এই ছবিটা শিম্পপ্লাম্পতি পাড়ায় তোলায়।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া তল্যাং ময় বা সাকা হাফং নিয়ে আগের পর্ব
স্বাভাবিক ট্রেইল থেকে অনেক উচুতে বড় একটা পাহাড়ের চুড়ায় অল্প একটু সমতল ভ্যালি। এই ভ্যালিতেই বম’দের শান্ত সবুজ গ্রাম শেরকর পাড়া। পাহাড়ে রাত কাটানোর জন্যে আমাদের প্রথম পছন্দ বম’দের গ্রাম। বম’দের কালচারে মদিরা প্রীতি নেই। অন্যদের খাওয়ানোর জন্যে জোরাজুরিও করেনা। আর তুলনামুলক ভাবে তারা স্বচ্ছল। আর সব পাহাড়ীদের মতোই অতিথিপরায়ন। আমাদের গৃহকর্তার নাম লালসিয়াম বম। বয়স ৬০-৬৫। আশ্চর্যরকমের শক্ত পোক্ত স্বাস্থ্য। লালসিয়াম’দায়ের ৫ছেলে। ছোটজন গ্রামের প্রাইমারীতে পড়ে আর সবার বড়জন থাকে থানছিতে মিশনারী স্কুলে।
সকাল বেলা আজকেও ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হলো। বাঁশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত মুখ ধুয়ে ছবি তুলতে শুরু করলাম। শেরকর পাড়া অত্যন্ত রুপসী একটা গ্রাম। চারপাশে লাল পাহাড়ের সারী। গ্রামের লোকেরাও অতি উৎসাহে ভীর করছিলো। গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব উৎসাহ চেপে রাখতে না পেরে চলে এলেন। হেডমাস্টার বলতে রাগী রাগী চেহারা বয়স্ক একজন শিক্ষকের কথা মনে হয়। এক্ষেত্রে সদ্য কৈশোর উর্ত্তীর্ন একজন। বয়স সাকুল্যে ২২-২৩ হবে। অনেক গল্প হলো তার সাথে। লালসিয়াম দা জানালেন উনিও যাবেন আমাদের সাথে। আমরা তাজিনডং সামিট করে আরো সামনে এগুবো। আজ বিকালে শিম্পপ্লাম্পতি পাড়ায় পৌছে যাব। এরপরে এগুনো যাবে পুবের পাহাড় বা মদকের দিকে।
দিদি (লালসিয়াম’দায়ের স্ত্রী) সকাল সকাল খাবার দিয়ে দিলেন। বিন্নী ধানের আঠালো ভাত আর নাপ্পি। শাতে কুমড়ো ভাজা। লালসিয়াম দা প্রস্তুতী হিসাবে একটা টকটকে লাল হাফপ্যান্ট, নীল গেঞ্জি, ক্যাপ আর রাবারের কেডস পড়ে নিলেন। গ্রাম থেকে বেড়িয়েই খাড়া উঠতে হয় কিছুটা। উপরে প্রাকৃতিক একটা ওয়াচ টাওয়ারের মতো সমতল একটা প্রান্ত আছে পাহাড়ের রীজ বরাবর। এখান থেকে চমতকার ভিউ দেখা যায়। দূরে পরিষ্কার ভাবে তাজিনডং এর ৩চুড়া। প্রথমে চিঞ্চিরময়, তাজিনডং (মুল চুড়া) এবং অজেয় লংফে ডং। এখান থেকে অবশ্য চিঞ্চিরময়কেই বেশী উচু দেখা যায়। কিন্তু লালসিয়াম দা দৃর ভাবে জানালেন পাহাড়ের কারনে কাছেরটাকে বড় মনে হচ্ছে। গুগল আর্থেও চিঞ্চিরময়ের চেয়ে তাজিনডং উচু। কিছুদিন আগে নাকি এক আমেরিকান লোক এসে শেরকর পাড়ায় এক সপ্তাহ ছিলেন। নিয়মিত যন্ত্রপাতি দিয়ে দুটো পাহাড়ই মেপে নিশ্চিত করেছে তাজিনডং চিঞ্চিরময়ের চেয়ে উচু।
এই উচু পাহাড়টা থেকে নেমে বেশ কয়েকবার খাড়া উঠা নামা। ঢেউয়ের মতো, কিন্তু প্রচন্ড কষ্ট সাধ্য লাগলো। প্রথম এক ঘন্টায় প্রচন্ড রকমের কষ্ট হলো, অবশ্য একটু পড়েই শরীর অভ্যস্থ হয়ে গেল। টানা ক-দিন পাহাড় বাওয়ায় শরীর মানিয়ে নিয়েছে। রুমা’র কেওকারাডং তাজিনডং এর চেয়ে অনেক বেশী উচু। কিন্তু অনেকেই ভুল করে তাজিনডং কে সবচেয়ে উচু বলে সম্ভবত এটা কেওকারাডং ওঠার চেয়ে ঢের বেশী দুর্গম বলে। আমার কাছে যতোটা তথ্য আছে নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া তল্যাং ময় বা সাকা হাফং (যেটায় যাচ্ছি)। এর পরে র্যাং তল্যাং (Rang Tlang) তার পরে কেওকারাডং। কেওকারাডং এর আরো কয়েকটা পিক আছে যেগুলো একই রেঞ্জের হলেও মুল চুড়ার কাছাকাছি। সবগুলোর নাম পর্যন্ত ঠিক ঠাক মতো নেই। এর পরেই ইন্ডিপেন্ডেণ্ট রেঞ্জের সিপ্পি আরসুয়াং বা মোরগের ঝুটি।
ভোড়ের শিশির ঠিক মতো শুকোয়নি। পথ ভেজা, আমাদের বুটের চাপে আরো বেশী কর্দমাক্ত। সামনে বিশাল বপু চিঞ্চিরময় (তাজিংডং পিক ১) সুর্যের আলোকে সযতনে আড়াল করে রেখেছে। লালসিয়াম’দা হাতের কাস্তে দিয়ে কুপিয়ে বড় বড় কিছু কলা পাতা বিছিয়ে দিলেন। এখানে একটু রেস্ট হলো। এর পরে আবার পথ চলা। কিছুক্ষনের মাঝে প্রকৃতি বেশ পালটে গেল। একমানুষ সমান উচু উচু ঝোপের মাঝ দিয়ে বেশ চওড়া একটা রাস্তা। বেশ বড় বড় আকারের পাথরে ভর্তি। রাস্তা একদম খাড়া ভাবে সোজাসুজি আকাশ ছোঁবার তাল করেছে। অনেক উচুতে, পিছে সব খোলা জায়গা। দূরে আকাশের কাছে চীনের প্রাচীরের মতো আঁকা বাঁকা চিম্বুক রেঞ্জ,। এরপরেও প্রচন্ড হাওয়া সব উত্তাল করে রাখে। বামে দূরে অনেক গুলো পার্বত্য সারী। লালসিয়াম’দা সব চিনিয়ে দিলেন, ওটা বড় মদক, ওটা ছোট মদক, ঐ পাহাড়ের ওপাশে রেমাক্রি, আর এদিকে সোজা গেলে ইয়াংরাই। ঐ যে আকাশের কাছে বড় ঝাপসা চুড়োটা মেঘ ধরার তাল ধরেছে ওটার নাম তল্যাং ময়, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া। খাড়া ট্রেইলটা সাপের মতো এঁকে বেঁকে উঠে গেছে প্রায় ৪৫ডিগ্রি করে। ঘড়িতে ১১টার মতো বাজে। আমরা বসলাম নাস্তা করতে। ব্যাগে ছিল পাউরুট আর মেয়োনেজ। প্রচন্ড ঠান্ডার কারনে সেদ্ধ ডিম আর মাংস ভাজা প্লাস্টিকের বাক্সে ছিল একদম টাটকা। ভাজা মাংস আর সেদ্ধ ডিম ভর্তা করে মেয়োনেজের সাথে ঘুটে পাউরুটির সাথে স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেতে লাগলো অমৃতের মতো। খেতে খেতে লালসিয়াম দা’র সাথে আলাপ হলো অনেক বিষয় নিয়ে। দাদা জানালেন আগে একসময় এখানে শান্তি বাহিনীর উতপাত ছিল মাত্রা ছাড়া। আমরা যেখানে বসে আছে এই ট্রেইলের কোথাও শান্তিবাহিনীর সাথে গুলিযুদ্ধে জনৈক মেজর শহীদ হন। শান্তিবাহিনীর গেরীলাদের ৯০ ভাগই ছিল চাকমা, যারা চাকমা নয় তারা মারমা বা মং। কিন্তু বম, ম্রো, তঞ্চংগ্যা, চাক এদের উপস্থিতি এতই কম ছিল যে শান্তিবাহিনীর দাবী (কিংবা বর্তমানে ইউপিডিএফ) কখনোই সার্বজনীন কোন পাহাড়ী সংগঠন হয়নি। সেনাবাহিনী গ্রামে গ্রামে ঢুকে লোকজনকে ধমকি দিয়ে বেড়াতো কোন অবস্থাতেই যেন শান্তিবাহিনীকে চাঁদা না দেয়। আর শান্তিবাহিনী এসে গ্রামের জুম চাষীদের গলায় কারবাইনের নল ঠেকালে চাঁদা না দিয়ে উপায় ছিলোনা। গ্রামের এইসব দরিদ্র মানুষ দু-পক্ষের হুমকি ধামকিতে করুন অবস্থায় পড়তো। এই গ্রামের সাধারণ লোকেদের কাছে বাংলাদেশ বা জুমল্যান্ড অর্থহীন।
চমতকার ট্রেইলটা শেষ হলো তাজিনডং এর একদম কাছেই। এখানে গাছপালা দূরে দূরে আর বেশ পাথুরে আর রুক্ষ। মাত্র শ-খানেক ফুট দুরেই তাজিনডং চুড়ো। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায়। কিন্তু পথটা চুড়াটাকে আরেকটা পাক দিয়ে তাজিনডং এর পাশ দিয়ে কাপ্তা পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। বাংলাদেশের বেশীর ভাগ পাহাড়ই পশ্চিম থেকে পুবে আস্তে আস্তে উঠেছে আর পশ্চিম থেকে পুবে খাড়া ভাবে উঠে গেছে। তাজিনডং এর পেছন দিকে রাস্তাটা বেশ চিকন। বামে তাজিনডং এর পাথুরে দেয়াল আর ডানদিকে কিছুই নেই বিশাল খাদ। খুব সহজেই বাঞ্জি জাম্পিং বা গ্লাইডিং করা যাবে। এদিকে চমতকার ভিউ। সবুজ অরণ্য। উচু নিচু ভাজে ভাজে গ্রাম আরেকটু দূরে হঠাত করে মনে হয় প্রকৃতি অন্যরকম আরেকখন্ড। যেন দুটো প্লেট মাঝবরাবর কেউ টেনে ছিড়েছে। ওপাশে মদকের বিচ্ছিন্ন চুড়া গুলো আর তার পরেই মায়ানমার। মাঝখানের ছেড়া অংশ দিয়ে বয়ে গেছে রেমাক্রি। প্রকৃতির সু-স্পষ্ট বিভাজন।
তাজিনডং এর একদম পাশ ঘেষে ট্রেইলটা চলে গেছে কাপ্তা পাহাড়ের দিকে। পথের উপরে ব্যাকপ্যাক আর অন্যান্য জিনিস রেখে দিয়ে শুধু ক্যামেরাটা আর জিপিএসটা নিয়ে ছোট্ট একটা জঙ্গুলে জায়গা দিয়ে উঠলাম উপরে। প্রচন্ড কাটা ঝোপ আর ওপাশে খাদটা বেশ বিপদজনক। দুই হাত আর দুইপা ব্যাবহার করে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠতে হলো। দেড়টার মতো বাজে উপরে ভয়ঙ্কর রোদ চোখ ঝলসে দিল যেন। পিছে চিঞ্চিরময়, পাশে কাপ্তা পাহাড় আর আরো দূরে কেওকারাডং এর অস্পষ্ট সারী। সামনে অজেয় লংফে ডং। আর তারো পিছে মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে বাংলাদেশের ছাঁদ তল্যাং ময় বা সাকা হাফং।
আলম ভাই অনেক পিছে পড়ে গেছে। গাইড লালসিয়াম দাও ওনার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি একা একা চুড়োয় বসে। আশে পাশে মানুষ দুরের থাক একটা পাখিও নেই। আশ্চর্য সুনসান। মনে হলো পৃথিবীতে আমি একাই যেন মানুষ। আমি দেরী না করে একটা মরা গাছের ডাল ভেঙ্গে তাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিলাম। তাজিংডং এর উচ্চতা জিপিএস এ দেখাচ্ছে ২৭৪০ফুট এবোভ সী লেভেল। কেওকারাডং ৩১৭৬ফুট আর স্বপ্নের পুবের চুড়া তল্যাং ময় ৩৪৮৮ফুট।
ছবিঃ
শেরকর পাড়ার মেয়েরা
শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদে মিষ্টি শৈশব। শেরকর পাড়া
তাজিনডং এর ট্রেইলে কোথাও বুনো প্রজাপতি। খুব ক্লান্ত হয়ে গেলে যখন মুখ ফুটে অন্যদের বলতে লজ্বা লাগে যে আমার রেস্ট দরকার তখন ছবি তুলার অজুহাত তুলতে হয় …
চিঞ্চিরময়, তাজিনডং থেকে।
হাচড়ে পাঁচড়ে নামছেন আলম ভাই।
লালসিয়াম-দা'র সাথে তাজিনডং এ।
৩টা আলাদা আলাদা প্রমিনেন্ট পিক তাজিনডং এর। মুলচুড়া তাজিনডং, কাছা কাছি উচ্চতার চিঞ্চিরময় আর অজেয় চুড়া লং ফে ডং। লং ফে ডং এ উঠার কোন রাস্তা নেই। তবে কেউ জুমারিং করে চুড়াতে উঠতে পারবে।যতোটা জানিএখনো ভার্জিন পিক।
শিম্পলাম্পতি পাড়া।
সরকারী অনেক দলিল দস্তাবেজে তাজিনডং কে সবচেয়ে উচু চুড়া বলে ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হয়। জিপিএস দেখাচ্ছে ২৭১০ফুট। ২৭৪০ফুটের মতো হবে আসলে। কেওকারাডং ৩১৯৬ (সরকারী হিসাবে ৩১৭৬) আর সাকা হাফং (বাংলা অর্থ পুবের পাহাড়) ৩৪৮৮ফুট।
তাজিনডং এর মুল চুড়াতে উঠার আগে শেষ চক্কর (মুল চুড়া থেকে প্রায় ১০০গজ নিচ থেকে)। উচু চুড়ার উপরে আকাশের রঙ আশ্চর্য রকমের চকচকে। অনেকে এই রংটাকে হাই অল্টিচিউড ব্লু বলে ডাকে।
হাত বাড়ালেই তাজিন ডং। মুল চুড়া খুব কাছে কিন্তু এখান থেকে উঠার রাস্তা না থাকায় পুরোটাকে ঘিরে একটা চক্কর দিতে হয়।
এটারও একই অজুহাত। যখন প্রচন্ড ক্লান্তি, কিন্তু লজ্বায় বলতে পারা যায়না যে, ভাইজানেরা আপনেরা থামেন আমি আর পারি না। তখন ছবি তুলার নাম করে রেস্ট নিতেছিলাম।
আমি আর লাল সিয়াম দা। বেনসন লাইট থেকে আকিজ বিড়িতে নামতেছি।
শেরকর পাড়া থেকে বেড়িয়েই একটা ঢাল। রাস্তাটা দেখে লাগে নামছি। কিন্তু এখান থেকে ভয়ঙ্কর খাড়া ট্রেইল। উঠতে উঠতে বিরক্তি ধরে যায়।
তাজিনডং আর চিঞ্চির ময়, দুই চুড়ার মাঝা মাঝি।