদের প্রসঙ্গ
টেনে শাহরিয়ার কবিরকে দুর্বল
চিত্ত বলে আঘাত করেছেন।
কিন্তু তার জবাবে তিনি ধর্ম
সম্পর্কে একটিও
বেশি কথা বলেননি।
উল্টো আনিস
রায়হানকে থামাতে কমিউনিস্ট
নেতা লেনিনের
উদ্ধৃতি টেনে এনেছেন। আমার
কাছে মনে হয়েছে, যদি কেউ
আসলেই এদেশের সাম্প্রদায়িক
পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন
আনতে চান, তাহলে শাহরিয়ার
কবিরের এই অবস্থানই সঠিক।
ধর্মটাকে এককভাবে মোল্লাদের
হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না,
ধর্ম
নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না।
কৌশলের সঙ্গে খুব
বুঝে শুনে এগুতে হবে। অভিজিৎ
রায়সহ অন্যান্য
সালাফি নাস্তিকরা যদি এই
সত্যটা অনুধাবন না করতে পারেন,
তাহলে তাদের
কল্যাণে আমাদের জন্য
আরো অনেক অকল্যাণ
অপেক্ষা করছে নিশ্চয়ই।
সাক্ষাৎকারের সংশ্লিষ্ট
অংশটুকু নিচে তুলে দিলাম।
আনিস রায়হান : মৌলবাদের
বিরুদ্ধে তো আপনি দীর্ঘদিন
সংগ্রাম করেছেন। ধর্ম
সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
শাহরিয়ার কবির : আমার
দেখা পৃথিবীর
সবচেয়ে সেক্যুলার দেশ
হচ্ছে তাতারস্তান।
তারা ইসলামের নতুন
ব্যাখ্যা হাজির করেছে।
শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি।
ওরা বলছে, তুমি নামাজ
রোজা না করে, দিনরাত মদ
খেয়ে, শুয়োর খেয়েও মুসলিম
থাকতে পার।
তারা যুক্তি দিচ্ছে যে,
ইসলামের আবির্ভাব মধ্যপ্রাচ্যে।
সেখানে সূর্যোদয়ের,
সূর্যাস্তের একটা সম্পর্ক
রয়েছে নামাজ রোজার
ক্ষেত্রে। এখন এরকম দেশের
কথা ভাব, যেখানে ছয় মাস দিন,
ছয় মাস রাত। ওখানে সূর্যের
সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নামাজও
পড়তে পারবে না, রোজাও
রাখতে পারবে না।
তুমি সাইবেরিয়ার কথা ভাব।
ওখানে তাপমাত্রা মাইনাস
পঞ্চাশেরও নিচে নেমে যায়।
সেখানে তুমি যতই গরম জামা পর,
টিকতে পারবে না। যতক্ষণ
না শরীরের ভেতর থেকে তাপ
উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তার জন্য তোমাকে প্রোটিন
খেতে হবে।
সবচেয়ে বেশি প্রোটিন
থাকে বিফ এবং পোর্কের মধ্যে।
এবং যেহেতু সাইবেরিয়ায় বিফ
সহজলভ্য নয়, পোর্ক সহজলভ্য।
তোমাকে তো বেঁচে থাকার
জন্য খেতে হবে সেটা।
না হলে মারা যাবে। একই
কারণে পোর্কের সঙ্গে তাদের
এলকোহলও খেতে হবে।
ভদকা খেতে হবে।
ভদকা শরীরকে ভেতর থেকে গরম
করে।
সুতরাং সাইবেরিয়াতে তুমি যদি গিয়ে বল
মদ খাওয়া যাবে না, পোর্ক
খাওয়া যাবে না। কেউ ইসলাম
গ্রহণ করবে না। তারা প্রশ্ন
করেছে, কোনটা জরুরি?
ইসলামের নিয়ম নাকি তার
মর্মকথা?
তারা নির্মূল কমিটির কাজ
সম্পর্কেও খোঁজ রাখে।
তারা আমাকে বলছে,
তোমরা ওয়াহাবিদের
রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করছ,
সাংস্কৃতিকভাবে করছ, কিন্তু
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের
বাধা দিচ্ছ না। বলো ইসলামের
কোথায় ওয়াহাবিজমের
জায়গা আছে! কেন কোরানের
ব্যাখ্যাটা তোমরা অশিক্ষিত-
অর্ধশিক্ষিত মোল্লাদের
হাতে ছেড়ে দিয়েছ? আমার
কাছে এটা খুবই যৌক্তিক
মনে হয়েছে। আসলেই তো তাই।
একজন
মোল্লা যেভাবে গ্রামে গিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত
করে,
আমরা তো সেখানে বাধা দিচ্ছি না।
আমার ওই ছবিটা দেখেন,
‘পোর্ট্রেট অব জিহাদ।’
যেখানে জামায়াতি এক
নেতা বলছে, ‘আমাদের
মহানবী বলেছেন, জেহাদ
শিক্ষার জন্য, অস্ত্র শিক্ষার জন্য
দরকার হলে চীন পর্যন্ত
যেতে হবে।’
আসলে কথাটা হচ্ছে,
জ্ঞানার্জনের জন্য চীন পর্যন্ত
যেতে হবে। সেটাকে অস্ত্র
শিক্ষা করে দিয়েছে।
এরা কিন্তু শুদ্ধ কোরান, হাদিস
পড়েনি। ধর্মের নাম বলে তাদের
যা বোঝানো হয়েছে, তাই
বুঝেছে। সাধারণ মানুষও তাই। ওই
দাঁড়িওয়ালা হুজুর যা বলছে,
সেটাই তাদের কাছে কোরান,
হাদিস।
আমরা পুরো জায়গাটা ছেড়ে দিয়েছি তাদের
হাতে। এই জায়গাটা আমি এখন
ধরছি।
হেফাজতের উত্থানের সময় বহু
টেলিভিশনে সরাসরি অনুষ্ঠানে আমি মোল্লাদের
হাদিস, কোরান
থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছি যে,
তারা যা বলে তা ইসলাম নয়।
কাদিয়ানি প্রসঙ্গেও আমি ধর্ম
থেকেই উদ্ধৃতি দিয়ে অনেক
লিখেছি। হিন্দুসহ ভিন্ন
ধর্মাবলম্বীদের বিষয়েও। মূলত
কিছু অশিক্ষিত মোল্লাদের
হাতে আমরা ধর্মকে ছেড়ে দিয়েই
ভুলটা করেছি। তাদের ভুলভাল
ব্যাখ্যাতেই আজ ধর্মের এই রূপ।
আনিস রায়হান : মৌলবাদ
সম্পর্কে, ধর্ম সম্পর্কে আমাদের
বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান দুর্বল।
আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ
ছাড়া তেমন
কোনো বুদ্ধিজীবীকে আমরা দেখি না,
তারা যা মনে করেন, তাদের
লেখায় তার প্রতিফলন খুব কমই
ঘটে।
শাহরিয়ার কবির : আন্দোলনের
ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিজীবন,
পারিবারিক জীবন, সামাজিক
জীবন, আবার আন্দোলনের জীবন,
এগুলোর মধ্যে ব্যবধান
থাকা দরকার। আমি অনেক বছর
সাংবাদিকতা করেছি।
সাংবাদিকদের মধ্যে অনেক
সময়ই ধর্ম বিষয়ে সীমা লঙ্ঘনের
প্রবণতা দেখি।
আমি মনে করি ধর্ম সম্পূর্ণ
ব্যক্তিগত বিষয়। আপনি বিশ্বাস
করলে আল্লাহ আছে।
আপনি বিশ্বাস না করলে আল্লাহ
নেই। সেটা তো আপনার কাছে।
কমিউনিস্টদের নিয়ে বলা হয়
তারা ধর্ম মানে না। কিন্তু
লেনিনের ডিক্রি অফ
রিলিজিয়নে আছে,
তিনি ধর্মের
বিপক্ষে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ
করে গেছেন। তিনি বলেছেন,
মানুষ যত এগুবে, সংস্কারগুলো তত
কেটে যাবে।
বিপ্লবের পর ২১-২২ সালের
দিকে প্রাচ্যের কমরেডদের
উদ্দেশে লেখা লেনিনের
একটা চিঠিতে আছে, আমাদের
কমরেডরা ট্রেড ইউনিয়নে কাজ
করতে গিয়ে প্রথমে এটা প্রমাণ
করতে চাচ্ছেন, ঈশ্বর বলে কিছু
নেই। ঈশ্বর আছে কি নেই, এ
নিয়ে তারা শ্রমিকদের
মধ্যে ঢুকছেন। এটা ঠিক নয়। ঈশ্বর
আছেন কি নেই, ঈশ্বরত্ব প্রমাণের
দায়িত্ব তো পাদ্রিদের।
এটা কমিউনিস্টদের কাজ নয়।
শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনের
সমস্যাবলি নিয়ে কথা বলবে কমিউনিস্টরা।
ধর্মের বিষয়গুলো পাদ্রীদের জন্য
রেখে দিন।
বাড়াবাড়ি করতে তিনি মানা করেছেন।
যেটা স্ট্যালিনের
আমলে মানা হয়নি।
ফলে এটা বুমেরাং হয়েছে তাদের
জন্য। আপনি দেখবেন, সোভিয়েত
ইউনিয়নে বেশি ঝামেলা ছিল
কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান,
তুর্কমেনিস্তান এসব জায়গায়।
ইসলামি জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ এসব
অঞ্চলে যে মাথাচাড়া দিয়েছিল
তার কারণটা ওই ধর্ম
নিয়ে বাড়াবাড়ি। ওই উগ্র
মৌলবাদটা ছিল ধর্মীয়
স্বাধীনতা নিয়ে সোভিয়েত
ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের
প্রতিবাদ। তাদের
প্রতিবাদটা কিন্তু সমাজতন্ত্রের
বিরুদ্ধে ছিলা না।
এছাড়া পশ্চিমা ইন্ধন তো ছিলই।
আমি ধর্ম
নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ
করি না। এটা আমার ব্যক্তিগত
বিশ্বাস। কেউ
যদি আমাকে নাস্তিক
বলে আমি অবশ্যই তার
বিরুদ্ধে মামলা করব।
আমি কখনোই নাস্তিক না।
আমিনী আমাকে স্বঘোষিত
নাস্তিক বলেছিল।
আমি তাকে বলেছিলাম,
আপনাকে প্রমাণ
করতে হবে কোথায়
আমি নিজেকে নাস্তিক
দাবি করেছি।
তিনি আদালতে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য
হয়েছিলেন।
ব্যক্তিগতজীবনে আমি কী সেটা আমি জনসম্মুখে আলোচনা করতে চাই
না। আমি মোল্লাদের সব সময়
একটা কথাই বলি, মাই
আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব ইসলাম ইজ
নট লেস দ্যান ইউরস।
ইউরোপ আমেরিকায়
যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ
দাবি করে তারা শুধু রাষ্ট্র
থেকে ধর্মকে নয়, নিজেদের
ব্যক্তি জীবন থেকেও
ধর্মকে নির্বাসিত করছে।
তারা কেউই চার্চে যায় না।
২০০৭ সালে সেন্ট
পিটার্সবুর্গে একটি সম্মেলন
হয়েছিল। ‘সেক্যুলার ইসলাম
সামিট।’ মুসলিম
দেশগুলো থেকে তারা ধর্মনিরপেক্ষ
বুদ্ধিজীবীদের আমন্ত্রণ
জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ
থেকে আমি ছিলাম। এশিয়া,
ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা সব
এলাকারই বিভিন্ন দেশের
প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিল।
সেখানে ঈশ্বরকে বাতিল
করে তারা একটা ঘোষণায়
যেতে চেয়েছিল। কিন্তু
আমি বলেছিলাম রাষ্ট্র
এবং রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন
করতে হবে, কিন্তু ধর্ম
থাকবে ব্যক্তি জীবনে।
প্রত্যেকটি দেশের
রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করতে হবে।
এমনকি এটা আমেরিকাতেও
নেই। ঈশ্বরকে বাতিল
করে ঘোষণা দিলে আমরা কাজ
করতে পারব না, বিপদে পড়ব। তখন
তারা আমাকে বললেন,
তোমাকে আমরা এখানে নির্মূল
কমিটির
নেতা হিসেবে ডাকিনি।
ডেকেছি একজন ধর্মনিরপেক্ষ
পণ্ডিত হিসেবে।
তারা আমাকে বলল,
তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বললাম, পৃথিবীতে প্রতি ছয়
জনের মধ্যে একজন নাস্তিক
বাকি পাঁচ জন আস্তিক।
এদেরকে ফেলে দেয়া যাবে না,
বাতিল করে দেয়া যাবে না।
আমাকে এদের সঙ্গেই কাজ
করতে হবে। সম্মেলনের
সংখ্যাগরিষ্ঠরা আমার মতের
পক্ষে চলে এলেন। অবশেষে সেই
ঘোষণার
নিচে আমরা যারা দ্বিমত
করেছিলাম বিরোধী পক্ষ
হিসেবে আমাদের নাম উল্লেখ
করা হয়েছিল। ইবনে বারাক
থেকে শুরু করে অনেক বিশিষ্ট
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী নেতা সেই
ঘোষণায় দ্বিমত পোষণ
করেছিলেন। এরপর ওই
ফোরামটা ভেঙ্গে যায়। আমার
কাছে এটাকে একটা বড়
সমস্যা মনে হয়েছে যে,
আমরা ব্যক্তিগত
ধারণাটাকে অন্যদের ওপর
চাপিয়ে দিতে চাই।