আগের পর্বঃ আমার ছোট্ট বাবুটা (২)
প্রচুর পরিমান মিষ্টি কিনে আবার ক্লিনিকে যাই, কেবিনে ঢুকতেই দেখি সবার মুখে চিন্তার রেখা। মা আমাকে বাইরে নিয়ে এসে বলেন বাবু কিচ্ছু খাচ্ছেনা আর ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, নাক আর ঠোট নীল হয়ে যাচ্ছে বার বার, সে জন্য অক্সিজেন দিয়ে রেখেছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরে। এখানকার চিকিৎসার অবস্থা তো আমি নিজেই দেখলাম, বাচ্চার ভাল কোন ট্রিটমেন্ট এখানে সম্ভব নয়। সাথে সাথে ডিসিশন নিয়ে ফেলি বাবুকে বগুড়াতে নিয়ে যাব (বগুড়া এখান থেকে ১ ঘন্টার পথ) এখানে আর এক মুহুর্ত নয়। চাইল্ড কেয়ার রুমে গিয়ে দেখি ওদের কোন ইনকিউবেটার পর্যন্ত নাই, বাবুর মুখে বড়দের অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে কোন ভাবে ওকে অক্সিজেন দেয়ার চেষ্টা চলছে। আমার সমস্ত পৃথিবী আঁধার হয়ে আসে যেন ...
দৌড়ে বের হয়ে আসি এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে, ক্লিনিকের গেটেই দেখা হয়ে যায় ডাক্তার রাব্বির সাথে, উনি নাম করা শিশু বিশেষজ্ঞ, আমেরিকাতে থাকেন, দেশে এসেছিলেন কয়েক মাসের জন্য, কোন এক সুত্রে তার সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার। ক্লিনিকে এসেছেন তার পরিচিত একজনকে দেখতে। উনাকে খুলে বলি ঘটনা, উনি সাথে সাথেই আমার সাথে দোতলায় গিয়ে বাবুকে দেখেন, তারপর ফোন করে উনার বাসা থেকে কি কি যেন আনতে বলেন। পরে আমাকে বুঝিয়ে বলেন কি হয়েছে - বাবু প্রচুর নড়াচড়া করতো পেটের মধ্যে। সে কারনে তার গলায় পেঁচিয়ে যায় umbilical cord, জন্মের পরে সে জন্য কিছু বিশেষ ব্যাবস্থা নিতে হয়, যা সব ডাক্তারদেরই জানার কথা। বাবুর ক্ষেত্রে সেই রকম কিছুই করা হয়নি আর বাচ্চার নাক মুখ থেকে amniotic fluid সাবধানে শুষে নিতে হয়, সেইটা করা হলেও তা সঠিক ভাবে হয়নি। এর মধ্যেই ডাক্তার সাহেবের মেডিকেল কিট এসে পড়ে। উনি খুব দ্রুত বাবুকে একটা ইঞ্জেকশান দেন ও ওটিতে নিয়ে কি কি যেন করেন। ১০ মিনিট পর বাবুকে কোলে করে এনে আমার হাতে দিয়ে বলেন আপনার বাবু মাশআল্লাহ বেশ শক্ত। এ অবস্থায় ২ ঘন্টা অনেক বাচ্চাই সার্ভাইভ করতে পারেনা। আমি ডাক্তার সাহেবকে ধন্যবাদ দেয়ার ভাষা খুজে পাইনা। তারপর ডাক্তার সাহেব ক্লিনিক অফিসে ঘুরে এসে আরেক বিচিত্র তথ্য দেন, ওদের ক্লিনিকে খুব ভাল একটা ইনকিউবেটার আর চাইন্ড সেইফটি কিট আছে, কিন্তু অনেক দামী (সাহায্য সংস্থার অনুদানে পাওয়া) বলে ওরা সেটা মোড়ক খুলে বের করেনি
এর পর বাবু ৪/৫ চামচ দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পরে, ওর মা'র তখনও জ্ঞ্যান স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনি, কিন্তু ডাক্তার সাহেব সব দেখে বললেন যে চিন্তার তেমন কিছু নেই। এ অবস্থায় আমি বাসায় চলে আসি, গোসল করে নামাজ আদায় করে সারা রাতের ধকল শেষে ঘুমিয়ে পরি। ঘন্টা তিন পরে উঠে ক্লিনিকে আবার যাই ... আমি কেবিনে ঢুকতেই বাবু চোখ মেলে তাকায় আর ঠোট চাটতে শুরু করে, মা বলে - তার খিদে পেয়ে গেছে, কিন্তু সে কান্না করেনা, শুধু এদিক সেদিক অবাক হয়ে দেখে। আমি ওকে কোলে নিয়ে বলি - "এই যে বাবু, আমি তোমার পাপা"। সে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখে, শব্দের উৎস বুঝে সেই দিকে তাকানোর কায়দাটা রপ্ত করে নিতে চেষ্টা করে মনে হয়। তখন ওর নাম দেয়ার কথা মনে আসে, আমার বাবা বসে ছিলেন পাশেই, উনার কোলে দেই বাবুকে, দিয়ে বলি একটা নাম দিতে, আব্বু তখনই বলেন ওর নাম হবে "আদিত্য", যেটা উনি পথে আসার সময় ঠিক করেছেন।

এরপর দুটো দিন পার হয়ে যায় সীমাহীন ব্যস্ততায়। কখনও ক্লিনিক, কখনও বাসা, এর মাঝে ঢাকা থেকে বাবুর জন্য কিছু দরকারী জিনিস কিনেও এনেছিলাম। বাবু হবার চতুর্থ দিনে আমরা ওকে নিয়ে আসি বাসায়, মানে ওর নানা বাড়ীতে। বাসায় ঢুকে মনে হয় আমি আমার ইচ্ছে মত বাবুকে নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ পাই। তখন থেকেই সে হাসতে শেখে, ঘুমের মধ্যেও। আমি সেই হাসি দেখার জন্য রাত দিন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বাবুটা খুব শান্ত ছিল ছোটবেলায়। কান্না করতোনা সহজে, শুধু গভীর রাতে ভয় পেয়ে কেঁদে উঠতো মাঝে মাঝে। ওর মা অপারেশনের কারনে উঠে দাঁড়াতে পারতোনা, কাজেই আমাকেই শিখে নিতে হয় কিভাবে ওকে কোলে নিয়ে হাটাহাটি করতে হবে, ঘুম পাড়াতে হবে, ভেজা কাঁথা বদলাতে হবে।
মোট নয়দিন ছিলাম আমি ওদের বাসায়, পরে ঢাকায় চলে আসি ছুটি শেষ হয়ে গেছিলো বলে। বাসায় ঢূকে খুব একা একা লাগে, বাবুটার জন্য মন খারাপ লাগে খুব, অফিসেও মন খারাপ করে বসে থাকি, কাজে ভুল হয়। বস্ বলেন ওকে বাসায় নিয়ে আসতে, আমি চান্স পেয়ে আরও তিনদিনের ছুটি নিয়ে চলে যাই বাবুর কাছে
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০০৯ বিকাল ৩:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



