রাত ৮টা থেকাই র্যাব পুলিশরা টিএসসি থেকা সবার আইডি কার্ড চেক করতে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন না এমন লোকজনরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন তারা আদেশভঙ্গিমায়।
দশটার মধ্যে টিএসসি প্রায় বহিরাগতশূন্য। জাদুঘরের গেটের সামনের রাস্তায় থাকে পুলিশের কাটাতার দিয়া ঘেরা লোহার ব্যারিকেড। তার পিছনে অবস্থান নেয় জঙ্গি পুলিশ। বহিরাগত যারা যারা বিক্ষিপ্তভাবে ছবির হাট, কলাভবন, পাবলিক লাইব্রেরীতে বইসা ছিলো তারা ওইখান দিয়া বাইর হইতে থাকে দলে দলে; তাদের প্রায় সবাই বয়সে তরুন। সেই তরুনরা তখন শাহবাগের মোড়ে বইসা চা বিড়ি ছোলা বাদাম খাইতে থাকে। কিছু কিছু তরুনীও দেখা যায় ওইখানে।
শাহবাগে তিনজন হিজড়া আছে, সুন্দরী। চলতি হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের দেইখা দেইখা ড্রেস ডিজাইন করেন তারা। দশটার পর পর ভারী মেকাপ নিয়া সেই সল্পবসনা হিজড়াগন ব্যারিকেডের সামনে গিয়া পুলিশরে অনুরোধ করতে থাকে ভিতরে ঢুকনের জন্য। বেশী কিছু চায় না তারা, টিএসসি থেকা একটা ঘুরান মাইরাই চইলা আসবে। সেই অনুমতি পাওয়া যায়। একদল যুবকও জোটে যারা নাকি তাদের পিছন পিছন হাটবে। আমার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বন্ধু লিটন গতবৎসর সেই যুবকদের দলে ছিলো।
এগারোটার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ফাঁকা। বহিরাগত তরুনরা ব্যারিকেডের উল্টাপাশে বন্ধ ফুলের দোকানগুলার সামনে জটলা করে। আর কবি সাহিত্যিকরা জাদুঘরের উল্টাপাশের ফুটপাতে বইসা চা খায়, লগে বেনসন। ফোন দিয়া গুলশান বনানীর বন্ধু-বান্ধবগো খোঁজ খবর করে।
বারোটা বাজতেই শুরু হয় শাহবাগের থার্টি ফাস্ট। হলে ভিতর কোথাও হয়তো বাজি ফুটলো, সেইটা বাজীর শব্দে উন্মাদ হয়া গেলো ব্যারিকেডের বাইরে থাকা তরুনরা। শাওবাগের সিগন্যালে যত প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস পাজেরো পাওয়া গেলো, সেইগুলার উপরে খামাখাই খালি হাতেই ঘুষি লাত্থি চলতে থাকলো। অবস্থা বেগতিক দেইখা জঙ্গি পুলিশ আগায়া আসে, বেধরক লাঠিচার্জ চলে কিছুক্ষন। যুবকরা ভাইগা পিজির ভিতরে গিয়া ঢুকে।
যুবকদের ছত্রভঙ্গ কইরা দিয়া পুলিশরা আবার ব্যারিকেডের পিছনে গিয়া বইসা থাকে থানার সামনে। যুবকরা আবার জড়ো হয় সিগন্যালে, কাটাবন থেকা আসতে থাকা কোনো গাড়ির আর রক্ষা নাই। পুলিশরে আসতে দেখলেই সবগুলা দৌড়াইয়া পলায়া যায়। পুলিশ চইলা গেলে তারা আবার আসে, একসময় বিরক্ত হইয়া আর আসেই না। ভোর পর্যন্ত, ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত সেই যুবকেরা তাদের কর্মকান্ড চালাইতে থাকে।
তো, সেই যুবকেরা কারা? আমি আর সিনিয়র কবিবন্ধু ডেভিড কিছুক্ষন তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর কইরা টের পাইলাম যে, সঙ্ঘবদ্ধ এই যুবকেরা নিজেরাও নিজেদের ভালোমতো চিনে না। হয়তো মিরপুর থেকা দুই বন্ধু আসছে, তিনজন আসছে নাখালপাড়া থেকা। একজনের বাসা কাফরুল। এইরকম আরো অনেকে জটলা কইরা গাড়ির উপর আক্রমন করতেছে।
কেন তারা এইরকম করে? গত পাঁচ বৎসর আমি থার্টি ফার্স্ট নাইটে একবার হইলেও শাহবাগ গেছি। দুইবাড় সাররাত ছিলাম। প্রতিবারই দেখি অবস্থা এইরকম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আইন শৃঙ্খলা বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলনামূলক কঠোর ছিলো। তখনো কিন্তু শাহবাগের এই অবস্থা দেখছি আমি থার্টি ফার্স্টে।
সারারাত পিজির সামনে পূবালী ব্যাঙ্কের নীচে বইসা চা খাইতে খাইতে এই ঘটনার পক্ষে বিপক্ষে দার্শনিক অবস্থান নিয়া তর্ক বিতর্ক চালাইতে থাকেন শাহবাগের কবিরা। একফাঁকে হিজড়ারা আসে চা খাইতে। ঠাট্টা মস্করা করতে তারা চায়ের দোকানদার, বাদামোওয়ালাগো লগে। বহিরাগত যুবকদের কাউরে কাউরে আসতে দেখা যায় সেইখানে, হিজড়াদেরকে চা খাওয়ানোর প্রস্তাব রাখে তারা। আলাপ পরিচয় করে, ফোন নাম্বার দেয়। দূরে বইসা তাদেরকে আড়চোখে লক্ষ করে শাহবাগের কবিরা। মনে মনে দার্শনিক ব্যাখা খুঁজতে থাকে নাকি তারা?
ওরা, মানে ওই শাহবাগের রাতজাগা কবিরা, ওই যুবকদের কাউরেই চিনতে পারে না।