somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শের শায়রী
অমরত্বের লোভ কখনো আমাকে পায়না। মানব জীবনের নশ্বরতা নিয়েই আমার সুখ। লিখি নিজের জানার আনন্দে, তাতে কেউ যদি পড়ে সেটা অনেক বড় পাওয়া। কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া আর কিছুই নেই।

ঢাকার সিনেমা হলের ইতিহাস এবং "ফাইটিং আহে না ক্যাল্লা"

২৪ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সিনেমা হলগুলো নাকি বন্ধ হয়ে যাবে, আসলে যাবে কি অধিকাংশ ই বন্ধ হয়ে গেছে, যা আছে কোন রকম ধুকছে। সিনেমার পরিবর্তে এখন স্থান নিচ্ছে, মাল্টিপ্লেক্স, সিনেপ্লেক্স এই সব উদ্ভট নামের কিছু একটা। সিনেমা নিয়ে আমার শৈশবের যেটুকু স্মৃতি অবশিষ্ট আছে, সেটা হল স্বাধীনতার পর পর তখন আমরা বরিশাল ছিলাম, কদাচিৎ ম্যাটিনি শো (বিকাল ৩ টা থেক সন্ধ্যা ৬টা) আম্মা পাড়ার অন্যান্য কয়েকজন খালা সম্পর্কীয়দের নিয়ে সেই ম্যাটিনিতে সোনালী সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেত, আমরা দুই ভাই মা খালাদের সাথে ইংলিশ প্যান্ট (সেকালে ইংলিশ প্যান্ট নামে এক ধরনের হাফ প্যান্টের প্রচলন ছিল) পরে জামা ইন করে সিনেমা হলের সোনালী সিনেমায় ছবি দেখতে যেতাম।



সে সময় বরিশালে সোনালী সিনেমা হল ছিল কাঠের নির্মিত। উপরে সম্ভবতঃ ডিসিতে (ড্রেস সার্কেল এর সংক্ষিপ্ত হবে বোধ হয়) টিকিট কেটে সিনেমা দেখছি, তবে কি সিনেমা দেখছি এত কাল পর আর মনে নেই, তবে এটা মনে আছে মা খালাদের সে এক বিরাট উত্তেজনা ছিল সিনেমার গল্প, নায়ক নায়িকাদের পার্ট এসব নিয়ে, তাদের বিভিন্ন জ্ঞান গর্ভ আলোচনা চলত। হাফ টাইমে দশ মিনিটের জন্য ব্রেক পড়ত (ইন্টারভেল পর্দায় বড় করে লেখা উঠত) সে সময় চানাচুর মাখা, মুড়ি মাখানো কখনো কখনো সেভেন আপ বিক্রি হত "চাই চানাচুর, চাই মুড়ি, ঘটি গরম" আওয়াজের সহিত, অতি আনন্দ সহকারে সেগুলো খেতাম।


এফ ডি সি তে অভিনেতা নাদিম (১৯৬৭)

সমস্যা হত বসা নিয়ে চেয়ার গুলো ছিল কাঠের খট খটে, যেহেতু ডিসি মানে উন্নত টাইপের বসার আসন তাই হয়ত নারকেলের ছোবড়া দিয়ে কোন এক কালে এগুলোর বসার জায়গা মোড়ান থাকত। কিন্তু কালের কড়াল গ্রাসে সেই সিট স্থানে স্থানে ছিড়ে গিয়েছিল। সেখানে ছিল ছাড়পোকার অবাধ বসতি। সিনেমা দিয়ে যখন বের হতাম নিজের পশ্চাৎদেশ সহ পিঠ চুলকিয়ে লাল বানিয়ে ফেলতাম। তারপরো সিনেমা দেখার মুগ্ধতা আচ্ছন্ন করে রাখত। সেই সোনালী সিনেমাও এখন বিলুপ্ত। মাঝে মধ্যে দেখতাম সুদর্শন এক শিল্পী খাকি রংয়ের হাপ-পেন্টুল পরে বাঁশের তৈরী বিরাট ঝুলন্ত মইয়ের উপর বসে এক মনে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের বিশেষ ভঙ্গিমার ছবি আঁকছেন। শৈশবে সে সব স্মৃতি মনে দাগ কেটে আছে।


২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঢাকায় আমেরিকান সৈন্য (১৯৪৫)

যাক আন বাড়ি দিয়ে না গিয়ে ঢাকার সিনেমা হল গুলোর কথা বলি, প্রখ্যাত সাংবাদিক মীজানুর রহমানের স্মৃতিচারন মুলক লেখা “ঢাকা পুরান” শেষ করলাম। পুরানো ঢাকার এক অনবদ্য সংগ্রহ। আমাদের ঢাকা তথা সেকালের ইতিহাসের এক খনি। এর পাশাপাশি কিছুদিন আগে অনুপম হায়াৎ “পুরানো ঢাকার সাংস্কৃতি এবং নানা প্রসঙ্গ” এবং “অতীত দিনের স্মৃতি” আবুল কালাম সামশুদ্দীনের পড়ার পর মনে হল যে সিনেমাহল এবং সিনেমা এখন প্রাগৈতিহাসিক যুগের ডাইনোসারের মত বিলুপ্ত প্রায় তাদেরও একটা গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে, যে সিনেমার নাক শুনলে আপনারা আধুনিক ভদ্দরনোকরা নাক সিটকান আমাদের শৈশবে তাই ছিল এক মাত্র বিনোদন। তাদের নিয়ে দু এক পাতা না লিখলে নিজের অতীত কে অস্বীকার করা হয়। এবং এই সব নিয়ে কোন চর্চাও হয় না এই কারনে যে আমি পুরানো সিনেমা হলগুলোর ছবি সার্চ দিতে গিয়ে অন লাইনে পুরানো ছবির মাঝে দু একটা সিনেমাহলের ছবিই পেয়েছি। বাকী গুলো নাই, মানে তাদের ছবি সংরক্ষিত হয় নাই, যে জাতি নিজেদের ঐতিহ্য সংরক্ষন রাখে না তাদের পতন এক রকম অবশ্যাম্ভাবী অন্য জাতির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে।



আজকে যেখানে সাধারন বীমার ভবন সেখানে ছিল “ব্রিটানিয়া” হল। সে সময়ে আজকের মতিঝিল কিন্তু এভাবে গড়ে ওঠেনি, কিছু ন্যাড়া ন্যাড়া ঘড়বাড়ি, দু একটা ক্লাব ঘর, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ঢাকায় কিছু মার্কিন জি আই ডবলু (আমেরিকান সেনাদের এই নামে ডাকা হত) এবং ব্রিটিশ টমি (ব্রিটিশ সেনাদের এই নামে ডাকা হত) সমবেত হয়, তাদের বিনোদনের জন্য রাতারাতি গজিয়ে ওঠে “ব্রিটানিয়া”। সে ছিল এক কিম্ভুত কিমাকার গুদামঘর, তার বসার শ্রীও সে রকম কিছু নড়বড়ে সস্তায় আনা সোফা, চেয়ার। সেখানে তখন দেখানো হত রোনাল্ড কোলম্যানের “ডাবল লাইফ”, এস্থার উইলিয়ামসের “বেদিং বিউটি”, লরেল হার্ডির “এ হান্টিং উই উইল গো”, পিটার উস্তিনভের “সাহারা”, শেক্সপিয়ারের “হ্যামলেট”।



মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার ইসলামপুরে ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লায়ন সিনেমা হল। প্রতিষ্ঠাকালীন এই হলের নাম ছিল ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার। ১৯২০ এর দশকে মির্জা আব্দুল সর্দার নামের এক ব্যক্তির অধীনে চলে যায় এই হল। প্রথম দিকে নাটকের পাশাপাশি সিনেমা দেখানো হলেও ১৯২৭ সাল থেকে শুধুই সিনেমা প্রদর্শন হতে শুরু করে। ১৯৩১ সালে উপমহাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’ প্রদর্শিত হয় এই লায়ন সিনেমা হলে। বিশ শতকের শেষের দিকে সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায়।



নবাবপুর বংশালের তেমাথায় যেখানে “মানসী” (পাকিস্থান আমলে এর নাম বদলে রাখা হয় নিশাত) তিরিশ দশকের শেষ দিকে বালিয়াদির জমিদার পরিবারের উদ্যেগে এই সিনেমা হল তৈরী হয়েছিল। শোনা যায় দেশের নারী চিকিৎসকদের পথিকৃৎ ডাঃ কমলাকুমারীও এই হলের মালিকানার সাথে জড়িত ছিলেন, দিলীপ কুমারের অভিনয় জীবনের প্রথম দিকের সব হিট ছবি মেলা, আরজু, আন্দাজ, নদীয়া কে পাড় এই মানসীতে প্রদর্শিত হয়েছিল।



এখনকার আজাদ সেকালের “মুকুল টকি”। পুরানো ঢাকার কোর্ট কাচারীর উল্টোদিকে। মুলতঃ বাংলা ছবি সেখানে দেখানো হত। মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুল ব্যানার্জি এর প্রতিষ্ঠাতা। এই ভদ্রলোক ঢাকার প্রাচীনতম সিনেমা হল “ঢাকা পিকচার প্যালেস” এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯২৮ সালে। এই হলের শেয়ার কিনেছিলেন ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন, মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের পিতা।



মুকুলের উদ্ভোধনী ছবি ছিল ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় নির্মিত পূর্নাঙ্গ নির্বাক ছবি “দ্যা লাষ্ট কিস”লাষ্ট কিসের নায়িকা ছিলেন লোলিতা, যাকে বাদামতলী পতিতাপল্লী থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর (আমার লেখা ঢাকার বাঈজী কাহিনীতে এর কিছু উল্লেখ্য পাবেন)।তখন ললিতার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। ললিতা ছাড়াও চারুবালা, দেববালা বা দেবী নামের আরও দুই যৌনকর্মী এতে অভিনয় করেন। চারুবালাকে আনা হয় কুমারটুলী পতিতালয় থেকে, আর জিন্দাবাজার লেন থেকে আনা হয় দেববালাকে। রূপমহলে মুক্তি পাওয়ার আগে বাংলাদেশের প্রথম সবাক ছবি মুখ ও মুখোশ এর প্রথম বিশেষ প্রদর্শনীও এই মুকুলহলেই হয়েছিল (৩.৮.১৯৫৬) সকালবেলা।



বাংলাদেশের দ্বিতীয় সিনেমা হল “সিনেমা প্যালেস” সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর দিকে ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কারো মতে, এই হলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রূপলাল দাস, কেউ বলেন ধীরেন দাশ। মালিকানা পরিবর্তনের সূত্রে এই হলের নামকরণ হয় মোতিমহল। আরো পরে মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুল ব্যানার্জীর মালিকানায় চলে গেলে হলের নতুন নাম হয় “রূপমহল”। বোম্বে আর লাহোরের হিন্দী উর্দু আর ভারতীয় বাংলা ছবির দাপটে আব্দুল জব্বার খা পরিচালিত “মুখ ও মুখোশ” দেখাবে না বলে বেকে বসল, তখনই বিদেশী ছবির পরিবেশকদের দাবীর বিপরীতে গিয়ে তখনকার মালিক কমল ব্যানার্জি ( জমিদার মুকুল ব্যানার্জির ছেলে, যার নামে মুকুল হল) এই ছবিটি রূপমহলে প্রদর্শন করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এ কে ফজলুল হক ছবিটির উদ্ভোধন করেছিলেন।



বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হল শাবিস্তান এর পূর্ব নাম ছিল পিকচার হাউজ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লেজার নামক একজন ইংরেজ আরমানিটোলায় প্রতিষ্ঠা করেন এই হল। গ্রেটাগার্বোর একটি ছবি দিয়ে এই সিনেমা হলের যাত্রা শুরু হয়। হারিকেন আর লন্ঠন দিয়ে সিনেমা প্রদর্শন করা হত প্রথম দিকে। প্রতিদিন দুইটি করে ছবি দেখানো হত এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবারে দেখানো হত তিনটি করে সিনেমা। আলাউদ্দিন ও আশ্চর্য প্রদীপ, দ্য কিড, মাই ড্যাডি, মহব্বত এমন সব বিখ্যাত সিনেমা দেখানো হয়েছিল শাবিস্তানে। একুশ শতকের শুরুতে এই হল বন্ধ হয়ে যায়।

যাই হোক এখন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক মীজানুর রহমানের নিউ পিকচার হাউজে সেকালে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা বর্ননা করে এই লেখার শেষ টানি।

ঢাকার প্রথম পেক্ষাগৃহ ছিল ‘নিউ পিকচার হাউস’। এই হলটি প্রধানত সেকেন্ড রান ইংরেজি ছবি দেখাত। আর্মেনিয়ান গির্জার পাশে আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে অবস্থিত এই হলটির গোড়ায় নাম ছিল ‘পিকচার হাউস’। প্রথম মহাযুদ্ধের কোনো এক সময়ে যাত্রা শুরু। লেজার নামে জনৈক ইংরেজ প্রথমে পাটের গুদাম, পরে একে প্রমোদ হলে রূপান্তর করেন। হাত বদল হয়ে উদ্ধভজী ঠাকুর নামে এক মাড়োয়ারি ‘পিকচার হাউস’ নাম দিয়ে দর্শনীর বিনিময়ে গ্রেটা গার্বো অভিনীত একটি ছবি দিয়ে প্রদর্শনী শুরু করেন। এরপর আরও হাতবদল হয়ে রাজেন্দ্রকুমার গুহ ও মতিলাল বসু হলটি কিনে নিয়ে ‘নিউ পিকচার হাউস’ নামকরণ করে। অনেকের মতে, এটাই বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রেক্ষাগৃহ। এখানেই দেখানো হয় সর্বকালের সাড়া জাগানো ছবি অশোক কুমার ও দেবিকা রানী অভিনীত অচ্ছুৎ কন্যা এবং চার্লি চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস



কিন্তু একবার এই হলে একটা ছবি দেখতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা ভোলার নয়। ছবিটার নাম ছিল “কমান্ড ডিসিশান”। আজ আর মনে নেই কারা ছিলেন এর অভিনেতা (কোনো অভিনেত্রী যে ছিলেন না, এটা বেশ মনে আছে)। মার্জারি প্রেম দেখে দেখে চোখ পচে যাচ্ছিল, তাই একটা মারদাঙ্গা ছবি দেখার খাতিরেই যাওয়া আরকি। হলের সামনে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবের পোস্টার দেখে হৃষ্টচিত্তেই ঢুকেছিলুম হলে। কিন্তু বিমানঘাঁটির একটা ঘরে পাঁচ ইয়াংকি বৈমানিকের সংলাপের আর যেন শেষ নেই—শত্রুপক্ষের ঘাঁটি কী করে আক্রমণ করা যাবে, তারই প্ল্যান চলছে মুখে মুখে। কিন্তু বাচালদের কথা আর শেষ হয় না—আধঘন্টা ধরে ওদের প্যাঁচাল শুনে শুনে দর্শকদের প্রাণ অতিষ্ঠ।

এরপর আমার সম্পাদিত রূপছায়া-র ১৯৫৮ সালের ফাইল থেকে অগ্রজ মঈদ-উর-রহমানের সমালোচনা থেকে বাকিটা:

“থার্ড ক্লাস ও ইন্টার ক্লাসের দর্শকবৃন্দ সমস্বরে চীৎকার কোরে উঠলো—’অই অই ...লার পো’রা, কত ওয়া ওয়া করবি? গরের থে’ বাইর অ’ জলদি।’ কী আশ্চর্য! মনে হলো পর্দার অভিনেতারা এদের ধমক শুনলে পেল। পাঁচজন সৈনিক ঘর থেকে নিস্ক্রান্ত হলো। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

“যাক, এবার একটা ফাইটিং-টাইটিং একটা কিছু অবশ্যি হবে। পরের দৃশ্যে দেখা গেল সৈনিক পাঁচজন পাঁচটা বোমারু বিমানে আসমানে চক্কর মারছে। ফ্রন্ট ক্লাসের দর্শকেরা উৎসাহের চোটে তালিয়া বাজিয়ে বলে উঠল, ‘অক্ষণে মাইরপিট অইবো রে! ওই যে ওইটা (ষণ্ডাগুণ্ডা মার্কা একজন অভিনেতা দেখিয়ে) অইল বাহাদুর।’ কিন্তু হা হতোস্মি! আধ মিনিট পরেই অপর এক দৃশ্যে দেখা গেল সৈনিক পাঁচজন কোন ফাঁকে বোমারু বিমান থেকে নেমে আবার সেই ঘরে ম্যাপ নিয়ে প্ল্যান কোরতে বসে গেছে! চললো এরকম আরো কুড়ি মিনিট। ফ্রন্ট রো’র দর্শকেরা গেট কিপারদের উত্তেজিতভাবে জিগ্যেস করলো, ‘ফাইটিন অহে না ক্যাল্লা?’ গেটকিপার ঢোক গিলে বললো—‘এট্টু সবুর করেন না। এই অক্ষণেই অইব।’

তারপরেই ইন্টারভ্যাল।

“ফ্রন্টরোর দর্শকশ্রেণী… গেটকিপার ও ম্যানেজারকে শাসিয়ে বললো, ‘কিবে ফাইটিন অইব কবে? খেলা শ্যাস অইলে?’ ওরা জবাবে বললো, ‘এই হাফটাইমের পরেই অইব।’

“ইন্টারভ্যালের পর ছবি শুরু হলো।

“সেই ঘর। সেই সৈনিক পাঁচজন। সেই ম্যাপ। আর সেই ওয়া ওয়া জাতীয় আলোচনা। আমাদের বারোটা তখন। পয়সা খরচ করে পুটুস পুটুস ছারপোকার কামড় খেয়ে শেষকালে এই ছবি দেখা বরাতে ছিল? ...একটা বিতৃষ্ণার ভাব শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিতে শুরু করেছে, এমন সময় সিনেমা গৃহের চারদিকে থেকে আওয়াজ উঠলো, ‘মার হালারে, ধর ধর!’

“কয়েকটা ঢিল গিয়ে পড়লো পর্দার গায়ে। আসল ফাইটিং শুরু হোয়ে গেলো এতোক্ষণে। আওয়াজ শুরু হলো মড় মড় মড়াৎ। ঠাস ঠুস ঠসাৎ! বুঝলাম, চেয়ারভাঙ্গা পর্ব চোলছে। কতগুলো ছোট ছেলে স্টেজে উঠে “হে ডিং ডিং” কোরে নিজেদের মধ্যে “ফাইটিন” অভিনয় শুরু কোরে দিয়েছে। ফ্রন্টরোর দর্শকদের একদল চেয়ার-দরজা চাঙা ও পর্দা ছেঁড়ার কাজে মত্ত হলো। অপর একদল গেটকিপারদের একজনকে সোয়া পাঁচমণি ঘুঁষাঘুষি মেরে চিৎ পটাং কোরে ম্যানেজার নিধন পর্ব শুরু করার জন্যে ম্যানেজারের কামরার দিকে ধাবিত হলো। তখন ব্যাঁকা-পাওয়ালা এক ম্যানেজার ছিল নিউ পিকচার হাউসে। …বেগতিক দেখে ব্যাঁকা-পাওয়ালা আগে থেকেই টিকিট ঘরে গিয়ে লুকিয়েছে।

ম্যানেজারের তকদির ভাল যে ফাইটিং যখন পুরোদমে চলছে, আর নিজের ওপর আক্রমণ শুরু হবে, ঠিক সেই মুহূর্তে দুই লরী বোঝাই পুলিশ এসে হাজির। সঙ্গে সঙ্গে হুটোপুটি ও লৌরালৌরি!”

এরপর ক্ষতবিক্ষত হলটি পুনরায় মেরামত করে চালু করতে বেশ কয়েক মাস লেগেছিল। পরে হলটি হাতবদল হয়ে চলে যায় মো. মোস্তফা নামের এক চিত্রপরিবেশকের কাছে। তিনি নাম বদলে রাখেন ‘শাবিস্তান’। (এই অভিজ্ঞতা উনার “ঢাকা পুরানে” বর্নিত আছে।

আমাদের ছোট বেলায় “বায়োস্কোপ” নামে এক ধরনের ছবি দেখার বক্স ছিল, সেই বাক্সে একটা গোল চোখ লাগানোর জায়গা থাকত সেখানে চোখ লাগিয়ে আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতাম বিভিন্ন এলাকার ছবি, বায়োস্কোপ ওয়ালা একটা হ্যান্ডেলের ধরে ঘুরাত আর মুখে মুখে ছড়া বলত আর রোল করা অল্প কিছু ফ্লিম সেই হ্যান্ডেলের সাথে ঘুরে যেত চোখের সামনে বড় জোর পাচ মিনিট এমন মুগ্ধ এক রূপ কথার দেশে হারিয়ে যেতাম কিন্তু সেই পাচ মিনিটের রেশ থাকত আর না হলেও পাচ দিন। এখন হাতে রিমোট নিয়ে সেই মুগ্ধতা এক সেকেন্ড যেমন আমি পাই না, এখনকার জমানার মানুষরাও মনে হয় পায় না।



‘আআআ...রে, কী চমৎকার দেখা গেল/ নজর করে দেখো ভালো/ গাঁয়ের বধূ নাইওর এল/ তার পরেতে দেখা গেল/ যমুনায় পানি এল/ কী চমৎকার দেখা গেল/ সরকারবাড়ি ভাইসা গেল/ কুতুব মিনার হেলে গেল/ এই বারেতে দেখেন ভালো/ ঢাকা শহর দেখা গেল/ শেখ মুজিবুর আইসা গেল/ একাত্তরের যুদ্ধ হলো...।’

আমরা আসলে সে সময় বড় অল্পতে সুখী ছিলাম। সুখে থাকা খুব সহজ কাজ না আবার খুব কঠিন কিছুও না।

সিনেমা সংক্রান্ত কয়েকটি পোষ্ট দিয়েছিলাম সামুতে দু একটির লিঙ্ক দিয়ে দিলাম সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন

চলচিত্র ভাষা পেল যাদের হাতে (শেষ পর্ব)

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ব ভিত্তিক চলচিত্রের ইতিহাস

নারী কেন্দ্রিক ছয়টি শ্রেষ্ট বাংলা ছায়াছবি আমার দেখা মতে

বাংলার ইতিহাসে প্রথম নারী অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর কথা

ছবিঃ ইন্টারনেট

কৃতজ্ঞতায়ঃ পোষ্টের মাঝেই উল্লেখ্য করছি যাদের বইর সহায়তায় এই লেখা লিখছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১১:৩৯
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রোএক্টিভিটি এবং কম্পাউন্ড ইফেক্ট: আমার গুরুত্বপূর্ণ দুইটি শিক্ষা

লিখেছেন মাহদী হাসান শিহাব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১১



আমার গুরুত্বপূর্ন দুইটা লার্নিং শেয়ার করি। এই দুইটা টুল মাথায় রাখলে দৈনন্দিন কাজ করা অনেক সহজ হয়। টুল দুইটা কাজ করতে ও কাজ শেষ করতে ম্যাজিক হিসাবে কাজ করে।

এক.

স্টিফেন কোভের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

লিখেছেন সায়েমার ব্লগ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৩

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ
ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

১।
যৌন প্রাকৃতিক, জেন্ডার নয়।জেন্ডার মানুষের সৃষ্টি (social, cultural construction)। যৌনকে বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন সময়ে যেভাবে ডিল করে, তাঁকে ঘিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্মৃতির ঝলক: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি এবং মনের শান্তির খোঁজে

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০১



সরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে একটি ঘূর্ণায়মান পথ জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর অবস্থানে আমি খুব শান্তি অনুভব করি। নদীর জল ছুঁয়ে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে এক আন্তরিক সংযোগ অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×