somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

:::: হিমালয়ান ডায়েরী- স্তোকের পথে :::

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লেহ শহরের থেকে স্তোক কাংড়ির সফেদ চুড়া।

স্তোক কাংড়ি, হিমালয়ের লাদাখ রেঞ্জের একটা শ্বেত শুভ্র চুড়া। দৈত্যাকার পর্বত চুড়াটার উচ্চতা বিশ হাজার একশ সাইত্রিশ ফুট বা ৬১৩৫ মিটার। প্রচন্ড ঠান্ডা আর পাতলা বাতাসে অক্সিজেন স্বল্পতাই চুড়াটাতে পা রাখতে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু স্তোক উপত্যকার আশ্চর্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ওয়াইল্ড লাইফ আর তিব্বতী সংস্কৃতি ভুলিয়ে দেয় সব।

লাদাখি’রা বলে চরম শত্রু আর পরম বন্ধু ছাড়া কেউ লাদাখে আসে না। যোগাযোগ ব্যাবস্থার দুর্গমতা আর ভু-পৃষ্ঠ থেকে অনেক বেশী উচ্চতার কারনে একসময় কথাটা সঠিক ছিল। এখনও বাই রোডে লাদাখ যাওয়াটা বেশ কঠিন। মানালী দিয়ে রোটাং পাস দিয়ে ঢুকতে হয় তুষার পাত আর পাহাড় ধ্বসে রাস্তাটা বছরের বেশীর ভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। আর বন্ধও হয়ে যায় তেমন কোন আগাম খবর দিয়ে, মানালী থেকে বাসের টিকেট দেবার সময় বলে দেয় রাস্তা ২ দিনের কিন্তু কমপক্ষে ৪ দিন বাসে থাকার মতো প্রয়োজনীয় প্রস্তুতী নিয়ে রাখতে।
অফিস থেকে ছুটি পেতে সমস্যা হচ্ছিল, তাই এমন বায়বীয় আইটেনিয়ারি নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। যদিও জানি পাহাড়ে উঠতে গেলে প্লেনে যাবার চেয়ে বাই রোডে গেলেই বেশী সুবিধা, তারপরেও আকাশ পথে যেতে হবে।

ঢাকা থেকে লাদাখ যেতে হলে দিল্লী হয়ে মানালী যেতে হয় প্রথমে, সেখান থেকে রোটাং পাস (১৩০৫০ফুট) হয়ে লেহ। আরেকটা রাস্তা হলো কলকাতা থেকে হিমগিরী এক্সপ্রেস ট্রেনে জম্মু, জম্মু থেকে আকাশ পথে বা বাই রোডে লেহ। ঢাকা থেকে সঙ্গীরা শেষ মুহুর্তে সরে গেলে একাই যাচ্ছিলাম, ঈদের ছুটির মাঝে খালি খালি অচেনা ঢাকা ছেড়ে। কিংফিশার এয়ারলাইন্সের কলকাতা গামী যেই প্লেনটা দিল সেটাকে প্লেন না বলে পাখা লাগানো মিনিবাস বলাই ভালো। ঈদের সময়, বাংলাদেশী যাত্রী প্রচুর। প্রায় চল্লিশ মিনিট ডিলে করে প্লেন ছাড়লো, ঢাকার রৌদ্র ঝলমলে আকাশ থেকে খুব অল্প সময় কলকাতায়, আমার জীবনে প্রথম আকাশ পথে কলকাতা। কলকাতায় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে বুঝলাম চারদিকে প্রচুর পানি জমে আছে দেখে।

কলকাতার নেতাজী সুভাস বোস বিমানবন্দরের ইন্টারন্যাশনাল কর্ণারটা দেখে হতাশই হতে লাগলো। জানি না বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোন আন্তর্জাতিক রুটের প্লেন নামে কি না। ইমিগ্রেশানে লম্বা লাইনে সবার পিছে দাড়ালাম। ইমিগ্রেশন অফিসার ছুচালো চেহারার এক দাদা। জিজ্ঞেস করলো ‘দাদা সাথে কিচু এনেচেন নাকি? ইলিশ মাচ টাচ? আমাদের জন্যে কিচু দেবেন না?” কোন কথা না বলে এক দৃষ্টিতে তাকাতেই নিজেই স্বগোক্তির মতো উত্তর দিল, ঠিক আচে ঠিক আচে পড়ের বার।

ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভবন

দিল্লীর সরাসরি ফ্লাইট না পাওয়ায় কলকাতায় ৪ ঘন্টার যাত্রা বিরতী। সহযাত্রীরা সবাই ঢুকলো ডিউটি ফ্রি শপে, ঠিক করে বলতে গেলে লালপানির কর্ণারে। দেশের বাইরে এলেই সবার খুব পিপাসা পায় ঘন ঘন। গেট দিয়ে বাইরে বেরুতেই একদল ট্যাক্সি ড্রাইভার বললো চলুন দাদা ডোমেস্টিকে নিয়ে যাই, অল্প খরচে নিয়ে যাব। কথাটার মানে ঠিক মতো বুঝলাম না, ডোমেস্টিক এখান থেকে শ খানেক ফুট দুরত্বও না। এটাতে অল্প খরচে ট্যাক্সি কিভাবে নেবে? আমার চেহারায় মনে হয় বেকুব বেকুব ভাব আছে। ডোমেস্টিকের বাইরে একটা দোকান থেকে ভারতীয় সীম কিনে দিল্লীতে স্যাম আর হোটেল ওয়ালাদের সাথে কথা হলো। স্যাম এই যাত্রায় আয়োজক। ঢাকা থেকে সঙ্গী কাউকে না পেয়ে ইন্টারনেটে মাউন্টেনিয়ার্সদের ফোরামে খোজা খুজি করে স্যাম, পিটার হানুসিক আর তার বন্ধুর সাথে ভীরেছি। স্যামের কাজ সব যোগারযন্তর করা। পিটার আর তার বন্ধু বিশ হাজারী চুড়াটায় ওঠার আগে প্রস্তুতী নিতে একটা ট্রেকে গেছে, যোগাযোগের কোন উপায় নেই। এয়ারপোর্টের সামনে ফুটপাথে দর্শনীয় ভাবে ফুলে থাকা হ্যাভারস্যাক, স্লিপিং ব্যাগ, ম্যাট আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে থাকলাম ঘন্টাখানেক, ৪০০ বছরের সিটি অফ জয়ের আকাশে সূর্য ডুবে গেলে ঢুকলাম ভেতরে। ইন্টারন্যাশনালের তুলনায় ডোমেস্টিকের শান শওকত অনেক বেশী, ঝকঝকে আধুনিক। দিল্লীগামী এয়ারবাসটাও অনেক ভালো।

রাজপথ, দূরে ইন্ডিয়া গেট।

চেক ইন ঢাকা থেকেই করে এসেছিলাম, তাই বিশেষ ফর্মালিটিস ছিল না। এই ফ্লাইটটাও ডিলে প্রায় ৪০ মিনিট। পাশের সীটে গেরুয়া পরিহীত এক মাথা কামানো সাধু বসলেন, চেহারা অবিকল ইন্ডিয়ানা জোনসের প্রথম পার্টের অমরেশপুরীর মতো চেহারা এবং বেশভুষা। প্লেন টেক অফের পর পরেই প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, বাম্প করছিল অনেক বেশি, কিন্তু সহযাত্রী সাধুবাবার ধ্যানে এরপরেও ব্যাঘাত ঘটলো না, প্লেনের ইঞ্জিনের সাথে পাল্লা দিয়ে নাক দিয়ে বজ্র নিনাদ বের করতে থাকলেন।

নয়া দিল্লীর ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্টে মুষুল ধারে বৃষ্টির মাঝে নামলাম। লাগেজ খুঁজে নিয়ে বাইরে বেরুতেই হোটেলের ড্রাইভার তিলককে খুঁজে পেলাম। ঘড়ির কাটা ততক্ষনে রাত সাড়ে ১২টা, কিন্তু কপাল খারাপ এয়ার পোর্ট থেকে বেরুতে না বেরুতেই চাকা পাংচার। ঝুম বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়াই বেরিয়ে পড়লাম, নিয়নের সোনালী আলোর নিচে ভিজে ভিজে ড্রাইভারকে চাকা পাল্টাতে সাহায্য করলাম ভেজার উদ্দেশ্যেই।

দিল্লীর পাহাড়গঞ্জের হোটেল এলাকা, চারপাশেই খালি হোটেল। অনেক গুলো বাংলা সাইনবোর্ডও চোখে মধুবর্ষন করলো-‘এখানে বাঙ্গালী/ অসমিয়া খাবার পাওয়া যায়’। দ্বীতিয় দিন অনেক কাজ। দিল্লিতেও প্রথমবার। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম দিল্লি ঘোরার। স্যাম জানিয়েছিল সরকারী ট্যুরিস্ট বাসে টিকেট কেটে বসে পড়লেই হলো। কিন্তু ওদিন রবিবার হওয়ায় টুরিস্ট স্পট অনেকগুলোই বন্ধ। হোটেলের থেকে সারাদিনের জন্যে তিলক ড্রাইভারকে ভাড়া করলাম। সেই বিভিন্ন স্পটে নামিয়ে দেবে, আর আমি নিজের মতো করে আরাম করে ঘুরবো। গাইডেড ট্যুর সবসময়ই মেকী মেকী লাগে।

বিড়লা মন্দিরের বাগানে...

দিল্লী অনেক প্রাচীন শহর, বল্লাল সেনের ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে ঘিরে ঢাকার জন্ম হয়েছে ধারনা করলে ঢাকার বয়স প্রায় হাজার বছর, সে তুলনায় কলকাতা সেদিনের শহর, ৪০০ বছর আগে জন্ম। দিল্লীর কথা নাকি মহাভারতেও ছিল। তবে বর্তমান নয়া দিল্লীর অভিজাত অংশে এপার্টমেন্ট বানাতে গিয়ে নাকি একটা অশোক স্তম্ভ পাওয়া গেছে বয়স প্রায় দু হাজার বছর (তিলকের ভাষ্য)। মোগল আমলে স্থাপত্যকলায় দিল্লি হয়ে যায় অনন্য। ইংরেজরা রাজধানী করে কলকাতায়, কিন্তু দিল্লীর শানশওকত কমাতে মোগল এলাকার বাইরে দালান কোঠা নির্মান করে। বর্তমানের নতুন দিল্লী সেই হিসাবে ওল্ড, আর ওল্ডটা প্রকৃতপক্ষে নতুন। তিলক পাহাড়গঞ্জ থেকে বের হয়ে একটা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় সব কিছু বোঝাচ্ছিল, রাস্তাটার একপাশে নতুন আর অন্যপাশে পুরান দিল্লী।

প্রথমেই নিয়ে গেল বিড়লা মন্দির। মন্দির মসজিদ সম্পর্কে আমার আগ্রহ কম। কিন্তু তিলক জানালো এটা নাকি ট্যুরিস্টদের খুবই পছন্দের জায়গা। মন্দির মার্গে এই মন্দিরটার আসল নাম লক্ষী নারায়ন মন্দির। প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত শিল্পগোষ্ঠী বিড়লা ফ্যামিলি। ১৯৩৩ সালে নির্মান শুরু আর ১৯৩৯ সালে শেষ হলে বিড়লারা মহাত্মা গান্ধীকে অনুরোধ করে মন্দির উদ্ধোধন করতে। মহাত্মা গান্ধী শর্ত দেন- যদি এই মন্দিরে শুধু ব্রাহ্মন নয়, সকল ধর্ম এবং হিন্দুদের সব বর্ণের সমান অধিকার ঘোষনা করা হয় তবেই উনি মন্দির উদ্ধোধন করবেন। বিড়লারা এই প্রস্তাব মেনে নেয়।

মন্দিরের সামনে এক গাদা পশ্চিমা ট্যুরিস্টকে দেখলাম, গেরুয়া কাপড় আর গামছা বাধা মাথায়, গলায় নামাবলি। এদের দেখলেই কেন জানি মেজাজ গরম লাগে। মহা উৎসাহে তারা দেব মূর্তী দর্শনে ব্যাস্ত হয়ে গেল। আমি ভেতরে একটা চক্কর দিয়েই মন্দিরের পেছনে বাগানে চলে এলাম। সাড়ে সাত একরের জায়গা জুড়ে বাগান আর ভাষ্কর্য। আদর্শ তপোবনের মতো। ছোট কৃত্রিম লেকের উপরে সুন্দর সুন্দর ঝর্ণা। প্রচুর পাখি আর কাঠবেড়ালী পূণ্যার্থিদের দেয়া খাবার খুটে খায়। অনেকে মনে হয় ডেটিং প্লেস হিসাবেও এটা ব্যাবহার করে। গাছ গাছালির ভেতরে হাটছিলাম, হঠাত অল্পবয়সী এক ছেলে-মেয়ের এক্সরেটেড ডেটিং এর মাঝে এসে উপস্থিত। ওরা বিব্রত হবার আগেই আমি বিব্রত হয়ে বেড়িয়ে এসে গাড়িতে চেপে বসলাম।

লোটাস টেম্পল বা পদ্ম মন্দির।

কিছুক্ষন পরে একটা গুরুদয়ারাতে নেওয়ার জন্যে তিলক জোরাজুরি করলেও রাজী করাতে পারলাম না। দুর থেকে তার স্বর্ণালী চুড়ার ছবি নিলাম। এর পরে সংসদ ভবন এর সামনে দিয়ে বিখ্যাত রাজপথ। রাজপথের দুধারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় আর ডিফেন্স মিনিস্ট্রির দুটো একই চেহারার যময ভবন। ঠিক মাঝ খানে রাষ্ট্রপতি ভবন। নেমে ছবি টবি তুলে আবার রাজপথ ধরে চলে এলাম বিখ্যাত ইন্ডিয়া গেটে। রাজপথ, ইন্ডিয়া গেট, রাষ্ট্রপতি ভবন সহ পুরো এলাকাই ব্রিটিশ আমলে তৈরি। স্থপতি এডউইন লুট্যন আর হার্বার্ট বেকার মিলে আশ্চর্য সুন্দর জ্যামেতিক শেপ দিয়ে বানিয়েছেন পুরো এলাকাটা। ইন্ডিয়া গেটের মাঝে খোলা জায়গাতে নাকি আগে রাজা পঞ্চম জর্জের ভাষ্কর্য ছিল, ৪৭ এ ভারত স্বাধীন হলে এটা সরে যায়। একই ভাবে গভর্ণর জেনারেল ভবন রাষ্ট্রপতি ভবন নামে পরিচিত হয়।
ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল নামের এক মিউজিয়ামে নিয়ে এল তিলক, কিন্তু রোববার দেখে সেটা বন্ধ ছিল, সেটাতে তেমন কোন কষ্ট পেলাম না। কিন্তু কষ্ট লাগলো শুনে লাল-কেল্লাও সাপ্তাহিক ছুটির দিন বন্ধ। দিল্লীতে আর সময় পাচ্ছি না। লাল-কেল্লা, কুতুব মিনার দেখার স্বপ্নটা খুব জোরালো ছিল। লাল-কেল্লা মিস হলেও যাতে কুতুব মিনার মিস না হয়।

কাটুম :D


বিড়লা মন্দিরের বাগানে কাঠবেড়ালী।

দিল্লী মুল শহর থেকে কুতুব মিনার বেশ দূরে। হরিয়ানার রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে, মাঝে অবশ্য তিলক প্রায় জোর করে একটা হ্যান্ডিক্রাফটের মলে ঢুকিয়েছিল। জানতে পারলাম ওদের সাথে কোম্পানীর এগ্রিমেন্ট আছে, দোকানে টুরিস্ট নিলে ওরা কমিশন পায়। কিন্তু আমার ১০ মিনিটেই সব দেখা হয়ে যাওয়ায় বেচারা প্রাপ্য কমিশন পায়নি।
কুতুব মিনার থেকে একটু সামনেই পার্কিং লট। পাশেই টিকেট বুথ। তিলক নিজে গিয়ে ভারতীয় টিকেট কিনে আনলো, আমার হিন্দি জ্ঞান সে খুব দ্রুত বুঝে গেছে। মুখ খুললেই ওরা বুঝে যাবে আর আমাকে কয়েকগুন বেশী দামে বিদেশী টিকেট নিতে হবে। কুতুব মিনারে এসে দম আটকে আসলো। মানুষের অমর কীর্তি। প্রায় ২৪০ফুট উচু মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় মিনার। মানুষ হিসাবে নিজেকে গর্বিত ভাবতে নিজের ক্ষমতার উপরে আস্থা ফিরাতে এধরনের স্থাপত্যগুলোর ভুমিকাই অনন্য। ঢুকতেই একটা প্রাচীন মসজিদ আর কয়েকজন ইমামের কবর। এর পাশ দিয়ে ঢুকে সোজা মাঠের উলটো দিকে চলে গেলাম। রাজপুত সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে কুতুব উদ্দিন আইবেকের দিল্লী দখল করার বিজয় স্তম্ভ হিসাবে ১১৯২সালে কুতুব মিনারের জন্ম বলে ধরা হয়। আরেকদল বলে আসলে কুতুব মিনার নির্মানের কাজ শুরু করেছিলেন পৃথ্বিরাজ চৌহানই। তার আদরের কন্যাকে রাজধানী থেকেই যমুনা দর্শনের সুযোগ দিতে এই স্থাপনা শুরু করেছিলেন। ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক আছে। কুতুবউদ্দিন আইবেক ছিলেন মামলুক ডাইনেস্টির প্রতিষ্ঠাতা। ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পরে স্থানীয় যুদ্ধবন্দী দাসরা অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে, এরা লড়াকু যোদ্ধা ছিল। এরাই মামলুক বা দাস রাজবংশ। এদের হাত দিয়েই দিল্লীতে মুসলিম শাসন চালু হয়, যা মোগল পাঠান হয়ে বাহাদুর শাহ এর সময় শেষ হয়েছিল।

বিড়লা মন্দিরের বাগানে কাঠবেড়ালী।

কুতুব কমপ্লেক্সে প্রচুর গাছ পালা, এর মাঝেই একটা অদ্ভুত সুন্দর সাদা কাঠবেড়ালীর ছবি পেলাম। সোজা গেলে আলাই মিনার। এই মিনারটা মাত্র ৮০ ফুট উচু। কিন্তু এটা শুধুই বেজ লাইন। সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজী এর কাজ শুরু করেছিলেন, ইচ্ছে ছিল কুতুব মিনারের চেয়েও অনেক বড় নতুন মিনার তৈরির। কিন্তু কাজটা অসমাপ্ত থেকে যায়। আলাউদ্দিন খিলজীর সমাধী, সম্রাট ইলতুতমিশের সমাধি, আলাই মাদ্রাসা মসজিদ হয়ে পেলাম লোহার স্তম্ভ। মুসলিম দখলের আগে এখানে বিষ্ণু মন্দির ছিল যেটা মুসলিম শাসকরা ধ্বংস করে ফেলে। সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ৪০২খ্রিষ্টাব্দে উদয়গীরির এক মন্দিরে এটা স্থাপন করেছিলেন। সে হিসাবে এটার বয়স প্রায় ১৭শ বছর। পরে আরেক সম্রাট এটাকে এখানে ধ্বংস হওয়া এই জায়গার মন্দিরে নিয়ে আসে ১০ম শতাব্দিতে। এটার ওজন প্রায় ৬হাজার কেজি। কুতুব মিনারে অনেক গুলো ছবি তুলে গেলাম আলাই দরওয়াজা দেখতে। খুবই সুক্ষ আর দুর্দান্ত কারুকাজ করা ছাদ।
কুতুব মিনার থেকে বেরুতেই তিলক আবার চেষ্টা করলো একটা শপিং মলে ঢুকাতে। কিন্তু এবারেও রাজী হলাম না। লোটাস টেম্পল দেখে গেলাম হুমায়ুন’স টম্ব দেখতে। বিশাল জায়গা জুরে বাগান। এর মাঝেই অনেক গুলো সমাধি সৌধ। ইসা খাঁনের কবর (বারো ভুইয়া নন, সম্রাট হুমায়ুনের এক সেনাপতি), সম্রাটের নাপিতের সমাধি সৌধ, বু হালিমা (সম্রাটের ভগ্নী জাতীয় কেউ সম্ভবত ইতিহাস অজ্ঞাত)’র কবর, কিছু অজ্ঞাত আরব সৈনিকের কবর। আর মাঝখানে অসাধারন বিশাল সম্রাট হুমায়ুনের কবর। সৌধের সিড়িতে আসতে না আসতেই ঝুম বৃষ্টি।

আলাই মাদ্রাসার গাছের উপরে সাদা কাঠবেড়ালী।

এত বড় সৌধের তুলনায় কবরটা সাদামাটা। মোগল ইতিহাসের এই পরাক্রমশালী সম্রাটের কবরের পাশে অন্ধকার ঘরে বিষন্ন লাগলো। এদিকে বিকাল ৪টার বেশী বাজে, ক্ষুধায় প্রান যায়। কিন্তু বৃষ্টি থামা থামির নাম নেই। পরে ভিজতে ভিজতেই বেরুলাম
লোটাস টেম্পল হয়ে ফেরার পথে, স্যামের আর্জেন্ট ফোন। কিছু কেনা কাটাও বাকী ছিল। স্যাম সাহায্য করবে কিনতে। সে থাকে দিল্লী ইউনিভার্সিটির সাউথ হোস্টেল এলাকায়। জায়গাটার নাম সত্যনিকেতন। খরচ বাঁচানোর জন্যে হোটেলের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাস কিংবা সিএনজি নিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঝুম বৃষ্টিতে দিল্লী ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীদের সাথে ধাক্কা ধাক্কি করে সুবিধা করতে পারলাম না। সিএনজিওয়ালাদেরও বোধহয় সব দেশেই একই আচার। কেউ যেতে রাজী না। তিলক চলে যায়নি তখনো বাধ্য হয়ে তাকে থামিয়ে আবার চললাম। ডিপ্লোম্যাটিক জোনের মধ্যে দিয়ে চওড়া আধুনিক রাস্তা হয়ে সত্যনগর এসে দেখি অবিকল ফার্মগেট। চারপাশে কোচিং সেণ্টার গুলোর মতো কম্পিউটার স্কুল আর হাবিজাবী। সব ছাত্র ছাত্রিরা দৌরা দৌরা করছে, ফার্মগেট বললাম কারন বৃষ্টিতে এক হাটু পানি জমা। গাড়ি আর যাবে না দেখে নেমে পড়ে স্যামকে আসতে বললাম।
স্যামের বাসা ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ার্স ফোরামের কাছেই।ওর মুল আগ্রহ রক ক্লাইম্বিং এ। কিন্তু আগে একবার স্তোক কাংড়ি যাবার চেষ্টাও করেছিল। গতকালকেই বলেছিলাম আমি সব যোগার যন্তর করতে পারি নি। অনেক কিছুই দিল্লী থেকে কিনতে হবে। এসেই হম্বি তম্বি, দূর মিয়া ঢাকা থেকে যখন ফোন দিয়েছিলে তখন বলতে, আমি থাইল্যান্ড থেকে অনেক ইন্সট্রুমেন্ট আনালাম। তুমি বললে ডাবল করে আনাতাম তাহলে খরচও কম পড়ে যেত।
সত্যনিকেতনে ছাত্রদের লাউঞ্জ, কফিশপ, সাইবার ক্যাফে আর বুকস্টোরের পাশেই অনেকগুলো ভালো এডভেঞ্চার স্পোর্টসএর দোকান। ঢুকেই মাথা ঘুরিয়ে দেয়। কি নেই, আইস বুট, আইস এক্স থেকে শুরু করে বাঞ্জি জাম্পিং এর ইন্সট্রুমেন্টও। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের বিয়ার গ্রেইলের ক্রেজ খুব বেশী দেখলাম। নর্থ ফেস ব্রান্ডের আল্পাইন জ্যাকেটের পাশে বিয়ার গ্রেইলের স্টিকার বসানো কালো তালি মারা বদখদ চেহারার প্যান্ট, সেই ছুরি আর ফায়ার স্টোনও চোখে পড়লো। টাকা থাকলে পুরো দোকানটাই তুলে আনতে মন চায়।
দোকানে বয়স্ক দাড়িওয়ালা এক লোক ঘুরছিলো দুনিয়ার বিভিন্ন রকমের দড়ি টানা টানি করে দেখে দেখে। স্যাম বিনয়ে গদ গদ হয়ে ওনাকে দেখিয়ে জানালো উনি নাকি খুব বিখ্যাত লোক নাম লোলিত স্যার। স্যাম বলে দিল ওনাকে আইএমএফ এর সবাই বলে ফাদার অফ ইন্ডিয়ান রক ক্লাইম্বিং (পরে ঢাকার খ্যাতিমান মাউন্টেনিয়ারদের কাছেও অনেক প্রশংসা শুনেছি)। লোলিত স্যারের কাছে স্যাম নিয়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল, স্যার এ এসেছে বাংলাদেশ থেকে, স্তোক কাংড়ি ক্লাইম্বিং এ।

সম্রাট ইলতুতমিশের কবর।


আলাউদ্দিন খিলজীর অসমাপ্ত আলাই মিনার, দূরে কুতুব মিনার। আলাই মিনারের বেজ লাইন দেখেই বোঝা যায় কুতুব মিনারকে টেক্কা দিতে বানানো শুরু করা কি বিশাল কাজই না সম্রাট হাতে নিয়েছিলেন।


মোগল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধী সৌধ।


সম্রাট হুমায়ুনের জমকালো সমাধী সৌধের ভেতরে তুলনামুলক সাদামাটা সমাধী।
বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে ভদ্রলোক খুব অমায়িক ব্যাবহার করলেন। নিজেই অনেক কিছু ইন্সট্রুমেন্টের কথা বললেন যেগুলো নেবার কথা কখনই ভাবি নি। ভদ্রলোক প্রায় জোর করেই ওগুলো কিনালেন। বিশেষ করে বুট গেইটারের কথা কেউই বলেনি। কিন্তু জিনিসটা কাকতালীয় ভাবে খুবই কাজে লেগে গিয়েছিল। ভালো দেখে একটা বুট (আমি একজোড়া এনেছিলাম যেটা পরে দেশে সবসময় ট্রেক করতাম, কিন্তু হিমালয়ে এর পার্ফমেন্স নিয়ে সন্দিহান ছিলাম), থার্মাল ভেস্ট-আন্ডারওয়ার, আল্পাইন গ্লাভস। আমার গ্লাভসের ইনারটা দেখে সে এক কথায় বলে দিল এটা দিয়ে কাজ চলবে না। আল্পাইন গ্লাভস পরে টেন্টে তুমি সাধারন কাজ করতে পারবেনা, রান্না বান্না করতে গেলেও গ্লাভস খুলতে হবে আর তাতেই হাতে ফ্রস্ট বাইট হতে পারে, লোহার কিছুতে হাত দিলে সঙ্গে সঙ্গে চামড়া উঠে আসবে। স্যামের এক জোরা ইনার গ্লাভস দিল, সে অনেক গুলো কিনেছিল এটা গিফট। সবশেষে সে দুঃসংবাদ দিল হঠাত কোন জানান না দিয়ে মারাত্মক কিছু জরুরী কাজ আসায় সে তার ট্রিপ ক্যান্সেল করেছে, ও আমাদের সাথে যেতে পারছেনা।
স্যামের সবার আগে লেহ’তে গিয়ে হোটেল টোটেলের ব্যাবস্থা করে রাখার কথা। ওর মাঝেই সে রসদ, গাইড, ঘোড়া-গাধার ব্যাবস্থাও করে রাখবে। কিন্তু বেচারা বার বার ক্ষমা চেয়ে বললো সে যেতে পারছেনা। কিছু বলারও উপায় নেই। এদিকে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। স্লোভাকিয়ান টিমদের সাথে এক সপ্তাহ ধরে যোগাযোগ নেই। স্যাম না গেলে নিজেদেরই সব কাজ করতে হবে, লাদাখে আমার চৌদ্দ গুষ্টিও যায়নি। সব আয়োজন করা খুব কঠিন। স্যাম বলে রাখলো সে প্রানপনে চেষ্টা করবে এই ঝামেলা থেকে বেরুতে। আর বের হলেই প্রথম ফ্লাইট ধরে লেহ’তে এসে আমাদের ধরবে। কিন্তু খুব ভরসা পেলাম না। দুঃশ্চিন্তা নিয়ে তিলকের গাড়িতে ফিরলাম পাহাড়গঞ্জে। কালকে লাদাখ যাত্রা।

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ২:২৫
২৫টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×