somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঠগীঃ ইতিহাসের সব থেকে ভয়াবহ নিষ্ঠুর ধর্মীয় সম্প্রদায়

০৯ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সময়টা ১৯ শতকের প্রথমদিক, এই ধরুন ১৮৩৪ সাল বহরম জমাদারের নেতৃত্বে প্রায় ৭০/৮০ জন মানুষ ঝাসী, ভিলা, রেলি হয়ে ভুপালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অনেকটা তীর্থযাত্রীর মত। দলটা ভুপালে ঢুকল না, ভুপালকে পাশে রেখে চিপানেরেতে নর্মদা নদী পার হয়ে একটা বড় গাছ তলায় বিশ্রাম নিচ্ছিল। অদুরেই ১৭ জনের ভুপালীয় ব্যাবসায়ী তাদের ব্যাবসার কাজে ভুপাল থেকে বের হয়েছে। কথায় কথায় দুই দলের মাঝে অন্তরঙ্গতা জমে উঠল। এক পর্যায়ে ভুপালের ব্যাবসায়ী দল আবিস্কার করল তারা যেদিকে ব্যাবসার জন্য যাচ্ছে বহরম জমাদারের নেতৃত্বে ওই ৭০/৮০ জন একই দিকে যাচ্ছে, ঠিক হল দুই দল একই সাথে যাবে।



নির্দিষ্ট স্থানে পৌছাতে প্রায় তিন দিন লাগবে, এর মাঝে প্রথম রাতে উভয় পক্ষ যার যার খাবার একে অপরকে দিয়ে খেল, এদিকে বহরম জমাদারের দলের একজন দারুন গান গায়, খাওয়া দাওয়ার পর সে গলা ছেড়ে গান ধরল। আকাশে বিরাট চাঁদ উঠছে। সবাই মগ্ন হয়ে গান শুনে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ল, পরদিন যথারীতি সারা দিন যাত্রা করে সন্ধ্যায় এক বিরাট বাগানের কাছে সবাই যাত্রা বিরতি করল, এর মাঝে উভয় দল উভয় দলের হাড়ির খবর, পরিবারের সুখ দুঃখের সব খবর নিয়ে নিয়েছে। ঘনিষ্টতা তখন অন্তরঙ্গতায় পর্যবসিত। সন্ধ্যায় খেয়ে দেয়ে ভুপালের ব্যাবসায়ীরা আবার যখন গানে মগ্ন হতে যাচ্ছে বহরম অনুচ্চ কন্ঠে পাশের জনকে আদেশ দিল “চুকা দেনা”। গান চলছে। প্রতি জন ব্যাবসায়ীর দুই পাশে বহরমের দুই জন এবং পেছনে একজন বসে পড়ল গানের তালে তালে মাথা দোলাতে দোলাতে। বহরম আবার হাল্কা গলায় পাশের জনকে বলল “পান কা রুমাল লেও!” ব্যাবসায়ীরা ভাবল হয়ত পানের রুমাল চাওয়া হচ্ছে পান খাবে। এর কিছুক্ষন পরই জমাদার বহরমের মুখ দিয়ে শেষ আদেশ যাকে “ঝিরনী দেয়া” বলা হয়, উচ্চারিত হল “তামাকু লেও!”



বলতে যেটুকু দেরী প্রতিটা ব্যাবসায়ীর দুই পাশে বসা দুই জন নিখুত ভঙ্গিমায় একজন হাত আর একজন পা চেপে ধরল। যে হাত বা পা চেপে ধরল তাকে বলে “চুমোসিয়া” বা “সামসিয়া” বাকী জন হলুদ এক টুকরা রুমাল যা একভাজ দিলে সর্বোচ্চ ত্রিশ ইঞ্চি লম্বা হবে এক পাশে একটা রূপার পয়সা গিঠ দেয়া, সেটা শিকারের গলায় পেচিয়ে দু’দিক দিয়ে সর্বশক্তিতে টেনে চলল। কয়েক মুহুর্তে মানুষটি নিস্তেজ হয়ে গেল। গলায় যে রুমাল পেচায় তাকে বলা হয় “ভুকুত”। ভুকুত আস্তে করে বলে ওঠে “বাজিত খান” মানে কাজ শেষ। জমাদার বহরম খা এইবার হাক দিল “এই বিচালী দেখ” মানে মৃতদেহ গুলোর ব্যাবস্থা কর।



একদল তখনি মৃতদেহ গুলো নিয়ে আগে থেকে প্রস্ততকৃত কবর বা গর্তে রওনা হল এদেরকে বলা হয় “ভোজা”। কবরের কাছাকাছি নিয়ে এসে মৃতদেহগুলো রেখে আর একদল হাটু ভেঙ্গে থুতনীর সঙ্গে মিলিয়ে তারা দেহ গুলো কবরে রাখবে তবে কবরে রাখার আগে মৃতদেহগুলোকে পেটে, বুকে এবং চোখে ছুরি চালিয়ে কবরকে পাকা করবে। এদের নাম “কুথাওয়া”। এই পেট, বুক, চোখে ছুরি চালানোর কারন মৃত দেহ গুলো যেন ফুলে ফেপে উঠে কবর থেকে বের হয়ে না আসে। এই সব কাজ যখন চলছে তখন দূর থেকে দুই জন বিভিন্ন দিকে নজর রাখছে অবাঞ্চিত কেউ এসে যেন এই ঘটনা না দেখে, কাউকে আসতে দেখলেই তারা একটুকরা সাদা কাপড় নেড়ে বাকীদের সাবধান করবে। এদের কে বলা হয় “ফুরকদেনা”। এরপর “ফুরজানা” নামক একজন সব কিছু পরিস্কার করে, কবরের ওপর দেখতে দেখতে ভোজসভা বসিয়ে দেবে। এই ভোজের মুল উপাদান “গুড়”। কিন্তু ঠগীরা একে গুড় বলেনা একে বলে “তুপোনী” বা অমৃত। ঠগীদের ভাষার নাম “রামসী”।



কারা এই ঠগী? এদের ধর্ম বিশ্বাস কি? এরা কোথায় থাকত? কিভাবে এদের বিনাশ হয়ে? কার হাতে?

ঠগীদের ইতিহাস যদি খুজতে যান তবে অনেক প্রাচীনকালেই এদের উল্লেখ্য আছে। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডেটাস এদেরকে পারসিক বলে বর্ননা করে গেছেন, এদের অভিনবত্ব হচ্ছে এদের অস্ত্রে, যাদের মুল অস্ত্র হচ্ছে চামড়ার তৈরী একটি ফিতা যা দিয়ে যে কোন মানুষকে মুহুর্তে গলায় পেচিয়ে হত্যা করতে পারত। তার মতে এদের আদি পুরুষ হচ্ছে “সাগার্তি”, যিনি জারেক্সাসকে আট হাজার অশ্বারোহী দিয়ে সাহায্য করছিলেন। পশ্চিমী ঐতিহাসিকরা অনেক খুজে পেতে সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতীয় ঠগীরাও এই সাগার্তির উত্তরপুরুষ। পশ্চিমের মুসলিম বিজেতাদের হাত ধরে এরা এক দিন এই ভারতবর্ষে প্রবেশ করে।



ফিরোজ খাঁর সময়ের ঐতিহাসিক জিয়া-উদ-বারনি ১৩৬৫ সালে তার তুঘলক কাহিনীতে এদের উল্লেখ্য করছেন – ১২৯০ সালে জালালুদ্দীন রাজত্বকালে দিল্লীতে প্রায় এক হাজার ঠগ ধরা পড়ে। বাদশাহের এক চাকরকে হত্যা করার অপরাধে এদের ধরা হয় এবং মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, পরে এদের মৃত্যুদন্ড রদ করে সবার পেছন লোহার ছাপ দিয়ে পূর্ব ভারতের লক্ষ্মৌতে পাঠিয়ে দেন। নিজামুদ্দীন আউলিয়াকে নিয়ে যে মীথ প্রচলিত যে সে নাকি আগে বিরাট ডাকাত ছিল তার সাথেও জড়িত আছে ঠগী ইতিহাস। কিন্তু এটার পেছনে কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নেই।



এর পর মুসলিম ভারতে ঠগীর উল্লেখ্য পাওয়া যায়, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিঃ) সেবার প্রায় ৫০০ ঠগী ধরা পরে এবং সব এটোয়া জেলায়। সেই সুলতানী আমলে ঠগীরা সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পরে, পরে ইংরেজ কোম্পানীর আমলে ঠগী সম্প্রদায়ের বিনাশ যার হাতে ঘটে সেই “উইলিয়াম স্লীম্যান” যখন এদের নিয়ে গবেষনা করেন তখন দেখেন তাদের সাকুল্যে আদি গোত্র মাত্র সাতটি। বাহলিম, ভিন, ভুজসোত, কাচুনী, হুত্তার, গানু এবং তুনদিল। সারা ভারতের নানা বর্নের নানা ধর্মের যত হাজার হাজার ঠগী কিন্তু উৎপত্তি ওই সাত পরিবার থেকে।

স্লীম্যান লিখছেন সে সময় অযোধ্যায় জনপথ ছিল সাকুল্যে চৌদ্দশ’ ছ’ মাইল তার প্রতি মাইলে তখন ঠগ, অবস্থা এমন যে “ঠগ বাচতে গা উজাড়ের অবস্থা”। স্লীম্যান হিসাব করে পরবর্তীতে দেখান যে, অযোধ্যার ঠগীদের দশভাগের নয় ভাগই মুসলমান, দোয়াবে আবার হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ্‌, নর্মদা নদীর দক্ষিনে আবার মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ। এভাবে হিসাবে করলে দেখা যায় সারা ভারতবর্ষে হাজার হাজার ঠগী, ধর্মে তারা যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন। কোথাও তাদের নাম “ফাসুড়ে”, কোথাও “ফাসীগীর” কোথাও “আরিতুলুকর” কোথাও “তন্তাকালেরু” নামে পরিচিত। নাম যাই হোক তারা “ঠগী”। তাদের হাতিয়ার এক, ভাষা এক, জীবন এক, পেশা এক, ধর্ম এক।


কালীঘাট মন্দির

এ এক অদ্ভুত ধর্ম। দুটো আপাত বিপরীত ধর্ম হিন্দু এবং ইসলাম কোন এক বিস্ময়করভাবে এক বিন্দুতে এসে মিলছে এই ঠগী বিশ্বাসের কারনে। ঐতিহাসিকরা যাই বলুক না কেন হাজার হাজার ঠগী ধরা পরার পর আদালতে দাড়িয়ে সগর্বে ঘোষনা করেছে তারা “মা ভবানী” বা কালীমাতার সন্তান। তাদের তীর্থ বাংলার কালীঘাট মন্দির এবং এরপর বিন্ধ্যাচলের ভবানী মন্দির।



কিভাবে ঠগীরা কালীর সন্তান হয়েছিল, তারও এক গল্প আছে, পৃথিবীতে তখন আবির্ভুত হয়েছে মহাদানব “রক্তবীজ”। এই দানবের উপদ্রবে সৃষ্টি লয় হবার উপক্রম। রক্তবীজ কে শায়েস্তা করতে পৃথিবীতে আসল জগদম্বা কালী এবং রক্তবীজের সাথে লড়াইতে অবতীর্ন হয়, কিন্তু রক্তবীজের সামনে তিনিও অসহায়। কারন রক্তবীজের প্রতিফোটা রক্ত থেকে নতুন রাক্ষস উৎপন্ন হচ্ছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত ভবানী চিন্তিত। সেই মুহুর্তে তার দেহনিঃসৃত ঘাম থেকে সৃষ্টি হল দুটি মানুষের। ভবানী তার হাতের রুমালটি তাদের দিয়ে বললেন “বৎসগন এই তোমাদের অস্ত্র। এ নিয়ে শত্রু নিধনে তৎপর হও।” ওরা দুই জন সেই রুমাল দিয়ে ফাস তৈরী করল এবং একের পর এক দানবদের ফাস দিয়ে হত্যা করল এক ফোটা রক্ত না ঝড়িয়ে। সেই থেকে ঠগীদের ধর্মে রক্ত ঝড়ানো নিষিদ্ধ।

এরপর ওই দু’জন মা ভবানীকে রুমাল ফেরত দিতে গেলে মা ভাবানী সে রুমাল না নিয়ে ওই মানবদের তা দিয়ে দেয় এবং এদ্ধারা হত্যার মাধ্যমে তাদের রুটি রুজির পথ করে নিতে বলে। এই হল শর্টকাটে ঠগীদের উদ্ভবের কাহিনী। এই কাহিনী শুধু গল্পেই না এটা হিন্দু, মুসলমান বা অন্য যে কোন ধর্মের লোক ঠগী হোক না কেন, তারা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করত।



এই ঠগীদের বিনাশ যার হাতে হয়, তার নামের আগেও “ঠগী” বিশেষানটি বিশেষ কারনে যোগ হয়ে যায়। ইনি একজন ফিরিঙ্গী ঠগী। নাম উইলিয়াম হেনরী স্লীম্যান। শীত শেষে ভারতের নানা রাজ্যের মা ভবানীর শিষ্যরা যখন হাজার হাজার প্রানের অর্ঘ্য মায়ের পায়ে নিবেদন করে যাচ্ছে তখন ওদিকে ফিরিঙ্গী ঠগী কিভাবে এদের বিনাশ করা যায় তার ছক কাটছেন।

১৮২৬ সালে সর্ব শক্তি নিয়ে এই ঠগীদের নিধনে নামেন স্লীম্যান, ১৮৩০ সালের মাঝে ধৃত ঠগীদের জবান বন্দীদের মাধ্যমে মানচিত্র, বংশ তালিকা সব তৈরী করে ফেলেন। ওদিকে ১৮২৮ সালে বাংলার গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন লর্ড বেন্টিঙ্ক। ঠগী দমন এতদিনে যার নেশায় পরিনত হয়েছে সেই উইলিয়াম স্লীম্যানকে সব দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়ে শুধু ঠগী দমনের দায়িত্ব দেয়া হয়। এক ধাক্কায় জব্বলপুরের জেলা প্রশাসক স্লীম্যান হয়ে গেলেন গভর্নর জেনারেল বেন্টিঙ্কের ঠগী দমন বিভাগের “সুপারিন্টেণ্ডেন্ট জেনারেল” ১৮৩১ সালে। যে বিভাগটি তৈরী হয়েছে স্লীম্যানের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায়। ততদিনে মোটামুটি এক হিসাবে স্লীম্যান দেখতে পেলেন এই সম্প্রদায়ের হাতে বিগত তিনশত বছর প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ কোন রকম রক্তপাত ছাড়া জীবনের অর্ঘ্য দিয়ে মা ভবানীর পায়ে নিবেদিত হয়েছে।



আজকের মত তখন দেশে কোন রেল লাইন নেই, নেই কোন রাস্তা। স্লীম্যান তখন কখনো ঘোড়ার পিঠে, কখনো উটের পিঠে, কখনো গরুর গাড়ীতে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছেন ইতিহাসের সব থেকে বড় হত্যাকারী কাল্টের সদস্যদের যারা কখনো নিজেদের প্রকাশ করত না, অত্যান্ত সাধারন মানুষের বেশে সাদাসিদে ভাবে মিশে থাকত কারো প্রিয়তম স্বামী হিসাবে, কারো ভালোবাসার বাবা হিসাবে, কারো আদরের সন্তান হিসাবে।

এত এত সীমাবদ্ধতার মাঝেও অসাধ্য সাধন করলেন ফিরিঙ্গী ঠগী স্লীম্যান। ১৮৪০ সালে এক হিসাবে দেখা যায় গত দশ বছরে তার হাতে ধরা পড়ছে ৩৬৬৯ জন ঠগী যার মধ্যে ৪৬৬ জনের ফাসী, দ্বীপান্তর ১৫০৪ জন, যাবজ্জীবন ৯৩৩ জন, রাজসাক্ষী ৫৬ জন, রোগে মারা গেছে ২০৮ জন এবং পালিয়ে গেছে ১২ জন। কিন্তু পালিয়ে গিয়েও নিস্তার পায়নি, ঠিক কয়েক দিনের মধ্যে স্লীম্যান আবার তাদের ধরে আনলেন। ততদিনে স্লীম্যানের ভাবমুর্তি মা ভবানীর মত। মুর্তিমান আতংক হিসাবে অথবা ঠগীদের ভাষায় মা ভবানীর অভিশাপ হিসাবে তাকে তারা দেখতে শুরু করছে। পরবর্তী সাত বছরে ধরা পড়ল আরো ৫৩১ জন, ফাসিকাঠে ঝুলে পড়ল ৩১ জন, দ্বীপান্তর ১৭৪, যাবজ্জীবন ২৬৭ জন, রাজসাক্ষী হল ৪৬ জন। পরের বছর ধরা পড়ল ১২০ জন। হিন্দুস্তানের শত শত বছরের নিষ্ঠুরতম কলঙ্কময় ইতিহাসের এখানেই সমাপ্তি। দুর্ধর্ষ ঠগীরা এরপর শুধুই ইতিহাস। এরপরো ফাকে ফাকে এদের কথা শোনা যেত কিন্তু তাদের মেরুদন্ড যে স্লীম্যান ভেঙ্গে দিয়েছিল তা আর কোন দিন সোজা হয় নি।



অনেকেই হয়ত ভাবছেন, যেসব ঠগী ফাসির দড়ি গলায় দিয়ে ঝুলে পড়ছে তারা বোধ হয় মৃত্যুভয়ে ভীত ছিল, মোটেই না। জীবনে যেমন তারা হাসতে হাসতে অন্যের জীবন নিতে এক বিন্দু হাত কাপায় নি, তেমনি ফাসির দড়ি গলায় দেবার সময় গান গাইতে গাইতে, কেউ কেউ জল্লাদের সাথে ইয়ার্কি মারতে মারতে ঝুলে পড়ছে নিজে থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ফাসির মঞ্চে, শুধু টার্গেট থাকত কোন নীচু জাতের জল্লাদ যেন তার গলায় রশি না পরায়, সেক্ষেত্রে নিজে থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঠিক ঠাক মত বেধে নিজে থেকেই ঝুলে পড়ত, কারন ঠগীরা বিশ্বাস করত, মা ভবানীর আদেশে তাদের রুটি রুজির জন্য যেমন আর একজনের জীবন নিয়েছে তেমনি নিজেও এখন মা ভবানীর সন্তান হিসাবের তার কাছে তার ইচ্ছায় ফিরে যাচ্ছে, এতে দুঃখের কিছু নাই, বড় আনন্দের ব্যাপার।


ঠগী বহরম

রোসন জমাদার, রুস্তম খাঁ, এনায়েৎ, দুর্গা, কল্যান সিং, ফিরিঙ্গীয়া, বহরম জমাদার এই নামগুলা এখন আর আতংক তৈরী করে না, কিন্ত এক বহরম জমাদারের হাতেই নিহত হয়েছিল ৯৩১ জন। যেসব ঠগী ফাঁসি কাঠে জীবন দিয়েছিল বা যাদের যাবজ্জীবন হয়েছিল তাদের পরিবারের পূর্নবাসনের দিকে খেয়াল ছিল স্লীম্যানের। যার কারনে ওই সব পরিবারের সদস্যদের লাগিয়ে দিলেন কার্পেট তৈরীতে। দেখতে দেখতে তৈরী হল ৮০ ফুট দীর্ঘ এবং ৪০ ফুট চওড়া কার্পেট এ কার্পেট যাবে বিলাতে মহারানীর খাস কামড়ায়। ঠগীদের নিয়ে যার ছিল প্রবল আগ্রহ কারন ততদিনে জনৈক ফিলিপ মিডাস টেলরের “ঠগীর জবানবন্দী” নামক বইর প্রথম পাঠিকা এবং প্রুফ কপি পড়তে পড়তেই তন্ময় (কিছু দিন আগে সেবা প্রকাশনী থেকে এটা অনুদিত হয়েছে)। প্রায় দুই টন ওজনের সে কার্পেট মহারানীর উইন্ডসর ক্যাসেলের ওয়াটারলু চেম্বারে আজো রক্ষিত আছে, স্লীম্যান দেখিয়ে দিয়েছেন, খুনের শ্রেষ্ঠতম শিল্পীদের হাত দিয়ে সমান দক্ষতায় ফুল ফুটাতে পারে।



যারা “থাগস অভ হিন্দুস্থান” দেখে ফিরিঙ্গীয়া নামক আমীর খানের অভিনয় দেখে ঠগীদের ব্যাপারে রোমান্টিক চিন্তা করছেন, তাদের জন্য সাবধানবানী, ঠগীরা মোটেই অমন কিছু ছিল না, তবে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ একজন ঠগীর নাম ছিল ফিরিঙ্গীয়া যে কিনা স্লীম্যানকে সব থেকে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছিলো। তবে এক সময় সেও আত্মসমর্পন স্লীম্যানের রাজসাক্ষী হিসাবে স্বজাতির সাথে বেঈমানী করে। তাই ফিরীঙ্গীয়া কোন নায়কতো নয়ই ডাবল খল নায়ক।

কৃতজ্ঞতাঃ শ্রীপান্থ র লেখা “ঠগী”, ফিলিপ মিডোস “ঠগির জবানবন্দী” (দুটো বইর বাংলা অনুবাদ লিঙ্কে দিয়ে দিলাম, ডাউন লোড করে পড়ে ফেলুন, গ্যারান্টি সময়টা বৃথা যাবে না, নতুন এক পৃথিবীর সন্ধান পাবেন) এবং অনলাইনের বিভিন্ন প্রবন্ধ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৩:০২
৩২টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×