শেষ’রাতের গল্পঃ
“এলোকেশী রূপশী”
অতঃপর এলোকেশী রূপশীকে আর ছাদের রেলিং এ দেখা গেলনা। অনেক খোজাখুজির পরও অর্ক তার ঠিকানা খুজে পেলনা। কিন্তু রূপশীর সাথে অর্কের এমনভাবে দেখা হবে সে ভাবেনি কখনও …
পড়ন্ত বিকালে, যখন রোদের তাপটা বেশ কম থাকত তখনই তাকে দেখা যেত ছাদের রেলিং এর পাশে । হাতে একটা মোবাইল ফোন আর কানে সবসময় হেডফোন । হেডফোন দিয়ে হয়ত গান শুনত না হয় রেডিও বা কথা বলত কারও সাথে । দূর থেকে ঠিক বুঝতে পারতনা, অর্ক । কিন্তু, তার মনে হয় সে কারও সাথে কথা বলত । একটু পর পর মেয়েটি হেসে উঠত যে । দূর থেকে এর কারন অর্কের পক্ষে উদঘাটন করা সম্ভব হয় নি, সে রেডিও শুনছে নাকি কেউ তাকে হাসানোর চেষ্টা করছে। অনেকদিন ধরে অর্ক লক্ষ্য করছিল মেয়েটিকে । মেয়েটা সবসময় হাসি খুশিই থাকত । দূর থেকে মেয়েটার চেহারা স্পষ্ট বোঝা যেতনা । কিন্তু মেয়েটি যে অসম্ভব রকম সুন্দরী তা দূর থেকেই আন্দাজ করা যেত। যখন মেয়েটি রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে কথা বলত কারও সাথে , তখন চারপাশ থেকে বাতাস এসে তার চুল এলোমেলো করে দিয়ে যেত । মেয়েটি তার চুল গোছানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেই যেত কিন্তু সফল হয়নি সে কখনও । প্রতিদিন অর্ক ছাদে যেত মেয়েটিকে এক ঝলক দেখার আশায় । মেয়েটি প্রতিদিন আসত না । বিশেষ করে, যখন অর্কের বাসায় তার মায়ের স্কুলজীবনের বান্ধবী ঈশিতা আন্টি আসত সেদিনই মেয়েটিকে ছাদে দেখা যেতই। তাই ঈশিতা আন্টি অর্কের জন্য খুবই লাকি একজন পার্সন ছিল । যদিও অর্ক তাকে খুব একটা পছন্দ করত না । অর্ককে দেখলেই ঈশিতা আন্টি “জামাই” সম্বোন্ধন করে ডাক দিত । যা অর্কের ভাল লাগত না। অর্কের মা সবসময়ই বলে,ঈশিতা আন্টির মেয়ে নাকি অনেক সুন্দরী । তার সাথে অর্কের বিয়ে দেবে বলে অর্কের মা ঠিক করে রেখেছে।এ কারনে সে ঐ আন্টির বাসায় ভুলেও পা রাখে নি।
অর্কের ছাদ থেকে এলোকেশী রূপশীর ছাদের রেলিং এর দূরত্ব দশ/বারটা বিল্ডিং এর পরে । অর্ক অনেক খোজার চেষ্টা করেছে মেয়েটির বাসা কিন্তু সে খুজে পাইনি । এলোকেশী রুপশী নামটাও অর্কের দেয়া । ওর আসল নাম যে ওর অজানা । দূর থেকে ওর এলোমেলো চুল-ই দেখা যায় কিনা,এজন্য বোধ হয় অথবা খোলা চুলে মেয়েটিকে দেখতে আরও সুন্দর লাগে ,সেজন্যও হতে পারে।এটা আমার জানা নেই…
কয়েকদিন ধরে মেয়েটাকে খুবই বিষন্ন লাগছিল । তার কানে আগের মত আর হেডফোন দেখা যেতনা।
ছাদের রেলিং এ তাকে আর দেখা যেতনা । খুব অল্প সময়ের জন্য আসত ছাদে। ছাদের রেলিং এর এক পাশে বসে খুব কাঁদত । অর্ক দূর থেকে সব বুঝতে পারত কিন্তু তার কিছু করার নেই । সাহস করে কয়েকবার মেয়েটিকে ইশারাও করেছে অর্ক কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। মেয়েটা যে সমস্যায় পড়েছে সেটা অর্ক বুঝতে পারছে কিন্তু কি সমস্যা তা অর্কের জানা নেই।
সেদিন বাড়ীতে ঈশিতা আন্টি আসল আবার। আজ তাকে খুব চিন্তিত লাগছে। অর্ক তার মায়ের মুখের দিকে তাকাল । মা রাগে ফোস-ফোস করছিল। আন্টি অর্ককে কিছু সম্বোন্ধন করে ডাকল না । তার চোখ আর মাথা দুই’ই অবনত । কিছু একটা তো হয়েছে যার জন্য আন্টি নিজেকে খুব ছোট মনে করছে । অর্ক আন্টিকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিল, তার কি হয়েছে? কিন্তু, সে তা করল না । সে সোজা ছাদে চলে গেল এলোকেশী রূপশীকে দেখার আশায়। কিন্তু, এই প্রথম এলোকেশী রূপশীকে আর দেখা গেল না । তারপর থেকে আর এলোকেশী রূপশীকে আর ছাদের রেলিং এ দেখা যেতনা। কেমন যেন সবকিছুতে অর্কের অস্থিরতা বিরাজ্ করছিল।
সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অর্ক দেখে ,বাসায় কেমন যেন নীরবতা বিরাজ করছে। অর্কের মা খুবই রেগে আছে কিন্তু তার চোখে পানি । কি হয়েছে , অর্ক বুঝতে পারছেনা । অর্কের মা বলল , গুছিয়ে নে, ঈশিতা’র বাড়ী যেতে হবে। অন্য কোনদিন হলে অর্ক তর্কে চলে যেত না যাবার জন্য । কিন্তু আজ তার মায়ের মুখ দেখে তার আর তর্ক করতে ইচ্ছে হল না । সে গুছিয়ে নিল শান্ত ছেলের মত । ঈশিতা আন্টির বাসায় অর্ক এই প্রথম যাচ্ছে । ঈশিতা আন্টি ওদেরই আশেপাশে কোথায় যেন থাকে । অর্ক আর ওর মা রিকশায় বসে আছে । অর্কের মা বার বার রুমাল দিয়ে চোখের পানি মোছার চেষ্টা করছে, চোখের পানি আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা । অর্ক কিছুই বুঝতে পারছেনা । রিকশা হঠাৎ থেমে গেল সামনে যাবার আর উপায় নেই । সামনে অনেক ভীড়। অর্কের মা নামল ভীড় ঠেলে ভেতরে যাবার চেষ্টা করছে । অর্কও তার মায়ের পিছু নিল। অর্কের কানে অনেক এলোমেলো কথা আসতে লাগল, আত্মহত্যা করছে, ছাদের থেকে লাফ দিছে, কোন ছেলের সাথে প্রেম করত, দাফন কাফন হবেনা , জানাজা দিবে না কেউ, এরে তো মাটিও দেয়া যাবে না…… ………………………
ভীড় ঠেলে সামনে এসেই অর্ক দেখল, ঈশিতা আন্টির বাড়ীর সামনে একটা পুলিশের গাড়ী আর তার পাশে র্যাবের একটা গাড়ী । কিছু সাংবাদিকও আছে বোধ হয় … অর্কের মা দৌড়ে গিয়ে ঈশিতা আন্টিকে জড়িয়ে ধরল । ঈশিতা আন্টি আরও জোরে কাদতে লাগল। ঈশিতা আন্টি যেখানে বসে আছে তার পাশেই খাটিয়ায় একটি নিথর লাশ, মুখটি ঢাকা । ঈশিতা আন্টির কাছের কেউ একজন মারা গেছে । একটু দূরে যেখানে সাংবাদিক দের ভীড় সেখানে কৌতূহল বশত অর্ক গেল । হলুদ ফিতা দিয়ে জায়গাটাকে ঘিরে দেয়া হয়েছে। প্রচুর রক্ত ওখানে । অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই অর্কের জানতে বাকী রইলনা যে, ঈশিতা আন্টির মেয়ে আত্মহত্যা করেছে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে। অর্ক ঈশিতা আন্টির মেয়েকে দেখেনি কখনও, শুধু তার সম্পর্কে মায়ের কাছে শুনেছে । লাশের মুখটি ঢাকা তাই দেখাও যাচ্ছেনা তার মেয়েটিকে। সবার মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে লাশটি নাকি দেখার মত অবস্থায় নেই। একটু বাদেই ঈশিতা আন্টি মূর্ছা গেল । তাকে কয়েক্জন ঘরে নিয়ে গেল অর্কের মা’ও সাথে গেল। তাই অর্কও ঈশিতা আন্টির ঘরে প্রবেশ করল। আন্টিকে খাটে শুইয়ে দিয়ে অর্কের মা অর্কের কাছে আসল। তিনি অর্ককে জিজ্ঞেস করলেন বুঝতে পেরেছিস কি হয়েছে এখানে?
অর্ক সম্মতিসূচক ইঙ্গিত করল। অর্কের মা অর্ককে বললেন, আনিকাকে তো তুই কখনও দেখিস নি । চল ওর রুমটা তোকে দেখায় । অর্ক একটু ইতস্তত করছিল। অন্যের অবর্তমানে তার রুমে যাও্য়া তার কাছে ঠিক লাগছিল না।অর্কের মা হাটা দিলেন , সাথে অর্কও । আনিকার রুমে গিয়ে বড়সড় ফ্রেমেবন্দী একটি ছবির দিকে ইশারা করে অর্কের মা বলল, এটা হল আনিকা । অর্ক কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল ছবিটার দিকে । আনিকাকে দেখতে অনেকটা এলোকেশী রুপশীর মত দেখতে । আনিকার কানেও হেডফোন , ওর চুলও এলোমেলো । অর্কর হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে লাগল, সে ঘামতে শুরু করেছে । তার অজানা একটা ভয় হতে লাগল । সে দৌড় দিয়ে ঈশিতা আন্টির বাড়ীর ছাদে গেল।
এ কি! এ তো সেই ছাদ , এ তো সেই রেলিং যেখানে এলোকেশী রূপশী দাঁড়াত । আজ এ ছাদে বাতাস নেই কেন? চারপাশটা আজ এত নীরব কেন?
অর্ক দৌড় দিয়ে খাটিয়ার কাছে গেল। ভেতরে পড়ে থাকা নিঃথর দেহটির মুখের কাপড় সরাল সে । তারপর একলাফে দূরে গিয়ে বসে পড়ল। তার আর চিনতে বাকী নেই, এই তার এলোকেশী রূপশী ।
অর্কের চোখে পানি । কিন্তু এই পানি কেন?
অর্কের সাথে তো আনিকার দেখা হয়নি কখনও। না হয়েছে কথা। আনিকা তো অর্ককে চেনেও না। কিন্তু অর্কের সবকিছু এলোমেলো লাগছে কেন, এখন??
হয়ত এজন্য যে, ভালবাসার কোন ভাষা হয় না । প্রয়োজন হয় না তা প্রকাশের বা প্রয়োজন হয় না যাকে ভালবাসেন তাকে জানানোর । কিন্তু ভয় থাকে ভালবাসার মানুষটিকে হারানোর । পৃথিবীর যত বড় বড় দুঃখ আছে , তার মধ্যে একটি দুঃখ হচ্ছে, ভালবাসার মানুষটির নিথর মৃতদেহ নিজের চোখে দেখা ।
কিছু ভালবাসার গল্প শুরুর আগেই পরিসম্পাতিতে চলে যায় । কিছু ভালবাসার মানুষ বোঝার আগেই না ফেরার দেশে পা বাড়ায় । শুধু ফেলে যায় ফ্রেমেবন্দী ছবি আর কিছু বাক্সবন্দী ভাল লাগার মুহুর্ত………!!!
পরে জানা গেল আনিকার সাথে আরেকজনও মারা গেছে , যে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে । ভালবাসা জিনিসটাই এরকম এলোমেলো । যে দিতে চায় তার কাছ থেকে কেউ নিতে চায় না ।
যাই হোক ভালবাসা হোক শারীরিক চাহিদার জন্য বা ব্যতীত । অল্প কিছুক্ষনের জন্য হলেও তো সেখানে এক চিমটি ভালবাসার অস্তিত্ব পাবার আশা করাই যায় । কিছু জিনিস ঘোলাটে থাকাই ভাল , পরিষ্কার আলোতে স্বচ্ছ হলে, এলোমেলো করে দিবে অনেক কিছু । থাক ভালবাসা যার যার জায়গায়, থাক অসংজ্ঞায়িত হয়ে… !!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৩:১৪