অনেক বছর আগে থেকে ফেসবুক ব্যবহার শুরু করলেও এখনো ফেসবুকের অনেক কিছুই আমার মনে থাকেনা। এর মধ্যে "নোট" লেখাটা অন্যতম। কিছু লেখার জন্য "Note" খুঁজতে আমার মিনিট কয়েক চলে যায়! এর একটা কারন হতে পারে সেটা নোট নিয়মিত না লেখা। একসময় তুখোড় ব্লগার ছিলাম। সেটা এক সময়ের কথা। এখন ব্লগ থেকে বহু দূরে আমি। নিজের সাইটেও নিজের জন্য একটা ছোটখাটো ব্লগ তৈরি করেছি সেই ২০০৮ সালেই। কিন্তু খুব কম ব্লগ পোষ্ট করেছি সেখানে। মূল কথা হচ্ছে আমি মন খারাপ না থাকলে কোন কিছু লিখি না :p
আনন্দ ভাগাভাগি করা যায়। মন খারাপটা ভাগাভাগি করা যায় না আর এজন্যই বেনামে এবং মানুষজন জানেনা এমন ঠিকানায় ব্লগ লিখতাম!
আম্মুর চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি প্রতি নিয়ত নির্ঘুম দিন রাত কাটিয়েছি। ব্যস্তময় সেই সব দিনরাত। খুব সকালে উঠে হাসপাতালে গিয়েছি। ওখান থেকে অফিসে। অফিস থেকে আবার হাসপাতালে, তারপর সারা রাত হাসপাতাল, সকালে বাসা, বাসা থেকে আবার হাসপাতাল, আবার অফিস... এভাবেই চলেছে জীবন। অবাক করার মতো ব্যাপার, আমি ঐ সময়গুলোতে কখনোই ক্লান্ত হইনি। বরঞ্চ অনেক সতেজ থাকতাম। এই সময়ের বাইরেও বাড়তি কিছু কাজ করতাম। নিয়মিত থার্ডআই ফটোগ্রাফিক সোসাইটির মিটিং এ উপস্থিত থাকতাম। ওখানে আমার দায়িত্ব কম ছিলো না। সবই করেছি... করার একটা প্রচন্ড ইচ্ছা ছিলো। এজন্য করেছি। আরও একটা ব্যাপার ছিলো, নিজের কাছ থেকে নিজেকে লুকানোর জন্য একটা তাড়না ছিলো। কারণ, যখনই আমি একা হয়ে গেছি তখনই আমি কখনো বাসের খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে কান্না করেছি, কখনো হাসপাতালের সিঁড়িতে, কখনো রাস্তায়, কখনো বাথরুমে, কখনো রান্না ঘরে... যখনই একা হয়েছি। কান্না থামিয়ে রাখতে পারিনি।
কিন্তু, দিনের আলোয় সবার মাঝে অন্যরকম আমি। দু:খবোধ শেয়ার করতে আমার ভিষন অস্বস্তি। আম্মা যেদিন চলে গেলেন, সবাই আমার চারপাশে চিৎকার করে বিলাপ করেছে। একমাত্র আমি কাঁদতে পারিনি। ততদিনে কান্না আটকে রাখার মতো বুকটা আমার তৈরি হয়ে গেছে। এটাকেই পাথর বুক বলে!
আম্মুর চলে যাবার পর এখন আর আগের মতো ইমোশনাল হইনা। আগের মতো বাচ্চা ছেলের মতো হুটহাট কোন কিছু করতেও পারিনা। নিজের জন্য কিছু ভাবতে পারিনা। হুট করে কোথাও চলে যেতেও পারিনা। সত্যি কথা হলো এসব অপারগতায় আমার দু:খবোধ নাই। জীবনটা ক'দিনের। সবাইকে নিয়ে জীবনকে "আয়োজন" করে "উপভোগ" করাটাইতো জীবন। পাহাড়সম দায়িত্ববোধ এসে পড়েছিলো বছর তিনেক আগেই। তার আগ পর্যন্ত মায়ের আঁচলে ঘাম মুছার সেই অভ্যেসটা দূর হয়নি... সেই অভ্যেসটা মা নিয়ে গেছেন চিরতরে। অভ্যেসের সাথে সাথে সেই দারুন ছোট মনটা... আমি এখন আর চাইলেই কাউকে না বলে অ-নে-ক দূর চলে যেতে পারিনা। মায়ের রেখে যাওয়া সংসার আমাকে দায়িত্বশীল মানুষ বানিয়ে দিয়েছে।
তারপরও ঘুরাঘুরির অভ্যেসটা যায় নাই। এখন সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়াই। আম্মু আমার পায়ের তিল দেখিয়ে অনেক বার বলেছিলেন, আমার ছেলেটা সারা জীবন ঘুরে বেড়াবে। তখনই প্রথম জেনেছিলাম পায়ে তিল থাকলে মানুষ ঘুরে বেড়ায়, আর এখন জানি পায়ে তিল থাকলে মানুষ বিদেশ চলে যায়! যদিও বিদেশ যাবার কোন ইচ্ছা আমার নাই। আমার "বাবা"টা এখন আমার "মা বাবা"। আব্বুকে ছেড়ে দূরে কোথাও বাস করাটা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
ছোট বেলা থেকেই একা একা বড় হয়েছি। একা একাই সব করেছি। কিন্তু মা বাবাকে কখনোই ভুলে থাকতে পারিনি। যেদিন প্রথম ঢাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম সেদিন সমস্ত কিছু নতুন কিনেছি। হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে সব কিছু। এখানেও একা একা আমি। অবশ্য ব্যাচেলরকে ভাড়া দেয়া হবে না টাইপ বাড়িওয়ালাকে আমার ফ্ল্যাট ভাড়া পাইয়ে দেবার জন্য আম্মু চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে কয়দিন ছিলেন। আম্মু ঢাকায় "দম বন্ধ" হয়ে আসে কারনের জন্য আমার সাথে থাকতেন না, গ্রামেই থাকতেন। কিন্তু প্রতি মুর্হূতেই খবর নিতেন। যেদিন থেকে রান্না করতে শুরু করলাম, আমার এক হাত ব্যস্ত কানে মোবাইল ধরতে, অন্য হাত ব্যস্ত মায়ের রেসিপি মতো রান্না করতে... কতো হাসিঠাট্টা করে মা ছেলে মোবাইলে রান্না করেছি! কেবল রান্নাই নয়, আম্মু আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। আমার সব কিছু আম্মু থেকে শেখা। সবকিছু। তাই, যা কিছুই করিনা কেন সবই আম্মুর জন্য।
মাঝে মাঝে অনেক অবসাদে দিন কাটে। ভাবি, মা নেই, আমার থেকে কি হবে। কোথাও থেকে ঝাপ দিয়ে পড়ে যাই, পানিতে! ১০ তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফিয়ে! ট্রাকের নিচে! ঘুমের ঔষুধ খেয়ে! কিন্তু যখনই ভাবি আম্মুর রেখে যাওয়া সংসারের কথা... নিমিষেই সব চলে যায়। অবসাদের বদলে সেখানে চিন্তা চলে আসে। চিন্তা থেকে কাজের মনোযোগ দেবার তাড়া!
আমি বহুদিন আগে, একটা কার্টুন দেখেছিলাম। একটা মুরোগ তার মা হারা বাচ্চাকে নিয়ে ভিষন অতিষ্ট। প্রতিদিনই কমপ্লেইন আসতো। বাচ্চাটা এটা নষ্ট করেছে, ওকে মেরেছে... নানান কমপ্লেইন। কিন্তু তিনি তার বাচ্চাকে তেমন বকাঝকা দিতেন না। তবে, প্রতিদিনই তার বাচ্চাটাকে একটা কথাই বলতেন- "Everyday is a new day"। তিনি হয়তো জানতেন তার ছেলে একদিন দায়িত্ব নিতে শিখবে। মজার ব্যাপার হলো, এলাকার সেই ছোট, শয়তান, দুষ্টু বাচ্চাটা একদিন কেমন করে যেন পুরো পৃথিবী বাঁচিয়ে দিলো!
যখনই আমি খুব মন খারাপের মধ্যে থাকি, অবসাদগ্রস্থ হয়ে যাই তখনই ঐ বাচ্চার কথা চিন্তা করি, আর মনে মনে বলি, Everyday is a New Day! আমার মন খারাপ থাকেনা। আমি যদি প্রত্যেকটা দিন নতুন করে শুরু করি এবং সেটাকে অনেক সুন্দর করে তুলতে পারি তাহলে জীবনটা অর্থহীন হবে না কখনোই। দিনশেষে কে সুখী আর কে অসুখী সেই ব্যাপারটা "সাফল্যের" উপর নির্ভর করে। আমার ব্যর্থ দিন আমাকে কান্নায় ভাসাবে সেটাই স্বাভাবিক। জীবনকে সহজ করে বুঝতে হবে, কঠিন করলেই জীবনটা কঠিন হয়ে যাবে।
প্রতিদিনই আমার ব্যস্ত দিন। তারপরও আমি প্রতিদিন নিয়ম করে রাতের খাবারের সময় টিভিটে কার্টুন দেখে আহার করি। বোন সিরিয়াল দেখতে অভ্যস্ত, ভাতিজা সিনেমা, বাবা তাজা সংবাদে। কিন্তু আমার ঐ ছোট্ট সময়ে কেউ চ্যানেল পরিবর্তন করেনা। ঘরের সবাই আমার এই কার্টুন দেখাটায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
জীবনে পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেব করিনা। জানি যা পেতে ইচ্ছা হয় সেটা একদিন পাব। আগামীকাল পেতে হবে এমন তাড়া নেই। যেহেতু টাকা পয়সার দিক থেকে দুর্বল, তাই নিজের শখগুলো শিঘ্রির পূরণ করার জন্য যুদ্ধ করিনা, সংসারের বাকি সদস্যদের ইচ্ছা অনিশ্চা, শখ নিয়ে কাজ করি। শান্তি পাই যখন ওদের জন্য কিছু করতে পারি। শখ পূরনের পর ওদের মুখের হাসি, চোখে ভাসা ভাসা জল... আমার সারা জীবনের প্রেরণা।
এত কিছুর পরও, জীবনটা কখনো কখনো অর্থহীন হয়ে যায় যখন অনুভব করি সবই ঠিকঠাক চলছে কিন্তু মা নেই। কিন্তু এটাকে এখন আমি আমার পাওয়া হিসেবে মেনে নিয়েছি। আম্মু আমার ভেতরে জেগে আছেন এই অনুভূতিটা নিয়ে সারা জীবন কাটাতে চাই। অনেক টাকা কড়ি, গাড়ি বাড়ি, এটা সেটা... এসবের প্রতি আমার মোহ নাই। পরিবারের সদস্যদের স্বপ্নপূরণই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছি। জানিনা কতোদিন সবার মাথার উপর ছাদ হয়ে থাকতে পারবো, তবে যতোদিন আছি... ততদিন যেন সবার মুখের সেই হাসি... চোখে ভাসা ভাসা জল দেখে যেতে পারি সেই চেষ্টাই করে যাব...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



