somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শের শায়রী
অমরত্বের লোভ কখনো আমাকে পায়না। মানব জীবনের নশ্বরতা নিয়েই আমার সুখ। লিখি নিজের জানার আনন্দে, তাতে কেউ যদি পড়ে সেটা অনেক বড় পাওয়া। কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া আর কিছুই নেই।

ঢাকার বাঈজী কাহিনী (তৃতীয় পর্ব)

১৫ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঢাকার বাঈজী কাহিনী (প্রথম পর্ব)
ঢাকার বাঈজী কাহিনী (দ্বিতীয় পর্ব)
বাংলার ইতিহাসে প্রথম নারী অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর কথা

আগের পর্ব গুলো

ঢাকার বাঈজীদের নিয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায় হেকিম হাবিবুর রহমানের লেখায়। এলাহীজান উত্তর ভারত থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। নওয়াব আবদুল গনির কাছ থেকে তিনি নিয়মিত মাসোহারা পেতেন। নবাব সাহেবের কাছ থেকে আরো অনেকে মাসোহারা পেতেন যাদের কথাও হেকিম সাহেব তার লেখায় উল্লেখ্য করেছেন। আন্নু, গান্নু আর নওয়াবীন ছিলেন তিন বোন। এদের মধ্যে সবচেয়ে ডাকসাইটে ছিলেন নওয়াবীন।

এই তিন বোন ১৮৮০ সালে নভেম্বরে ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ ভাড়া করে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে ‘ইন্দ্রসভা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেছেন। ঢাকা প্রাকাশ এর সংবাদ অনুযায়ী মঞ্চস্থ নাটকটিতে শুধু বাঈজীদের অংশ গ্রহনের কারনে অনেকেই এর বিরোধিতা করেন। ঘটনাটি আমাদের মঞ্চ নাটকের জন্য ও খুব গুরুত্বপূর্ন কারন কারন ঢাকায় শুধু মহিলাদের উদ্দ্যেগে মঞ্চনাটক এই প্রথম। ইন্দ্রসভা ছাড়া তারা ‘যাদুনগর’ নামে আর একটি নাটক মঞ্চস্থ করে।

হেকিম হাবিবুর রহমান তার লেখায় আচ্ছি বাঈকে নবাব সাহেবের সব থেকে পেয়ারী বাঈজী বলে উল্লেখ্য করেন। লক্ষৌর এই বাঈজী ছিলেন নৃত্যে সুনিপুনা। হেকিম সাহেবের মতে ঢাকায় এরপরে এত বড় মাপের আর কোন নর্তকী আসেনি। হীরা বাঈজী নাকি নাচে খুব দক্ষ ছিলেন, হীরা বাঈজী যখন নাচতেন তখন তার গায়ের কালো রঙ থেকে নাকি আলো ঠিকরে পড়ত। হীরা বাঈজীর মেয়ে পান্না কিন্তু গজল গেয়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল।



আমীরজান বাঈজী আর রাজলক্ষী বাঈজীর কথা লিখতে গেলে ঢাকার পানীয় জল সরবরাহের কথা লিখতে হয়। ১৮৭০ এর দশকে ঢাকায় পানিয় জলসরবরাহের নিমিত্তে নবাব আবদুল গনি গন্যমান্যদের নিয়ে একটি সভা ডাকেন। আমন্ত্রন জানানো হয় রাজলক্ষী আর আমীরজান কে। সে সভায় সব বড় বড় জমিদারদের আহ্বান জানান সবাই যেন কিছু কিছু দিয়ে সাহায্য করে।

ওই বৈঠকে আমীরজান আর রাজলক্ষী টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিল আর কোন নবাব বা জমিদার কিন্তু কোন সাহায্য প্রস্তাব দেয়নি। নবাব গনি সে সাহায্য না নিয়ে পুরো প্রকল্পের ব্যায়ভার নিজের কাধে তুলে নেন। রাজলক্ষী ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত জিন্দাবাহার গলির মুখে কালী মন্দির সংস্কার করেছিলেন।

সত্যেন সেনের লেখায় মালকাজান সন্মন্ধ্যে জানা যায়। মালকাজান মুজরো করতে ঢাকা আসতেন। সে সময় তিনজন মালকাজান ছিলেন। আগ্রাওয়ালী মালকাজান, বেনারসের চুলবুলিয়া মালকাজান ও ভাগলপুরী মালকাজান, উপমহাদেশের বিখ্যাত বাঈজী গওহরজান ছিলেন বেনারসের চুলবুলিয়া বা বড় মালকাজানের কন্যা। অসামান্য রূপসী মালকাজানের পূর্ব নাম ছিল লেডী এডেলাইন। আর্মেনিয়ান ঈহুদী। স্বামী রবার্ট ইঊয়ার্ডের সাথে বিচ্ছেদ হলে পরে এডেলাইন বাঈজী বৃত্তি গ্রহন করে।

এরপর ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে নিজের নাম রাখেন মালকাজান আর মেয়ে এঞ্জেলিনার নাম রাখেন গওহরজান। আধুনিক নায়িকাদের মত সেকালে মালকাজানের ছবি অধিকাংশ ঘরেই টানান থাকত, এত ছিল তার রূপ। মালকাজানের কিছু রেকর্ড বের হয়ে ছিল। ভারতের বাঈজী মহলে গওহরজান কিন্তু সম্রাজ্ঞীর আসন করেছিলেন। একে ছিলেন অসামান্য সুন্দরী তায় গুনী শিল্পী। ১৯০২ সালে তার গাওয়া গানের রেকর্ড বের হয়। এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত পোষ্ট দেব। সৈয়দ মুহান্মদ তৈফুর ১৮৯০ এর দশকে ঢাকার কালীবাড়ীর এক বিয়েতে তাকে নাচতে আর গাইতে দেখেছেন।

গওহরজান ছিলেন ভীষন শৌখিন আর ফ্যাশন সচেতন। নিজেকে সব সময়ই সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করতেন। বস্তুত গওহরজানের হাত ধরেই কিন্তু শিল্পীদের ফ্যাশন সচেতনতা এ দেশে শুরু হয়। তার গানের রেকর্ড ছিল বেশ উল্লেখ্যযোগ্য। তিনি কিছু গানও রচনা করেছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের গুরু ওস্তাদ জমির উদ্দিন কিন্তু গওহর জানের শিষ্য ছিল।



গওহরজানের মা মালকাজানের সৎবোন ছিল জদ্দন বাঈ। জদ্দনের মা ইসলাম গ্রহন করে আর জীবিকার কারনে মেয়েকে বাঈ হিসাবে তৈরী করে। জদ্দন বাঈ বেশ কয়েক বার বিয়ে করেন। জদ্দন বাঈ ঢাকার বিভিন্ন মেহফিল মাতিয়ে রাখতেন। তিনি ঢাকার নবাব এর ঘনিষ্ট সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বলেও জানা যায়। জদ্দনের শেষ স্বামী উত্তম চাদ মোহন জদ্দনের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে মুসলমান হন আর তাকে বিয়ে করেন। মোহন নিজের নাম রাখেন আবদূর রশীদ।



মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এ বিয়েতে সাক্ষী হন। জদ্দন বাঈজী পেশা ছেড়ে চলচিত্রের সাথে যুক্ত হন। রশীদ আর জদ্দানের ঘরে জন্ম নেন নার্গিস। এই সেই নার্গিস ভারতের চিত্র জগতে তিনি কিংবদন্তী তুল্য মর্যাদা পেয়েছেন। সে যুগের সেই সব বাঈজীরা কিন্তু শিক্ষিত নারীদের চলচিত্রে আসার পথ খুলে দিয়েছিলেন। বলা যায় বাঈজীদের ঘর থেকেই মেয়েরা প্রথম অভিনয়ের পথে আসেন।



১৮৭৩ সালে কলকাতার মেয়েরা যখন যখন রঙ্গমঞ্চে আসার অনুমতি পেলেন, তখন নিষিদ্ধ পল্লীর সংগীতে পারদর্শীরাই কিন্তু মঞ্চে এসেছিল। তখন থেকে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক পর্যন্ত কিন্তু সমস্ত অভিনেত্রীরাই সুগায়িকা ছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিনোদিনী, তিনকড়ি, তারাসুন্দরী থেকে বিংশ শতাব্দীর আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা পর্যন্ত অনেকেরই নাম করা যায়। কানন দেবী এখনো অনেকের ই প্রিয়। আমারো কিন্তু কানন দেবীর গান ভাল লাগে। তিনি কিন্তু সুঅভিনেত্রী ও ছিলেন।



ঢাকার প্রথম পূর্নাঙ্গ নির্বাক চলচিত্র ছিল ‘দ্য লাষ্ট কিস’ এর নায়িকা ছিল লোলিতা তাকে বাদামতলীর নিষিদ্ধ পল্লী থেকে নিয়ে আসা হয়। তার আসল নাম ছিল বুড়ী। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। ছবির কাজ শেষে বুড়ী আবার পুরানো পেশায় ফিরে যায় এর বেশি কিন্তু লোলিতার সন্মন্ধ্যে জানা যায় না। মঞ্চে তাদের অভিনয় করানোর জন্য অনেক পত্র পত্রিকায় জোর প্রতিবাদ জানানো হয়। তাদের সঙ্গে যে এক মঞ্চে উপবেশন করাই অসন্মানের। দ্যা লাষ্ট কিসের সহ নায়িকা চারুবালাকে আনা হয় কুমারটুলী পতিতালয় থেকে জিন্দাবাহার লেন থেকে আনা হয় দেববালাকে।

কৃতজ্ঞতাঃ হেকিম হাবিবুর রহমান, ডঃ মুনতাসির মামুন, শামীম আমিনুর রহমান, ইন্টারনেট।

সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৯:০৭
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রোএক্টিভিটি এবং কম্পাউন্ড ইফেক্ট: আমার গুরুত্বপূর্ণ দুইটি শিক্ষা

লিখেছেন মাহদী হাসান শিহাব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১১



আমার গুরুত্বপূর্ন দুইটা লার্নিং শেয়ার করি। এই দুইটা টুল মাথায় রাখলে দৈনন্দিন কাজ করা অনেক সহজ হয়। টুল দুইটা কাজ করতে ও কাজ শেষ করতে ম্যাজিক হিসাবে কাজ করে।

এক.

স্টিফেন কোভের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

লিখেছেন সায়েমার ব্লগ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৩

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ
ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

১।
যৌন প্রাকৃতিক, জেন্ডার নয়।জেন্ডার মানুষের সৃষ্টি (social, cultural construction)। যৌনকে বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন সময়ে যেভাবে ডিল করে, তাঁকে ঘিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্মৃতির ঝলক: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি এবং মনের শান্তির খোঁজে

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০১



সরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে একটি ঘূর্ণায়মান পথ জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর অবস্থানে আমি খুব শান্তি অনুভব করি। নদীর জল ছুঁয়ে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে এক আন্তরিক সংযোগ অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×