somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ট্রাভেলগঃ চন্দ্রনাথ টু সীতাকুন্ড ইকো পার্ক।

১৮ ই জুন, ২০০৯ রাত ১২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার সিটি গেট।


প্রাচ্যের রানী চট্টগ্রামে বৃহঃস্পতিবার গিয়েছিলাম প্রথম আলো ব্লগের ব্লগার্স মিট আপে। চাঁটগাঁবাসীদের আন্তরিক আতিথিয়েতা আর মেজবানীর লোভ উপেক্ষা করা সম্ভব না। আরেকটা ইচ্ছে ছিল চন্দ্রনাথ থেকে সীতাকুন্ড ইকোপার্কে ঢোকা। জিপিএস আলম ভাই (কয়েকজন আলম ভাই আছেন। ইনি জিপিএস নিয়ে সারাদিন মাতামাতি করেন) এই ট্রেকটার অনেক প্রশংসা করেন।
নেই। ব্লগার মিট-আপে কয়েকজন ব্লগারকে বলেছিলাম ট্রেকটার কথা কয়েকজন রাজী হলেন। আরেকজন ব্লগার খুব উতসাহী ছিলেন। কিন্তু তার ওপেন হার্ট সার্জারী হবার কথা শুনে তাকে তার ভালোর জন্যেই মানা করে দিতে হলো। নিজেরই মন খারাপ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন তৈয়ব ভাই, চন্দন ভাই, ওস্তাদের ওস্তাদ নাবিল ভাই আর আমাদের কারিম ভাই। রাতের বেলা চন্দন ভাই জানালেন তার ভার্সিটি একটা সমস্যা হওয়ায় তাকে জরুরীভিত্তিতে সেখানে যেতে হবে। একটা জরুরী কাজে শেষ মুহুর্তে চন্দন ভাইও বাদ গেলেন। শেষমেশ কারিম ভাই, ওস্তাদ আর আমি চললাম একটা সিএনজিতে করে।
সকালে আমার ছোট্ট ব্যাগটা কাঁধে নিতে গিয়ে আতকে উঠলাম। ৩ লিটারের ২টা জার টাইট হয়ে আছে। কত ধানে কত খই। ওস্তাদের ব্যাগের অবস্থাও একই, একটা বোতল আর বিস্কুটের বিশাল এক জার। সেদিক দিয়ে কারিম ভাই ঝারা হাত পা। আল-মদিনা রেস্টুরেন্টে আগুন গরম পরোটা আর ডাল ভাজি খেয়ে আমরা সিএনজির খোঁজে বেরুলাম। ডায়রেক্ট কিছু না পেয়ে প্রথমে গেলাম সিটি গেট পর্যন্ত। এর পরে ভাটিয়ারীর সামনে দিয়ে সীতাকুন্ড। এই এলাকাটায় আসলেই মন উড়ু উড়ু করে। ডানদিকে সাগর আর বাঁ-দিকে সীতাকুন্ড রেঞ্জের পাহাড়্গুলো। এরমাঝে তেমন বৈশিষ্ট্যহীন একটা পাহাড় ‘চির উন্নত মমশির’। এই পাহাড়টার কোলে জীবনের সেরা সময়ের একাংশ কাটিয়ে এসেছিলাম।

শ্মশান সংলগ্ন পুকুর ঘাট থেকে সামনে বাইনারী পিক দুটো। সবচেয়ে উচুটা চন্দ্রনাথ। চুড়ায় বিন্দুটাই চন্দ্রনাথ মন্দির।


শঙ্কর মঠ থেকে চন্দ্রনাথের বাইনারী পিক।


সিএনজিওয়ালা একটু আগেই নামিয়ে দিয়েছে। একটা শ্মশান ঘাটের পাশে। অনেকবছর আগে স্কুল বয় থাকতে একবার চন্দ্রনাথে এসেছিলাম। স্মৃতি হাতরে হাতরে কিছুই বের করতে পারলাম না। শ্মসান ঘাটের পুকুরে ওস্তাদ তার গামছা ভিজিয়ে নিল। শ্মসানের পিছনে সগর্বে মাথা তুলে দাড়িয়েছে দুটো যমজ চুড়া। বাইনারী পিকদুটোর একটা আরেকটার চেয়ে উচু। দুটোর চুড়াতেই দুটো মন্দির আছে। সবচেয়ে উচু চুড়াটাই চন্দ্রনাথ। ওখানে চন্দ্রনাথ ধাম মন্দির। আর তুলনামুলক ছোটটায় সীতাধাম মন্দির।
কলেজ রোড ধরে একটু এগিয়ে আমরা শঙ্কর মঠের সামনে আসলাম। সিড়ি বেয়ে উঠা। টুরিস্ট আকর্ষনের জন্যে অনেক জায়গাতেই সীতাকুন্ডের উচ্চতা বাড়িয়ে বলা আছে। আসলে সবচেয়ে উচু পিক চন্দ্রনাথের উচ্চতা ১১০০ফিট এবোভ সী লেভেল। এই সিড়িই একে বেকে পাহাড়ের বুক পেচিয়ে উঠে গেছে এগারোশত ফুট উপরে। শঙ্করমঠে উঠে আমরা পানি খাবার জন্যে বসলাম।

নিচের চুড়ায় মন্দিরটা সীতামন্দির। চন্দ্রনাথ থেকে।

সেখানে কয়েকজন বৃদ্ধা এবং এক বৃদ্ধ ছিলেন। কথার টোনেই বুঝলাম ভারত থেকে এসেছেন। সীতাকুন্ড পাহাড় নির্জন। কুখ্যাতিও কম না। প্রায়ই নাকি নির্জন পাহাড়ি পথে ডাকাতি হয়। মন্দিরের পুরুতও একই কথা বলছিলেন। উনাদের একলা যেতে মানা করেন। আমরা আসতেই বললেন এদের সাথে দল বেধে যান।
হিন্দুরা বিশ্বাস করে রাবণের হাত থেকে উদ্ধারের পরে যখন সীতা আত্মাহুতি দেন তার শরীরের ছয় অংশের এক অংশ পরে এই পাহাড়ে। আবার অনেকে বলেন এখানের একটা কুন্ডে সীতা পানি পান করায় এর নাম সীতাকুন্ড। অবশ্য রামলক্ষন কুন্ডও আছে। এছাড়াও আছে শিব-মন্দির, ভবানী মন্দির, হনুমানজ্বীর মন্দির, শম্ভুনাথ মন্দির, সোনার বিল্বপত্র আরো অনেক কিছু।

বাইনারী পিকের অন্যটা।

আদিনাথ মন্দিরের একজন পুরোহিত বলেছিলেন (সত্য মিথ্যা যাচাই করতে পারিনি) নেপালের একজন রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে বিশ্বের পাচ কোনে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মান করেন। এগুলো হলো নেপালের পশুপতিনাথ, কাশিতে বিশ্বনাথ, পাকিস্তানে ভুতনাথ, মহেশখালীর আদিনাথ আর সীতাকুন্ডে চন্দ্রনাথ। প্রতিবছরই হাজার হাজার পূণ্যার্থী আসেন সারা উপমহাদেশ থেকে। আমাদের সঙ্গি বৃদ্ধাদের দলের একজন জানালেন উনারা এসেছেন ভারতের মধ্যপ্রদেশ থেকে। যদিও অরিজিনেট ফ্রম কলকাতা। তাদের সাথে কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে আমরা উঠতে লাগলাম।
উনাদের ধর্মপ্রীতি কষ্টকে উপেক্ষা করলো। এগারোশ ফিট উপরে যখন আর অল্প দুরত্ব বাকী তখন দেখি তাদের উঠার বেগ আরো বেরে যাচ্ছে। আমরা শেষ সিড়িটায় পা দিয়ে যখন হাপাচ্ছি ততক্ষনে উনারা উঠে মোমবাতি আর আগরবাতী জ্বালিয়ে হরে রাম হরে কৃষ্ণ শুরু করেদিয়েছেন।
উপর থেকে পাওয়া ভিউটা অসাধারন। সামনে বঙ্গোপসাগর। ওপাশে সন্দীপের কালো কালো ছায়া। আর ডানদিকে যতোদুর চোখ যায় সমতল ভুমী। কোন উঠা নামা নাই। একসময় দৃষ্টি থমকে যায় অসীমে। মনে হয় পুরো বাংলাদেশটাই যেন এক পলকে দেখে ফেলছি।

ওস্তাদের ওস্তাদ বিস্কুট ছাড়াও নুডলস আর ডিমভাজা রুটি খাবারের পাহাড় নিয়ে এসেছে। সদ্ব্যাবহার করতে দেরী হলো না। খেয়ে দেয়ে জিরোতে জিরোতে আরেকটা গ্রুপ এসে হাজির। তারা স্থানীয় পূণ্যার্থী। তাদের কাছে শুনলাম গতকালকেও নাকি ডাকাতী হয়েছে ইকোপার্কে যাবার রাস্তায়। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নির্জন এক পথে ইকো-পার্কে যাবার একটা রাস্তা আছে।
আশির দশকে তেল গ্যাস খুজতে একটা মাইনিং কোম্পানী রাস্তা বানায়। কিন্তু তেমন কিছু না পাওয়া যাওয়ায় পুরোটাই পরিত্যাক্ত হয়। এখন এই রাস্তায় নাকি রুটিন করে ডাকাতী হয়, ওরা বললো যদি দল করে যেতে পারেন তাহলে ভাল। যাব কি যাব না করতে করতে সিড়ি বেয়ে নেমে পাহাড়ি রাস্তাটার সামনে দাড়ালাম। আরেকটা টিম পেলাম ৩জনের। এরা স্থানীয়। ঢাকায় থাকেন। তাদের সাথেই ভিড়ে গেলাম। ৬জনের দল যথেষ্ঠ নিরাপদ।
ঝকঝকে পাহাড়ি রাস্তায় আমরা মন খুলে হাটছি। পথে একদল আদিবাসীর দল বসে গাছ লাগাচ্ছিলো। সরকারী বৃক্ষরোপণ কর্মসুচীর আওতায় গাছ লাগানো হচ্ছে। ওদের সাথে কথা বলে জানলাম তারা ত্রিপুরা। বেশী কথা বলার সুযোগ পেলাম না। সবাই এগিয়ে গেছে। তারা তারি পা চালিয়ে গিয়ে তাদের ধরলাম।
এয়ারফোর্সের রেডিও স্টেশনটার পাশ ঘেসে আমরা সীতাকুন্ড ইকোপার্কে ঢুকলাম। হরেক রকমের বিচিত্র গাছের সম্ভারে কৃত্রিম অরন্য। এখানে দুটো ঝর্না আছে। সহস্রধারা আর সুপ্ত ধারা। সহস্রধারা সবার পরে কিন্তু আমরা এসেছি উলটা দিক থেকে তাই আমাদের জন্যে সবার আগে। সামনে একটা সাইনবোর্ডে লিখা নিচে সহস্রধারা ঝর্না ১২০০ফিট নিচে। সাইনবোর্ডটা পুরাই আগডুম বাগডুম। কারন চন্দ্রনাথই ১১০০ ফিট। সেখান থেকে অনেক নেমেছি আমরা । এই নোটিশটার ভয়ে দেখলাম অনেক টুরিস্টই নামতে চাইছে না। নামা শুরু করতেই বুঝলাম ওটা নিতান্তই চাপাবাজি। শ-খানেক ফুট নামতেই জঙ্গুলে পথে মাথায় কুন্ডের গায়ে সগর্জনে সহস্রধারা ঝর্ণা পেলাম। প্রায় দুশো ফুট (চোখের আন্দাজ) উপর থেকে পানি পড়ছে। অসাধারন একটা ঝর্না।
জঙ্গুলে রাস্তা আস্তে আস্তে নিচু হয়ে সমতলে চলে এসেছে। পথে হাস্যকর আরেকটা সাইনবোর্ড পেলাম। আপনি এখন সাগরপৃষ্ঠ থেকে ১২০০ফিট উপরে
আছেন।

সহস্রধারার জলছটা।


সহস্রধারা ঝর্না। সীতাকুন্ড ইকোপার্ক।


সহস্রধারা ঝর্ণা। সীতাকুন্ড ইকো-পার্ক।


ঝর্ণা ঝর্ণা
সুন্দরী ঝর্ণা
তরলিত চন্দ্রিকা
চন্দন বর্ণা।



ঝর্নার সামনে দাঁড়ায় স্টাইল মারতেছি। :P


কারিম ভাই অফিস ফাঁকি দিয়ে আসছেন। অফিসের ফোন। জ্বী বস। আমি তো এখন কল্যানপুরে। :D


শ্যাওলা ধরা রহস্যময়ী অরণ্যের পাথুরে বিছানা ভেদ করে নামছে জলস্রোত।


এই কারনেই এর নামকরন, সহস্রধারা।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৯:৪১
৩৬টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×