অসম শক্তিশালী বাহিনীর সাথে আপনি যখন যুদ্ধ করবেন তখন তাদেরকে তাদের পছন্দ মত জায়গায় যুদ্ধ করতে দিলে আপনি নিশ্চিত পরাজয় বরন করবেন। সেক্ষেত্রে সব থেকে ভালো ট্যাক্টিস হল শত্রুকে নিজের সুবিধা মত জায়গায় টেনে আনা এবং সেখানে যুদ্ধ করা। ভুড়ি ভুড়ি উদাহরন আছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানকে নদী নালায়, ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকাকে মাটির নীচে অথবা আফগানরা তাদের পছন্দমত পাহাড়ের গুহায় মোকাবেলা করে অসম প্রতিপক্ষ আমেরিকা বা রাশিয়াকে। সব গুলো ক্ষেত্রে প্রবল পরাক্রান্ত প্রতিপক্ষ যুদ্ধে জেতা তো দূরে থাক অনেকটা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
৭ ই জানুয়ারী, ১৯৬৬ অপারেশান ক্রিম্প শুরু হয়েছে, দক্ষিন ভিয়েতনামের আয়রন ট্রায়েঙ্গেলের কাছাকাছি হো বো জঙ্গলের কাছে। এর আগে ঐ এলাকায় আকাশ থেকে নাপাম বোমা সহ সে আমালে আমেরিকার যত ধরনের কনভেনশনাল বোমা আছে সব মেরে তার নিজের সেনাদের সুবিধা দিয়ে দেয় যাতে যেন কোন ভিয়েতকং, অপারেশান ক্রিম্পে অংশ গ্রহনকারী আমেরিকান এবং অষ্ট্রেলিয়ান সেনাদের ঝামেলা না করতে পারে।
মোটামুটি নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাচ্ছে ইউ এস এবং ANZAC (Australian and New Zealand Army Corps) ফোর্স হঠাৎ নিকটস্থ রাবার বাগানের ভেতর দিয়ে ভিয়েতকংরা আমেরিকান এবং অষ্ট্রেলিয়ান ফোর্সের উদ্দেশ্যে গুলি চালায়, অথচ কিছুক্ষন আগে ওই এলাকায় আমেরিকান বিমান বাহিনী ভয়াবহ বোমা ফেলে গেছে। এ অবস্থায় ২৮ তম ইনফ্যান্ট্রি তাদের হেলিকপ্টার ডেকে পাঠায় এবং সাথে সাথে এয়ারবর্ন হয়ে ঐ রাবার বাগানের দিকে উড়ে যায়, কিন্তু যেতে যেতে সব ফাঁকা। কেউ নেই। যেন বাতাসে মিশে গেছে যারা গুলি করছিলো।
অপারেশান ক্রিম্প এগিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ভিয়েতকংরা উদয় হচ্ছে দু একটা অব্যার্থ গুলি ছুড়ে যে কয়জন পারছে আমেরিকান এবং অষ্ট্রেলিয়ান সৈন্যদের পেড়ে ফেলছে আবার বাতাসে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই কিছু ট্রেঞ্চ, ফক্স হোল, আর মাটির ওপর গর্ত আবিস্কার হচ্ছে, তখনো তারা বুজতে পারে নি কি জিনিস তারা আবিস্কার করতে যাচ্ছে। তিন দিন পর জানুয়ারী ১০, অপারেশান ক্রিম্প যখন শেষ হয় ভিয়েতকংদের কোন চিহ্ন তারা খুজে পায় না। শুধু থেকে যায় এর মাঝে স্রেফ ভুতের মত উদয় হয়ে মাঝে সাঝে গুলি করে আমেরিকানদের কিছু লাশের চিহ্ন। অবশেষে তিন দিন পর অপারেশান ক্রিম্প যখন শেষ হয় তখন ১৭৩ এয়ারবোর্ন ব্রিগেড এবং ২৮ ইনফ্যান্ট্রি তাদের রিপোর্টে এক দীর্ঘ টানেলের উল্লেখ্য করে। যেখান থেকে মুলতঃ আমেরিকানরা মাটির নীচের এক দুনিয়ার খবর পায়।
আমেরিকান এবং তাদের ধামাধরা দক্ষিন ভিয়েতনামি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সোস্যালিষ্ট উত্তর ভিয়েতনামিজ সৈন্যদের ভিয়েতকং নামে অভিহিত করা হয়। এই ভিয়েতকংরা মাটির নীচে শত শত মাইল টানেল খোড়ে কয়েক যুগ ধরে যা সায়গনের উত্তর পশ্চিমের চু চি শহরের নীচ দিয়ে যায়। এই টানেলকে ভিয়েতকংরা তাদের গ্যারিসন, যাতায়াত, গেরিলাযুদ্ধের আদর্শতম স্থান হিসাবে তৈরী করে যা বিশ্বের পরাশাক্তি আমেরিকাকে এক দুঃস্বপ্ন উপহার দেয়। এখানে থাকার সুবিধার পাশাপাশি, ছোট খাট হাসপাতাল, এমন কি আস্ত একটি দখলদারি আমেরিকান ট্যাঙ্ক ও ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল মাটির নীচে।
হো চি মিন
১৯৪১ সালে জাপান এবং ফ্রেঞ্চ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি পাবার জন্য চীন এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে অনুপ্রান্তিত হয়ে আঙ্কেল হো চি মিন গঠন করে “ভিয়েতমিন” নামক সংগঠন, এই সময় থেকেই জাপানী এবং ফরাসী দখলদারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল তৈরী শুরু করে দক্ষিন ভিয়েতনামের জংলা অঞ্চলে। প্রথম দিকে ছোট ছোট টানেল তৈরী করা হয়। পরে ১৯৪৯ সালে আবার ফ্রান্স তার পুতুল সরকার বাও দাইকে দক্ষিন ভিয়েতনামে বসালে আঙ্কেল হো র লোকজন এই টানেল গুলোকে আরো সম্প্রসারিত করতে থাকে। ১৯৫৫ সালে এক ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে প্রচন্ড কম্যুনিষ্ট বিরোধী দিন দিয়েম নো কে ক্ষমতায় বসায় আমেরিকা।
এক পর্যায়ে আমেরিকা ১৯৬১ সালে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে দক্ষিন ভিয়েতনামে, ওদিকে প্রচন্ড নিষ্ঠুর দিন দিয়েম নো কে ঠেকানোর জন্য দক্ষিন ভিয়েতনামে কম্যুনিষ্ট অকম্যুনিষ্ট সব এক হয়ে গঠন করে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফ)। আর আমেরিকান রা একে ব্যাঙ্গ করে ডাকা শুরু করে ভিয়েতকং (মানে ভিয়েতনামিজ কম্যুনিষ্ট, যদিও এই এন এল এফ বা ভিয়েতকং এ কম্যুনিষ্টদের থেকে অকম্যুনিষ্টই বেশী ছিল)। এদিকে এই সব যুদ্ধ আর রাজনীতির পাশাপাশি টানেলের দৈর্ঘ্য কিন্তু বেড়ে চলছে। এক পর্যায়ে এই টানেলের দৈর্ঘ্য ২৫০ কিলোমিটারের বেশি হয়ে দাড়াল।
আমেরিকানরা “অপারেশান ক্রিম্প” এবং এরপর “অপারেশান সিডার ফলস”এর পর এই টানেল সম্পর্কে যখন অবহিত হল ততদিনে এই চু চি টানেল দক্ষিন ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন কে ঘিরে এক জটিল আন্ডার গ্রাউন্ড স্থাপনা হিসাবে তৈরী হয়ে গিয়েছি। এযেন মাটির নীচে শহর তার নীচে শহর। কয়েকটি স্তরে ঘিরে এই চু চি টানেল তৈরী হয় ওপরের দিকে কিছু কিছু জায়গায় স্থানীয় চাষা ভুষোরা থাকত, আমেরিকান এবং অষ্ট্রেলিয়ান সৈন্যরা যারা এই টানেলে সাহস করে ঢুকত তাদেরকে “টানেল র্যাট” বলা হত। এই টানেল র্যাটরা জীবন হাতে করে এই টানেলে ঢুকত। তারা মুলতঃ ওপরের স্তরে অবস্থানরত চাষাভুষোদেরি বেশী পেত, মুল ভিয়েতকং গেরিলাদের খুব কমই ধরতে পেরেছে।
সামরিক বাহিনীতে সাধারনতঃ উচু লম্বা পেশি বহুল শক্ত সমর্থদেরই জয় জয়কার। কিন্তু এই টানেল র্যাট যারা কাজ করত তারা ছিল বাহিনীতে খর্বকায়। টানেল র্যাট হিসাবে যারা কাজ করত তাদের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল সাড়ে পাচ ফিট, হাল্কা পাতলা। এই বাহিনী ছিল অনেকটা ভলান্টিয়ার সার্ভিস, একই সাথে তাদের থাকতে হত দুর্জয় সাহস, যারা অনেকটা মৃত্যুকে মেনে নিয়েই এই টানেলে নামত। কারন মাটির ওপর আমেরিকান বাহিনী যত ক্ষমতা শালী হোক না কেন মাটির নীচে কোথাও দুই ফিট চওড়া, তিন ফিট উচু টানেলে ঠিক তত টাই অসহায়।
মাটির নীচে এই টানেল ছিল স্রেফ মৃত্যু কুপ। দু’জন দু’জন করে টানেল র্যাট নামত কোন মুখ খোলা পেলে বা হঠাৎ কোন টানেলের মুখ আবিস্কার হলে, একজন আর একজনের থেকে পাচ মিটার দূরে থেকে ক্রলিং করে এগোত। নিয়ম অনুযায়ী যার অভিজ্ঞতা বেশী সেই র্যাট-১ হিসাবে সামনে থাকবে, আবার ছয় মাস পরে র্যাট-২ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলে সে আর একজন নতুনকে সাথে নিয়ে টানেলে নামত র্যাট-১ হিসাবে। পুরো টানেল এই ভিয়েতকংদের তালুর মত পরিচিত ছিল, তার ওপর কিছু দূর পর পর থাকত বুবি ট্রাপ, সে বুবি ট্রাপের ধরনও থাকত ভিন্ন। হয়ত কোথাও টানেলের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে টানেল র্যাটরা এগোচ্ছে হঠাৎ সামনের জনের মরন চিৎকার পেছনের জন সামনে এগিয়ে দেখল সামনের জন ওই হামাগুড়ি দিতে দিতে না বুজে সামনের কোন গর্তে পড়ে গেছে যেখান নীচে চোখা বাশের লাঠি গাঁথা।
এছাড়াও ভিয়েতকংদের হাতে থাকত “ব্যাম্বো ভাইপার” নামে ভয়ঙ্কর সাপ যা এই টানেল র্যাটদের কছে পরিচিত ছিল “ওয়ান ষ্টেপ” “টু ষ্টেপ স্নেক” নামে কারন এই সাপ কামড় দিলে দুই পা’র বেশী আগানোর আগেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত, হয়ত টানেলের কোণ অন্ধকার কোনে চুপ করে বসে আছে ভিয়েতকং। সামনে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে টানেল র্যাট, আস্তে করে পিঠের ওপর নামিয়ে দিল “ব্যাম্বো ভাইপার”। খেল খতম।
প্রথম দিকে এই টানেল থেকে ভিয়েতকংদের বের করার জন্য আমেরিকানরা প্রথমদিকে বিষাক্ত গ্যাস ছাড়ত কোন এক মুখ দিয়ে, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন বিসর্জন দেয়া ছিল ভিয়েতকংদের অন্যতম আদর্শ। তাই এক দিক দিয়ে গ্যাস চার্জ করলে বেশ কিছু ভিয়েতকং মারা গেলে সে জায়গা আবার অতি সত্ত্বর পুরন হয়ে যেত। এক পর্যায়ে টানেলে গরম পানি পাম্প করত সে পানির সাথে হলুদ রং মিশিয়ে দেয়া হত এবং ওপরে হেলিকপ্টার উড়ত, যদি কোন ভিয়েতকং গরম পানির কারনে বের হয়ে আসত তবে ওপর দিয়ে পাখি শিকারের মত ফেলে দেয়া হত। পরে এগুলো অকার্যকর বিবেচিত হয়।
এর পাশাপাশি প্রথম দিকে টানেল র্যাটদের খোজার জন্য টানেলে প্রথম দিকে কুকুর নামিয়ে দেয়া হত, কিন্তু ভিয়েতকংরা একই ধরনের সাবান রেখে দিত টানেলের ভেতর বিভিন্ন জায়গায় যে সাবান আমেরিকান সৈন্যরা ব্যাবহার করে যাতে বিভ্রান্ত হয়ে যেত কুকুরগুলো, এবং অতি সহজেই ভিয়েতকংদের শিকার এবং খাদ্যে পরিনত হত। কিন্তু এক পর্যায়ে এই সব কার্যকরন সব বিফলে যায়। ফাইনালি তৈরী হয় “টানেল র্যাট ”।
টানেল র্যাটরা অপারেশানে যেত সাথে থাকত সুইস আর্মি নাইফ, একটা টর্চ এবং স্মিথ এ্যান্ড ওয়েসন .৩৮ রিভলবার। কেউ কেউ আবার .৪৫ কোল্ট ইউজ করত। তবে সাইলেন্সার সহ রিভলবারই টানেল যুদ্ধে ষ্ট্যান্ডার্ড ছিল কারন কোন কারনে পিস্তলের চেম্বারে গুলি আটকে গেলে মুহুর্তের ব্যাবধানেই জীবন মৃত্যুর ফয়সালা হয়ে যেত। টানেল যুদ্ধে যে নিয়ম কে বলা হত “গোল্ডেন রুল” সেটা হল কোন অবস্থাতেই এক বারে তিনটার বেশি গুলি করা যাবে না, কারন সেক্ষত্রে প্রতিপক্ষ ভিয়েতকংরা জেনে যেত আর কয়টা গুলি অবশিষ্ট আছে। তিনটা গুলি করেই সুযোগ মত প্রথম চান্সে আবার পিস্তল বা রিভলবার রিলোড করে নিত।
ভিয়েতকং যোদ্ধাদের মাঝে যারা টানেল যোদ্ধা তাদের মাঝে কেউ কেউ বছরের পর বছর টানেলের অপরিসর স্থানে অবস্থান করত এবং টানেল র্যাটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। এই সব যোদ্ধারা যারা যুদ্ধ শেষে বেঁচে গিয়েছিল তাদের অনেকেরই মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, তারা ঠিক মত স্বাভাবিক মানুষদের সাথে মিশতে পারত না, কেউ কেউ আবার সব সময় এত বেশী সতর্ক থাকত সামন্য শব্দেও সেও মনে করত শত্রু এসেছে, এদের পরে মানসিক চিকিৎসা দেয়া হয়। ওদিকে টানেল র্যাটরাও সাধারন সৈন্যদের তুলনায় কিছুটা পাগলাটে ছিল, তাদের কে “ক্রেজি” হিসাবে অভিহিত করা হত, অনেক সময় টানেল র্যাটরা টানেলে নামলে ওপরের সাধারন সৈন্যরা বাজি ধরত সে জীবিত ফেরত আসবে কি, আসবে না। এই ছিল র্যাটদের জীবন!
ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা তাদের নৃশংসতার চুড়ান্ত রূপ দেখায় দীর্ঘমেয়াদী রক্তাক্ষয়ী এই যুদ্ধে আমেরিকানরা রাসায়নিক অস্ত্র, এজেন্ট অরেঞ্জ ব্যবহার করেছিলো ভিয়েতনামকে পত্রশূন্য করার জন্য। শূন্য থেকে উত্তর ভিয়েতনামিদের ক্যাম্প, সেন্য এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে মার্কিনরা বন-জঙ্গলে ঘেরা ভিয়েতনামকে পত্রশূন্য করে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট গেরিলাদের জব্দ করতে ভিয়েতনাম জুড়ে গ্যালন গ্যালন রাসায়নিক পদার্থ ঢালতে শুরু করে মার্কিন সেনা। দশ বছরে ভিয়েতনামে ঢালা হয়েছিল সাতরঙা বিষের মধ্যে সব থেকে কুখ্যাত ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’। সবমিলিয়ে মোট সাড়ে চার কোটি লিটার ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’। উপরের ছবিতে সেই নিষ্ঠুর চেহারাটি ফুটে উঠেছে। এগুলো ছিল সামান্য প্রভাব। এছাড়াও এই রাসায়নিক অস্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে এবং বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেওয়া শুরু হয়। এছাড়া নাপাম বোমার কথা তো আগেই বলেছি।
১৯৭২ সালে এই ছবি তোলা হয়েছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের একটি গ্রামে। দূরে দেখা যাচ্ছে কুখ্যাত নাপাম বোমার ধোঁয়া। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে নগ্ন হয়ে দৌড়ুচ্ছে নয় বছরের এক বালিকা। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক চিত্রসাংবাদিকের তোলা এই ছবি সারা বিশ্বকে নাড়া দেয়, বিব্রত হয়েছিলেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনও। ভিয়েতনাম জুড়ে তখন ‘নাপাম বোমা’ আর কুখ্যাত রাসায়নিক বিষ ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ ঢালছে মার্কিন সেনারা। গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে রওনা দিচ্ছিলেন মানুষেরা। বোমারু বিমান রেহাই দেয়নি তাদের। ওপর থেকে ফেলতে থাকে নাপাম বোমা এবং সেই বোমায় জ্বলে যায় তার দেহের একটা অংশ। “জ্বলে যাচ্ছে! জ্বলে যাচ্ছে!” এই চিৎকার করতে করতেই দৌড়তে থাকে শিশুটি শিশুটির নাম কিম ফুক (যোবাইর ভাইর দারুন এক লেখা আছে এনিয়ে চাইলে লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে আসতে পারেন বিশ্ববিবেককে কাঁপিয়েছিল যে ছবি ) সেই মুহূর্তটিই লেন্সবন্দী করেছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের চিত্র সাংবাদিক নিক উট।
শিকারের অপেক্ষায় বসে আছে ভিয়েতকং যোদ্ধা
টানেল র্যাট ইউনিট ছিল ভলান্টিয়ারি ইউনিট, শুধু ভলান্টিয়ারি হলেই হত না, সেই সাথে দরকার ছিল আমেরিকান অষ্ট্রেলিয়ান সৈন্যদের মাঝে খর্বাকৃতি (উচ্চতা ৫’৫” এর বেশি না), আবার শুধু উচ্চতা থাকলেই হত না, সেই সাথে থাকতে হত দুর্জয় সাহস। মাটির নীচে সুড়ঙ্গ পথে অচেনা পরিবেশে ওয়ান টু ওয়ান অথবা ওয়ান টু মেনি ফাইটের অভিজ্ঞতা, এর পাশাপাশি বুবি ট্রাপ, সাপ, বিছা, বিষাক্ত পিপড়া, গ্রেনেড হামলার আশংকা প্রতি পদে। তাই ১৯৬৫ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সব মিলিয়ে এই ইউনিটে ৭০০ জন সদস্য ছিল, তার মাঝে ৩৬ জন নিহত এবং ২০০ আহত হয়, ক্যাজুয়ালিটি রেট ৩৩%, এমনকি ভিয়েতনাম যুদ্ধের তুলনায়ও অনেক বেশী। অপর দিকে আমেরিকানদের নিয়ম নীতি হীন যুদ্ধের কারনে এক টানেল যুদ্ধেই ১২০০০ এর বেশি ভিয়েতকং নিহত হয়।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকানদের পরাজয়ের অন্যতম কারন দেখানো হয় এই টানেল কং দের। যারা রাতের আধারে ভুতের মত উদয় হয়ে আমেরিকান সৈন্যদের গলা কেটে আবার হাওয়ায় মিশে যেত, ফ্রাঙ্ক গুইটেরেযের কথায় শুনুন, “আমরা রাতে ঘুমুতে যেতাম কিন্তু জানতাম না সকালে সবাইকে দেখব কিনা? ওরা আসত ভুতের মত, আমাদের সাথে যথেষ্ট টানেল র্যাট থাকত, কিন্তু ওদের টানেলের মুখ কোথায় থাকত সেটা খুজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল......”
ভিয়েতনাম যুদ্ধটি আমেরিকানদের জন্য রক্তাক্ত এক রণক্ষেত্র ছিল, যদিও ভিয়েতনামিদের চেয়ে বেশি ভয়ংকর নয়। আমেরিকার ৫৮,২০০ সৈনিক নিহত, ১৬,০৯০ জন নিখোঁজ, ৩,০৩,৬৩০ সৈনিক আহত হয়েছিলো ভিয়েতনাম যুদ্ধে। অন্যদিকে, প্রায় ২০,০০,০০০ লক্ষ অসামরিক ভিয়েতনামিসহ প্রায় ৪০,০০,০০০ লক্ষ ভিয়েতনামি শহীদ হয় টানা ২০ বছরের যুদ্ধে।
ছবিঃ অন্তর্জাল। লেখায় নীল রং এর শব্দগুলোতে ক্লিক করলে লিঙ্ক পাওয়া যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১:৪১