আজ সকাল সকাল হিমুর ঘুম ভেঙে গেল । গতকাল রাতে পায়ের নিচে কি যেন বিধেছিল! সকালের আলোতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে , একটা মাঝারি ক্ষত হয়েছে পায়ে । হাটতে কষ্ট হবে , তার । কিন্তু হিমুকে তো হাটতেই হবে । ক্লান্তি বা বাধা, কোনটাই তার পথের বাধা হতে পারে না । হিমু এখন কিংচিত অবাক হল । যদিও জাগতিক কিছুই তাকে অবাক করার ক্ষমতা রাখেনা ।তবুও তার অবাক করার বিষয়, তার পকেট ছাড়া পাজ্ঞাবী । পাজ্ঞাবীর রঙটা পুরোপুরি সাদা হয়ে গেছে এখন । যাকে বলে উজ্জ্বল সাদা । চায়ের দোকানের টিভিতে কোন একটা পাউডারের বিজ্ঞাপন দেখেছিল । সেখানে শুনেছিল, সাদার চেয়েও সাদা , ধবধবে সাদা । তার পাজ্ঞাবীটা , এখন ওমন পর্যায়ে পৌছেছে । কিন্তু , হিমু তো তার পাজ্ঞাবী ধুয়ে দেইনি বা সাদা রঙও করেনি। তাহলে এটা কিভাবে হল?
সমাধান খোজা দরকার । কিন্তু কার কাছে সমাধান পাও্য়া যাবে ?
রূপার কাছে যাওয়া দরকার । তার কাছে হয়ত সমাধান পাওয়া যেতে পারে । কিন্তু প্রথমে তাকে তার মেসের পথে রওনা হতে হবে । গোসল করে , মেসের সামনের দোকান থেকে চা পান করে, একটু বিশ্রাম নিয়ে , তারপর রূপার দেওয়া কাশ্মীরি শালটা পরে তার কাছে যেতে হবে তাকে । রূপার সাথে অনেকদিন দেখা নেই তার । কি জানি কি বলবে সে , এবার দেখা হলে…!!
পার্কের পরিবেশ অনেক নিরিবিলি । নিরিবিলি পরিবেশ , সময় কাটানোর জন্য সবচেয়ে ভাল । এখন একটু চেষ্টা করলেই ময়ূরাক্ষী নদীর হিম শীতল জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে পারবে হিমু । ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাবে তার । চোখটাও একটু ভিজে আসবে ঘুঘুর ডাক শুনে ।
হঠাৎ-ই, হিমুর নজর তার পাশের বেঞ্চটাই পড়ল । খুব জড়সড় হয়ে , একজন রোগা-শোকা মানুষ বসে সিগারেট টানছে । উস্কো-খুস্কো চুল তার । বয়স চল্লিশ-পঞ্চাশ হবে । হিমুর কৌতূহল বাড়ছে । যদিও তার কোন বিষয়ে কৌতূহল কম । হিমু উঠে গিয়ে লোকটিকে পর্যবেক্ষন করা শুরু করলেন । লোকটির চোখের সাথে চোখ পড়ার সাথে সাথেই লোকটি একটু হাসি দিল । তারপর হিমুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কি হিমু সাহেব পার্ক, রাস্তা ছেড়ে – এখন গোরস্থানে রাত কাটানোর পন নিয়েছেন নাকি?
হিমুর চিনতে বাকি রইলনা, মানুষটি মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক , মিছির আলি । কিন্তু মানুষটির তো অনেক অসুখ । যকৃৎ , অগ্ন্যাশয় , হৃৎপিন্ড সবই তো গেছে প্রায় । সামান্য অসুখে কাহিল হয়ে পড়েন । তাহলে এত সকালে এখানে উনি কি করছেন? হিমু আরও একটু অবাক হল মিছির আলি-র প্রশ্ন শুনে , তার মনেই হয়নি যে সে গোরস্থানে আছে !
এটা কিভাবে সম্ভব ? হিমু লক্ষ করল , মিছির আলিও সাদা পোশাক পরে আছে । টিভির বিজ্ঞাপনের পোশাকের মত, উজ্জল সাদা । হিমুর অবাক আর কৌতূহলী চেহেরা দেখে মিছির আলি আবার হিমুকে বলল, “হিমু সাহেব আমাদের রক্ত –মাংস ছিলই বা কবে? আমাকে নিয়ে আপনার এতটা কৌতূহল , আপনার চরিত্রের সাথে যায় না । আপনি বরং এক কাজ করুন , আপনি আপনার মেসের দিকে এগিয়ে যান । আজ আপনি মহাপুরুষ হবার স্বাদ পেয়েও যেতে পারেন ।’’
হিমুর মধ্যে আজ প্রথম ভ্রম কাজ করতে শুরু করেছে । সে মিছির আলির কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই তার মেসের পথে পা বাড়াল । সে লক্ষ করল , কোন মানুষই তার দিকে তাকাচ্ছেনা । সবকিছু কেমন যেন স্বাভাবিক । সে যে খালি পায়ে হাটছে , এটা যেন খুবই স্বাভাবিক ব্যপার । হিমুর নিজের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করতে শুরু করেছে । তার মনে হল তার কেউ পিছু নিয়েছে । হিমু পেছনে তাকাতেই , বাদলকে দেখতে পেল । বাদলের মুখে কোন হাসি নেই । বাদল চুপচাপ হিমুকে অনুসরন করে চলেছে । হিমু জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে বাদল তোর? তুইও কি উজ্জল সাদা শার্ট পরেছিস নাকি আমি চোখে ভুল দেখছি? বাদল অস্ফুট হাসি দিল, যার অর্থ হিমুর কাছে দু’রকম । হয় বাদল খুশি আছে অথবা বাদল এর মন বেদনায় জর্জরিত । কিন্তু কেন? বাদলের মুখ আবার কাকের গাত্রবর্ন ধারন করল। বাদল এবার পেছনে ঘুরে হাটা শুরু করেছে । হিমু আবার জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে বাদল তোর? বাদল জোরে বলল, তুমি আর মহাপুরুষ হতে পারবে না ।
- আমি কবে মহাপুরুষ হতে চেয়েছি?
- তোমার বিকৃত মতিষ্কের বাবা তো চেয়েছিল । সেই ইচ্ছাও পূরন হবে না।
হিমু বাদলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল, কিছুক্ষণ । তারপর আবার হাটা শুরু করল । মেসে পৌছতেই হিমু আরও অবাক হল । মেসের দরজা খোলা । মেস মালিক বা মেসের আর লোকজন কে দেখা যাচ্ছেনা । হিমু তার কক্ষে প্রবেশ করল । তার কক্ষের জানালা -দরজা খোলাই । সে তার খাটে বসল কিছুক্ষণ । তারপর বাথরুমের দিকে পা বাড়াল । কিন্তু এ কি ?
আজ যে কোন ভীড় নেই । মহাপুরুষ হবার পথের অন্যতম একটা অন্তরায় বাথরুম করা । এ সমস্যা থেকে আজ হিমু মুক্তি পেল । মিছির আলি কি তাহলে এটারই ইংগিত দিয়েছিলেন, মনে মনে ভাবল হিমু । সে একটু হেসে নিল । আর মনে মনে ভাবল, মিছির আলি যদি তাকে তখন বলতেন , “হিমু সাহেব , আপনি আজ আপনার ‘হাগু সমস্যা’ থেকে নিস্তার পেতে চলেছেন ।’’
তাহলে হিমু ওখানেই হেসে গড়াগড়ি খেত । ভাগ্যিস! বলেন নি কিছু ।
হিমু তার বাথরুম পর্ব শেষে আবার তার কক্ষে প্রবেশ করল। কক্ষে কে জানি চা রেখে গেছে দুই কাপ । কিন্তু মেসে তো কাউকে সে দেখিনি , তাহলে কে রাখল এই চা এখানে? আর দু’কাপ চা-ই বা কেন রাখতে গেল?
সে কি আমার সাথে বসে চা পান করবে আর কিছুক্ষণ গল্প করে সময় নষ্ট করবে? হিমু তার ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে , একটা চায়ের কাপ হাতে তুলে নিল । কয়েক চুমুকেই প্রথম কাপটা শেষ করে ফেলল সে। আশেপাশে তাকাল এবার সে । কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না সে। পরের কাপটাও কয়েক চুমুকে শেষ করে দিল সে। একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করল তার । কিন্তু না । হিমু রুপার দেয়া কাশ্মীরি শালটা খুজতে লাগল । কি আজব, শালটাও এখন ধবধবে সাদা । হিমুর মনে হতে লাগল , তার চোখে কোন সমস্যা হয়েছে । সে শালটা গায়ে দিয়েই বের হয়ে পড়ল । এখন সে রুপার বাসার দিকে যাবে। কিন্তু রুপাকে পাওয়া যাবে তো । আজ হিমুর খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তাকে । রুপার বান্ধবী নীরা-কে ফোন দিলে কেমন হয় ? কিন্তু হাতে তো টাকা পয়সাও নেই আর না আছে ওর বান্ধবীর নাম্বার । বাসেও ওঠা যাবে না । টাকা নেই যে । পা, টাও ব্যথা করছে হিমুর ।ক্ষত দিয়ে হালকা রক্তও বের হচ্ছে । ফুটপাতের পাশে একটা ফুসকার দোকান আর একটা লেবুর রসের ছোট খাট অস্থায়ী দোকান দেখা যাচ্ছে । ওখানে গিয়ে একটা চেয়ারে বসল হিমু । তারপাশেই একজন সাদা কাপড়ে বসে আছে । চোখে চশমা । বয়স ষাট- তেষট্টির কাছাকাছি । হিমুর লোকটিকে পরিচিত মনে হতে লাগল । লোকটি তার দিকে তাকাল । মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যপার হিমু সাহেব ? আপনাকে ক্লান্ত লাগছে । অনেক হাটাহাটি করেছেন বুঝি? কি রুপাকে খুজতে যাচ্ছেন? ও তো বাসায় নেই ?”
- আপনি কি করে জানেন এত সব?( কৌতূহলী হিমুর মুখ) ।
- লোকটি আবারও মৃদু হাসল। এবার বলল “আমার মাথায় যদি এসব না আসত । তাহলে আপনার মাথায়ই বা কি করে আসবে বলুন?”
- কে আপনি ? আমি কি পূর্ব পরিচিত আপনার?
- হিমু সাহেব । আপনি আমাকে চিনবেন না । কিন্তু আমার কারনেই আপনি আজ হিমু ।
- কি সব বলছেন ? পরিষ্কার হচ্ছেনা, আপনার পরিচয় দিন?
- হিমু সাহেব। অস্থির হবেন না । আপনি সারাদিন আজ ভ্রমের মধ্যে আছেন । আমার ক্ষমতা থাকলে আপনাকে লেবুর রস পান করাতাম । কিন্তু আমি তা পারবনা । আর আপনিও লেবুর রস পান করতে পারবেন না ।
- কেন বলুন তো। আমি তো চা পান করেই বের হয়েছি ।
- ঐ যে বললাম, আপনি ভ্রমের মধ্যে আছেন । আপনি পুরো মেসে একা ছিলেন । আপনি মনে মনে মিছির আলির মুখে , “হাগু সমস্যার” কথা শুনে হাসাহাসি করলেন । আবার অদৃশ্য চা ও পান করলেন । কারন হচ্ছে , আমি করিয়েছি, আমিই আপনাকে হাটতে বলেছি খালি পায়ে , আমিই আপনাকে বাদল,রুনা,রুপা,শুভ্র আরও অনেক চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়েছি । আর আমিই দায়ী আপনাকে এভাবে রেখে যাওয়ার জন্য । আপনার পাজ্ঞাবীর রঙ সাদা করার জন্য ।
- কি বলছেন এসব?
- ঠিকই বলছি । আমি যদি মারা না যেতাম । আপনি পকেটছাড়া আরও হলুদ পাজ্ঞাবী পরে অনেক জায়গা ঘুরতে পারতেন । ঢাকা শহরের অচেনা আরও গলিতে যেতে পারতেন । কিন্তু তা আর সম্ভব না । আমি প্রবাসে মারা গেছি আর সাদা কাফনে দাফন হয়েছি , আমার বাগান বাড়ি “নুহাশ পল্লীতে” । সময় পেলে যাবেন একবার ।
- হিমু হতবাক হয়ে চেয়ে রইল , লোকটির দিকে । লোকটির মধ্যে লজিক আর এন্টি লজিক দুটোই খুব ভাল কাজ করে ।
- হিমু সাহেব , আমিই মিছির আলি আর আমিই হিমু । আপনারা সবাই আমার কল্পিত চরিত্র । আপনি রুপার কাছে যান । সে পার্কে আছে । কোন এক গাছের নিচে একা বসে । আর সে আজও আপনাকে তার হাত ধরতে বলবে । কিন্তু আপনি হিমু , মায়ায় জড়ানো আপনার চরিত্রে আমি রাখিনি! যান এবার । আর হ্যা একটা কথা মনে রাখবেন, “এ জগতের সবচেয়ে সুখি হচ্ছে সে,যে কিছুই জানে না৷ জগতের প্যাচ বেশী বুঝলেই জীবন জটিল হয়ে যায়৷”
হিমু আজ একটু গম্ভীর হয়ে গেল । তার রসে পূর্ন মনোভাব আর মুখের হাসি দুটোই কোথায় যেন হারিয়ে গেল । পার্কে ঢুকতেই একটা ছোট মেয়ে , তার ফুল বেচার জন্য হিমুর দিকে দৌড়ে আসল । হিমু মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বলল, টাকা নেই তার কাছে । মেয়েটি হাসিমুখে তাকে একটি গোলাপ ফুল ধরিয়ে চলে গেল । হিমু পার্কে অনেক কপোত-কপোতী দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু তার রুপাকে কোথায় খুজবে সে ? ঐ লোকটি বলেছিল , কোন গাছের নিচে বসে থাকবে সে । একটু ভেতরে ঢুকতেই হিমু দেখল, এক বড় গাছের নিচে তার রুপা বসে আসে । রুপাও উজ্জল সাদা শাড়ী পরে আছে । হিমু সামনে গিয়ে দাড়াল । তার হাতের গোলাপটা এগিয়ে দিল , রুপার দিকে । রুপা হাসল । হিমু এই হসির অর্থ জানে না । রুপা হয়ত কষ্ট পাচ্ছে বা তার দেয়া কাশ্মীরি শালটা পরেছি বলে আনন্দ পাচ্ছে । রুপা হিমুকে তার পাশে বসতে বলল। হিমু শান্ত ছেলের মত বসল । রুপা হিমুর কাধে মাথা রেখে হিমুকে বলল, অনেক তো হল । এবার তো থাম । তোমার অন্ধভক্ত বাদলও তো বলেছে , তুমি মহাপুরুষ হতে পারবেনা । আর তোমার ইচ্ছা তো হিমু হবার । চল আমরা বিয়ে করে নেই । তারপর তোমার সাথে রাত করে আমিও হাটতে বের হব । তার কয়েকবছর পর ছোট হিমুও হাটতে বের হবে । শুভ্র-র মত । হিমু জিজ্ঞেস করল, শুভ্রকে চেন তুমি? কোথায় দেখা হল ?
রুপা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, আমাকেই বা কি করে চেন তুমি ? সবই তো ভ্রম । আরেকজনের কল্পনা নিয়ে আমাদের বেচে থাকা । তারা আমাদের এখানে বসিয়েছে তাই-ই বসেছি । তারা তোমার হাতে ফুল দিয়েছে । তাই তো তুমি ফুল পেয়েছ ।
-কি বলছ এসব রুপা?
- ঠিকই বলছি। আমি একটু পর যখন আমার হাতটা ধরতে বলব । তখনই তুমি আরেকজনের কল্পনার অধীনে চলে যাবে । আমি জানি আমি তোমাকে পাব না । তোমাকে কেন , আমি আর কিছু চাইতেও পারব না । আমার চরিত্র শুধু তোমার জন্য অপেক্ষা করা । তোমাকে আমার ভালবাসা বোঝানো । আমি যেমন মুক্তি পাব না , তুমিও পাবে না ! আমি তোমাকে আমার মায়ায় জড়াতে চাই আর তুমি চাও মায়া থেকে মুক্ত হতে । জানি এতে তোমার কোন হাত নেই । কিন্তু তোমার স্রষ্টা তোমাকে এমন জীবনই বেছে দিয়েছে । তুমি শুধু কল্পনাতেই থাকবে । তবুও বলি , আমার হাতটা ধর,হিমু ...!!
হিমু উঠে দাড়াল । তার চোখের কোণে জল । সে খুব হাসার চেষ্টা করল । কিন্তু হাসলনা । পেছন থেকে রুপা বলল, আমাকে আবার হারিয়ে ফেলতে চাও,খুজে না পাও যদি আর, হিমু…!!!
হিমু একটু সজোরে বলল, আমার হারিয়ে ফেলার কেউ নেই, কাজেই খুঁজে পাওয়ারও কেউ নেই।আমি মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলি, আবার খুঁজে পাই। হিমু হনহন করে হাটতে লাগল । ঐ লোকটির সাথে তার দেখা করা দরকার । হিমুর অনেক প্রশ্ন আছে , তার কাছে!!!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৩৫