somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভজটেকঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক পোলিশ যোদ্ধা ভালুকের কাহিনী

১০ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১০:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা। সময় ১৯৪২ সালের ৮ ই এপ্রিল। স্থান হামাদান রেলওয়ে ষ্টেশন ইরান। সবেমাত্র সোভিয়েট জেনারেল ভ্লাদিস্লাভ এ্যান্ডার্সের এর অধীনে এ্যান্ডার্স আর্মি গঠিত হয়েছে মুলতঃ পোলিশ সেনাদের নিয়ে। এই এ্যান্ডার্স আর্মি ইরানের উদ্দেশ্যে হামাদান রেলওয়ে ষ্টেশনে পৌছে সাথে কয়েক হাজার পোলিশ উদ্ধাস্তু যারা ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ডে জার্মান হামলার সময় সোভিয়েট ইউনিয়নে পালিয়ে গিয়েছিল। উদ্দেশ্য ওখান থেকে ইতালিতে মিত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে যাওয়া। সদ্য ইরানে পৌছানো পোলিশ উদ্ধাস্তু এবং সেনারা রেল ষ্টেশনের কাছে এক কুর্দী বালকের কাছে পুতুলের মত একটা ভালুক ছানা দেখতে পায় যার মাকে হয়ত শিকারীরা গুলি করে মেরে ফেলছে।



এই পোলিশ উদ্ধাস্তুদের মাঝে ছিল পোলিশ জেনারেল লুগোজোস্কির ভাইর নাতনী আঠারো বছর বয়স্ক ইরিনা বোকিউজ। সে লেফটেন্যান্ট আনাতোলি তারনোস্কিকে অনুরোধ করে যেন ভালুকের ছানাটা সে ওই কুর্দী বালকের কাছ থেকে কিনে নেয়, না হলে হয়ত ভালুক ছানাটা না খেতে পেয়ে মারা যাবে। লেফটেন্যান্ট আনাতোলি কুর্দী বালকটির কাছ থেকে ভালুক ছানাটি কয়েক টিন মাংস, কিছু ইরানিয়ান টাকা, একটা সুইস নাইফ এবং কিছু চকলেটের বিনিময়ে কিনে নেয় এবং ইরিনার তত্ত্বাবধানে দিয়ে দেয়। পোলিশ সেনারা হামদান শহরের বাইরে উদ্ধাস্তু ক্যাম্প স্থাপন করা হয় সেখানে ইরিনার তত্ত্বাবধানে ভালুক ছানাটি তিন মাস থাকে। এর পর ইরিনা এই ভালুক ছানাটিকে আগষ্টে পোলিশ আর্মির দ্বিতীয় ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীকে দিয়ে দেয়। পরে এই দ্বিতীয় ট্রান্সপোর্ট কোম্পানী ২২ তম আর্টিলারি সাপ্লাই কোম্পানী নামে পরিচিত হয়। শুরু হয় ভালুক ছানাটির নতুন জীবন। ভজটেক সিরীয় বাদামি রঙের ভালুক।



পরিবার পরিজনহীন সৈন্যদের মাঝে ভালুক ছানাটি একটি শিশুর আদর পেতে শুরু করল। আদর করে নাম দিল “ভজটেক”। বাংলায় যার মানে দাড়ায় “হাস্যজ্জ্বোল যোদ্ধা”। সমস্যা হলো ভজটেকের বয়স মাত্র কয়েক মাস, এ বয়সের ভালুক মায়ের বুকের দুধই খায়। সেনারা ভজটেককে ভদকার ( রাশিয়ার তৈরি মদের নাম ) বোতলে কনডেন্সড মিল্ক খাওয়াতে শুরু করেন। এমনকি সে বিয়ারও পান করতে শিখে যায়। তবে তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল সিগারেট। এরপর ভজটেক মারমালেড, মধু, নানা ফল খেতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে।



সৈনিকদের সাথে ভজটেকের জীবন হেসে খেলে চলছিলো। সৈন্যদের সাথে সে কুস্তি লড়ত কিন্তু একটু বড় হবার পর ভজটেক খেয়াল রাখত তার সাথে কুস্তি লড়াই করা সৈন্য যেন ব্যাথা না পায়। কেউ যদি ব্যাথা পাবার অভিনয় করত তবে ভজটেক তার কাছে গিয়ে মাফ চেয়ে আসত। সাগরে সৈন্যদের সাথে গোসল করা থেকে শুরু করে তাদের সাথে মার্চ পাষ্টেও হেলেদুলে অংশ নিত। সৈন্যদের সাথে একই সাথে ঘুমাত। মুল ব্যাপার হল ভজটেক ২২ তম আর্টিলারি সাপ্লাই কোম্পানীর একজন সৈন্য হিসাবে অন্য সৈন্যদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে নিজেকে মানিয়ে নিল।



ইতিমধ্যে ২২ তম কোম্পানী মিশরে ট্রান্সফার হল, স্বাভাবিক ভাবেই ভজটেকও তাদের সাথে মিশর গেল। এতদিন ভজটেক সৈন্য হিসাবে না একজন সিভিলিয়ান (!) হিসাবেই সৈন্যদের সাথে ছিল, যদিও তার চাল চলন আচার আচরন কোন সৈন্যর থেকে কম ছিল না। কিন্তু ঝামেলা বাধল যখন এই ২২ তম আর্টিলারি সাপ্লাই কোম্পানীকে ১৯৪৪ সালে ইতালীতে পাঠান হবে বলে ডিসিশান হল। এবং ইতালীতে তারা ব্রিটিশ এইটথ আর্মির সাথে জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। পোলিশ বাহিনী ব্রিটিশ জাহাজে করে মিশর থেকে ইতালী যাবে।



ওদিকে ব্রিটিশ রুলস অনুযায়ী কোন পোষা প্রানী বা মাসকাটকে তাদের কোন যানবাহনে বহন করা নিষেধ। এদিকে পোলিশ ২২ তম সাপ্লাই কোম্পানীর কাছে ভজটেক পোষা প্রানীর থেকে বেশি কিছু ছিল, হয়ত কারো সন্তান বা কারো ভাই। তারা ভজটেককে ছাড়া যাবে না, প্ল্যান করতে বসল কিভাবে ব্রিটিশ নিয়মকে ফাকি দেয়া যায়, বুদ্ধিও বের হয়ে গেল। ভজটেক কে পোলিশ আর্মিতে “প্রাইভেট” (সাধারন সৈন্যদের ইংরেজীতে প্রাইভেট হিসাবে ডাকা হয়) হিসাবে অফিশিয়ালি নিয়োগ দেয়া হল। মানে ২২ তম আর্টিলারী সাপ্লাই কোম্পানীর আর দশটা পোলিশ সেনার সাথে ভজটেকও একজন পোলিশ সেনা হিসাবে গন্য হল। যেহেতু ২২ তম কোম্পানী ইটালী যাচ্ছে তাই প্রাইভেট ভজটেকও তাদের সাথে যাবে। ভজটেকের জাহাজে উঠতে আর কোন বাধা থাকল না।



১৯৪৪ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী ইতালীতে ব্যাটল অব মন্টিক্যাসিনো শুরু হয়। ভয়ংকর যুদ্ধ ছিল এই ব্যাটেল অভ মন্টিক্যাসিনো। মিত্র বাহিনী এখানে প্রায় তাদের পচাত্তর হাজার সৈন্য হারায়। ২২ তম আর্টিলারি সাপ্লাই কোম্পানীর ওপর দায়িত্ব ছিল ট্রাক থেকে আর্টিলারী শেল নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ইনফ্যান্ট্রিকে পৌছে দেয়া। প্রায় ২০০ কেজি ওজনের ভজটেক একাই ৪ টা শেলের এক এক বাক্স যার ওজন ছিল ১০০ পাউন্ড বয়ে নিয়ে যেত। স্বাভাবিক ভাবে যা বয়ে নিতে অন্ততঃ চার জন সৈন্যর দরকার হত। নিজের কাজে ভজটেক এতটাই পারদর্শী ছিল যে জীবনে কোন দিন তার হাত দিয়ে কোন বাক্স পড়ে যায়নি এই আনা নেয়ার মাঝে বা গোলাগুলির শব্দে।



৯৩ বছরে পা দেয়া পোলিশ সেনা উজসিয়েক নারেবস্কি ভজটেকের সাথে আড়াই বছর কাটিয়েছেন। তিনি বলেন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভজটেক তাদেরই একজনে পরিণত হয়। পোল্যান্ড সেনাবাহিনীর এই সাবেক প্রবীণ সেনা তার স্মৃতি চারনে বলেন বলেন, "ও অনেক শক্তিশালী ছিল, যেখানে এক বক্স অস্ত্র বহনে ৪ জন সেনা হাপিয়ে উঠত সেখানে ও একাই তা মাথায় উঠিয়ে ফেলত। আমাদের কাজ করতে দেখলেই ও নিজে থেকে এসে আমাদের সাহায্য করত।"



যুদ্ধকালীন সময়ে ভজটেক মিত্র বাহিনীর কাছে এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে যুদ্ধ শেষ হবার আগেই ২২ তম আর্টিলারি সাপ্লাই কোম্পানী তাদের লোগোতে পরিবর্তন আনে। সেখানে তারা লোগো হিসাবে ব্যাবহার করা শুরু করে একটা ভালুকের ছবি যা একটা মর্টার শেল বহন করে নিচ্ছে। যুদ্ধ শেষে ভজটেক কর্পোরাল পদে উন্নীত হয়।



১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষে ২২ তম আর্টিলারি সাপ্লাই কোম্পানীকে স্কটল্যান্ডের হুটন নামের গ্রামের কাছে পাঠানো হয় স্বাভাবিক ভাবেই ভজটেকও তাদের সাথে যায়। স্বভাব অনুযায়ী স্থানীয় মানুষদের সাথেও ভজটেক মিশে যায় তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট অনুযায়ী। সাধারন মানুষ এবং প্রেস ভজটেককে ভালোবেসে ফেলে। স্থানীয়দের মাঝে সে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পোলিশ-স্কটিশ এসোসিয়েশন ভজটেককে তাদের সন্মানিক সদস্যপদে বরণ করে। এরপর তাকে ১৯৪৭ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়। এখানে প্রায়ই তার সাথের সাবেক পোলিশ এবং ব্রিটিশ সেনারা দেখা করতে আসত এবং বন্ধুর মত এক সাথে বিয়ার খেতে খেতে কিছু সময় পার করত। এখানেই ১৯৬৩ সালের ২ ডিসেম্বর ২১ বছর বয়সে ভজটেকের জীবনাবসান ঘটে।



ভজটেক নামের ভালুক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে এই গ্রহে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টিতে একদিন অবদান রেখেছিল। ভজটেক শান্তির প্রতীক। ভজটেকের মর্মর মূর্তিও স্থাপিত রয়েছে “এডিনবার্গ প্রিন্সেস ষ্ট্রীট গার্ডেনে”। ভজটেকের স্মৃতি জাগরূক রয়েছে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের অন্তরে, ওয়েবসাইট ও পোল্যান্ডের সেনানিবাসের ২২ নম্বর ব্যাটেলিয়নের সদর তোরণে ও সেনাদের উর্দিতে। ভজটেকের এই কাহিনি বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে “আ বিয়ার নেমড ভজটেক” নামে তৈরী হয়েছে এনিমেশান সিনেমাও।

ইউটিউবে ভজটেককে নিয়ে তার সাবেক পোলিশ সহযোদ্ধা উজসিয়েক নারেবস্কি এই স্মৃতি চারনটি অবশ্যই আপনার ভালো লাগবে কথা দিলাম।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১১:৩৬
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×