আমার ছোটবেলায় আমার চার নাম্বার খালার বিয়ে কথা আমার মনে আছে, বয়স কত হবে আর ৭/৮ বছর। গ্রামের বিয়ে। গ্রাম অনুযায়ী আমার নানা বাড়ী কিছুটা বিত্তের অধিকারী বলেই আমার মনে হয় কারন আমার মার জন্মের আগে থেকেই নানা বাড়ী পোড়ানো ইটের দালান বাড়ী। খালার বিয়ের সময় আমরা খুব একটা পাত্তা পেতাম না অতি ছোট বিধায় কিন্তু ছোট খালা বা মামারা সে শুধু আপন মামা না, এলাকার যত মানুষ আছে সবাই আমার নানা বাড়ীকে সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে উঠল। কলা গাছ কাটা হল। সে কলা গাছ গুলো খাল পাড় ( ছোট শাখা নদীকে স্থানীয় ভাবে খাল বলে তাও এখনকার বুড়ীগঙ্গা নদীর যেখানে লঞ্চ ঘাট তার কাছাকাছি চওড়া) থেকে প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত সাড়ি বদ্ধভাবে লাগানো হল আর সে কলা গাছ গুলোকে বিভিন্ন রংয়ের কাগজ কেটে নানা রকম নক্সা করে সাজানো হল।
কিছু দূর পর পর হ্যাজাক লাইটের আলোয় পুরা বাড়ী যেন গ্রামের অন্ধকার ভেদ করে এক টুকরো মায়াবী সাজে সজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। হ্যাজাক লাইট বোধ হয় এই প্রজন্মের অনেকেই দেখে নি। অনেকটা বড় হ্যারিকেনের মত ভেতরে হ্যারিকেনের সলতের বদলে থাকত ম্যান্টেল। সে হ্যাজাক লাইট আবার পাম্প করে ম্যান্টেলের উজ্বলতা বাড়ানো যেত। আমার বয়সী এক গাদা মামাতো খালাতো ভাইর ক্যাচ ম্যাচে বিভিন্ন রকম আনন্দে বড়দের ধমক আমাদের বাড়তি উৎসাহ জোগাত।
সন্ধ্যার মাগরিবের আযানের পর পর ছয় সাতটা নৌকা নিয়ে বড় যাত্রীরা চলে আসল। সামনের নৌকাতে আবার মাইক বাজছিলো “সাইয়া দিলে আনারে, আখি ......” বড়দের নীরব চোখ ইশারায় আমরা যেয়ে স্কুলে যেখানে বর সহ বরযাত্রীদের বসানোর আয়োজন করা হয়েছে সেখানে ফ্লোরে বিছানো তোষকের ওপর শুয়ে পড়লাম এবং সবার চোখ বন্ধ মানে ঘুমিয়ে পড়ার অভিনয়। মানে বরযাত্রীদের বসার স্থান আমরা দখল করে ফেললাম। আমাদের মুরুব্বীরা যত ডাকে আমরা সাড়া দিচ্ছিলাম না পরে বর যাত্রীদের কাছ থেকে আমার ছোট মামারা কিছু টাকা নিয়ে আমাদের উঠে পড়ার ইঙ্গিত দিলে বিছানা ছেড়ে সরে পড়লাম। খুব সম্ভবতঃ এরই আধুনিক ভার্সান গেট ধরা।
মাঝ রাত আবধি খানা পিনা করে বর (খালু) যখন নতুন নববধু ( আমার ৪ নাম্বার খালা) নিয়ে তার গ্রামের বাড়ীর দিকে রওনা দিল তখন মামারা সহ বাড়ীর মানুষ জন তা কমপক্ষে ৮০/৯০ জন পুরুষ প্রায় দেড় মাইল পথ পেরিয়ে বড় নদী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসল। পালকিতে উঠে খাল ঘাট পর্যন্ত যাবার সময় আমার খালা কাদতে কাদতে ফিট হয়ে যাবার দশা, সাথে নানু সহ তার অন্যান্য বোনরাও সেকি কান্না, একালে কেউ মারা গেলেও ওভাবে কাদে না। মনে হয় যেন অকুল সাগরে ফেলে দেয়া হচ্ছে। সেকালে বিয়ে ছিল এমনিই। অপ্রাসাঙ্গিক ভাবে জানিয়ে রাখি আমার সে খালা আর খালু দুজনই বেশ কিছু দিন আগে মারা গেছে।
নিজের বিয়ে কিভাবে হয়েছে, সেটা এখনো আমার কাছে ধোঁয়াশা, চাকুরী পাবার বছর দুই পর মা এক দিন বলল তোর জন্য মেয়ে দেখতে যাব চল, আমিও সুবোধ বালকের মত মায়ের সাথে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে মেয়ে দেখতে গেলাম। মেয়ে দেখেই মায়ের পছন্দ আমি জীবনেও দেখিনি যদিও একই মফঃস্বল শহরে বাস কিন্তু ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার পর আমি ঢাকা চলে আসি পড়াশুনার জন্য তাই না দেখাটাই স্বাভাবিক। আম্মা মেয়ের হাতে আংটি আর চেইন পড়িয়ে পাকা কথা দিয়ে আসে এবং কিভাবে কিভাবে যেন মসজিদে আখত হয়ে বিয়ে হয়ে গেল, উঠে দাড়িয়ে মুরুব্বীদের সালাম দিলাম এর পর সামান্য মিষ্টান্ন। দুমাস পরে অবশ্য অনুষ্ঠান করে বিয়ে বৌভাত করে পুরো বিয়েটা অতি সাধারন ভাবেই সম্পন্ন হয়ে গেল। আমার সন্তানদের মাকেও যথারীতি কান্না কাটির মাঝে আমার বাসায় নিয়ে আসলাম। বাসায় ঢোকার সময় আম্মার একটা পরিস্কার শাড়ি বিছিয়ে দেয়া হল তার ওপর দিয়ে নতুন বউ খালি পায়ে ঘরে ঢুকল। আম্মা এবং মুরুব্বীরা বরন করে নিল।
ইদানিং ভাইগনা, ভাগনি, শালা, শালি অথবা অন্যান্য কিছু আত্মীয় স্বজনের বিয়েতে যেতে হচ্ছে ঢাকায়। দেখলাম পুরো বিয়ের সিষ্টেমই চেঞ্জ হয়ে গেছে। গায়ে হলুদ নামে যে ব্যাপারটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেখানে কোন কম্যুনিটি সেন্টার ভাড়া হচ্ছে। সে কম্যুনিটি সেন্টারে আবার ডিজে নামক অদ্ভুত এক ছেলে সাউন্ড সিষ্টেম নামক কি সব জিনিস পত্র নিয়ে বসে থাকে যাতে থাকে বেশ কিছু "নব" বা সুইচ (অন্য কোন নামও থাকতে পারে আমি জানি না ) যা দ্ধারা গানের (মুলতঃ হিন্দী গানের) সাউন্ডকে উপর নীচ কিসব করে আর নিজে তালে তালে নাচতে থাকে।
বর কনেও এক পর্যায়ে নাচতে শুরু করে অবশ্য তার আগে ইয়াং পোলাপান তারাও বেশ কয়েকটা হিন্দী গানের সাথে হিন্দী নায়ক নায়িকার অনুকরনে নাচে। যা কয়েকদিন ধরে প্রাকটিস করে আয়ত্ব করে। এখানে গায়ে হলুদ নামে যে ব্যাপারটা থাকে সেটাও খুব সাবধানের সাথে করা হয় যেন কনের মেকাপ নষ্ট না হয়ে যায়। মুলতঃ গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানটি এখন দেখি হিন্দি গানের সাথে নাচের একটা অনুষ্ঠানে পরিনত হয়েছে, যেখানে গায়ে হলুদ খুবই গৌন ব্যাপার। আর সাথে থাকে ৪০/৫০ হাজার টাকা দামের ক্যামেরা ম্যান। তারাই মুলতঃ পুরা অনুষ্ঠানে মুখ্য ভুমিকা রাখে প্রতি মিনিটের ছবি তুলে। যেন ছবি তোলাটাই মুখ্য। কে যানে এটাই বোধ হয় নিয়ম। তবে যে ব্যাপারটা ভালো লাগে সেটা হচ্ছে গায়ে হলুদের দাওয়াত মানে আমি একটা পাঞ্জাবী আর বউ একটা শাড়ি পায়, খারাপ না। বিনে পয়সায় পাঞ্জাবী আর শাড়ি, গায়ে হলুদে সবাই এক কালারের শাড়ি পাঞ্জাবী পড়তে হয়। মনে হয় যেন হিন্দী ছবির ব্যার্থ অনুকরনীয় শুটিং চলছে।
এখন আর বিয়ে বৌভাত টা অনেকেই দেখি রিসেপশান নামে চালিয়ে দেয় মানে উভয় পক্ষ এক হয়ে…………… মেয়ে হাসতে হাসতে বরের গাড়ীতে ওঠে কান্না কাটির কোন প্রশ্নই ওঠে না…………
আরো কিছু বর্ননা দিয়ে ঘটনা সাজিয়ে রাখছিলাম যা লিখব করে প্রস্ততি ছিল। আরো ঘন্টা দেড়েক লাগত। কিন্তু কো ইন্সিডেন্স বলে একটা ব্যাপার আছে……… যা আমার জীবনে মাঝে মাঝে ঘটে এবং ঘটে গেল এই মাত্র……. গিন্নীর রনরঙ্গিনী মুর্তি। এটা অবশ্য নতুন কিছু না আমার মত অবলা স্বামীর জন্য…………
“তোমার কি কোন দিন হুশ হবে না? বাজে কয়টা”
“কেন খুব বেশী তো না মাত্র দুইটা” আমি নিরীহ ভাবে উত্তর দেই।
“প্রতিদিন রাত তিনটা চারটা পর্যন্ত বসে বাসে নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ না আইনষ্টাইন হও আমার কিছু যায় আসে না, তাই বলে আজকেও তোমার যত্তসব ফালতু লেখা লিখতে হবে?” ফুসতে ফুসতে গিন্নীর রাগে লাল হওয়া চেহারা।
“কেন আজকে কি হয়েছে” আমি আসলেই জানি না আজকে কি এমন ঘটনা ঘটেছে যে লিখতে পারব না?
“ও ভুলে গেছ, সে আর নতুন কি প্রতিবারই তুমি ভুলে যাও, আমি মনে করেছিলাম এইবার অন্তত কিছু একটা সারপ্রাইজ দেবা। যদিও প্রতিবারই ভাবি কিন্তু কোনবারই তোমার মনে থাকে না…………… ক্যাচ ম্যাচ……… হাউ কাউ……… তোমার শালা শালী রাত বারোটায় আমার ফোনে ফোন দিয়ে তোমাকে পায় নাই তুমি বাইরে ছিলা, আজকে তোমার বিবাহ বার্ষিকী………… আমি বলে দিছি তোমাকে যেন ফোন না দেয়……… ক্যাচ ম্যাচ……… ফোস ফাস…………
আমি কি করব বলেন? আমার এই সব এক দম মনে থাকে না। কেন যেন জন্ম দিন বিবাহ বার্ষিকী ফার্ষিকী কিছুই মনে রাখতে পারি না। পরিস্থিতি খারাপ। অবাক হয়ে আজকের লেখার দিকে তাকালাম, পোষ্টের বিষয় বস্তু বিয়ে, অথচ আমার খেয়ালি ছিল না আজকে আমি অনেক বছর আগে এই সদ্য যুবতীকে বিয়ে করছিলাম কলেমা পড়ে। একেই বলে কো ইন্সিডেন্স কোন এক জরুরী কারনে আমি বাসায় ফিরছি রাত সাড়ে বারোটায় খেয়ে দেয়ে লিখতে বসছি অবশ্য তার আগে এই পোষ্টের কিছু লিখে গিয়েছিলাম……… না পোষ্ট টা শেষ করা যাবে না। গৃহ যুদ্ধে শুরু হবে তাহলে, যদিও একতরফা।
আমারো দোষ আছে, কেন জানি কোন দিন বউকে মুখ ফুটে বলতে পারি নি তোমাকে আর আমার মাকে আমার জীবনের থেকে বেশী ভালোবাসি। আচ্ছা মুখ দিয়ে বললেই কি ভালোবাসা প্রকাশ পায়? হয়ত পায়, কিন্তু আমি যে পুরানো যুগের মানুষ! কেন যেন আপন মানুষ গুলোকেই আমি বেশী কষ্ট দেই নানা কারনে। অথচ নিজে অনুভব করি কি এক মমতায় তাদের সারাক্ষন জড়িয়ে রাখতে চাই।
পোষ্ট অসমাপ্ত রেখেই উঠতে হল। দুঃখিত।
ছবি গুলো নেট থেকে সংগৃহিত
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০২০ রাত ২:৩৯