গল্পের নামটি পড়ে কি অবাক হচ্ছেন? কি ভাবছেন, বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলব? নাহ, ব্যক্তিগতভাবে আমি বর্ণবাদে বিশ্বাস করিনা। আমার কাছে মানুষের পরিচয় মানুষই। আমি তাদেরকে গোষ্ঠীতে বিভক্ত করতে পারিনা বা মাসিক আয় দেখে মানুষকে শ্রেণীতে বিভক্ত করিনা।
বিবাহযোগ্য যেকোন ছেলের পরিবারের অনেক চাহিদার মধ্যে একটা চাহিদা হচ্ছে , মেয়ের গায়ের রং ফর্সা হতে হবে। ধরুন, কোন ছেলে একটা কালো মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে আর সেটা তার বন্ধুমহলে বা তার দাদা/দাদী বা নানা/নানীর সাথে শেয়ার করেছে । তখন তারা একটা কথা বলে এরকম, বিয়ের আগে এসব মেয়ে ঠিক আছে কিন্তু দাদুভাই আমার কিন্তু লাল টুকটুকে বৌমা চাই বা কিছুদিন সম্পর্ক চালিয়ে যা! কিন্তু বন্ধু, মেয়েটাকে তোর সাথে মানাচ্ছেনা! আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারী চাকুরীজীবী ছেলের বউ তো সাদা হতেই হবে।
এতটুকু পড়ে আপনার মনেই হতে পারে যে আমি বোধ হয় গায়ের রং কালো মেয়েদের পছন্দ করি বা তাদেরকে উৎসর্গ করে এই লেখা । আসলে নাহ, আমিও বিয়ে করলে ফর্সা মেয়েকেই করব ,কালো মেয়ে বাদ দিব।
কি লাইনটা পড়ে খারাপ লাগছে ? খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। চলেন এবার কিছু ঘটনা শেয়ার করি তাহলে আমার এই সিদ্ধান্ত ন্যায়সংগত কিনা সেটা বোঝা যাবে।
ঘটনা ১ -
এক কর্পোরেট অফিসে রিসিপশনিস্ট পদে একজন মেয়েকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার সাথে যারা ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছিল, তাদের মধ্যে একজনের আগে রিসিপশনিস্ট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল, আরেকজন বোরকা পরে, আরেকজনের গায়ের রঙ শ্যামলা আর আরেকজনের গায়ের রঙ কালো । এবং এদের কমবেশী সবার অভিজ্ঞতা ছিল আর চাকুরীর বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল , পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে এমন প্রার্থিকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। কিন্তু যাকে নেয়া হয়েছে তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তাহলে চাকরী পেল কিভাবে? মেয়েটি অন্ত্যন্ত ফর্সা , ঠোটে লাল লিপস্টিক , পরনে ছিল স্বচ্ছ জামা আর টাইট ফিটিংস একটা জিনস। আর নিয়োগকর্তা হিসাবে ছিলেন একজন পুরুষ। এর মানে ফর্সা মেয়ের যোগ্যতা না থাকলেও চলে। রাগানিত্ব হবেন না , আপনার মনে হতেই পারে আমি ফর্সা মেয়ের হয়ত অনান্য দিকে যোগ্যতা ভাল বা কমিনিকেশন দক্ষতা ভাল । কিন্তু নাহ এমন কিছুই না। হ্যাঁ , এটা আপনি বলতে পারেন নিয়োগকর্তা মেয়েটার রূপ দেখে দূর্বল হয়ে গেছে। আচ্ছা মেনে নিলাম,এই পদটাই এমন । এখানে সুন্দরী মেয়েই লাগবে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই নিয়মটা কে বানালো?
ঘটনা ২ -
মিস ফারহানা । তার ছোটখাটো একটা এজেন্সি আছে। এই এজেন্সির কাজ হচ্ছে বিদেশ থেকে আগত ব্যাক্তিদের থাকার জন্যে হোটেল খুঁজে দেয়া, তাদের ভ্রমণের জন্যে গাড়ীর ব্যবস্থা করা আর তাদের ট্রাভেল গাইড হিসাবে তাদের সাথে থাকা। তার এজেন্সিতে ১২ জন মেয়ে স্টাফ কাজ করে। তার মধ্যে সবথেকে বাজে পারফরমেন্স হচ্ছে তানিয়ার। তানিয়া দেখতে অনেক সুন্দরী, ভদ্র, হিজাব পরে কিন্তু ইংলিশ কমিউনিকেশনে একটু প্রব্লেম আছে । তো একবার অস্ট্রিয়া থেকে দুজন ছেলে ঘুরতে এসেছে বাংলাদেশে। তাদের গাইড হিসাবে তানিয়াকে দেয়া হল । সব ঠিকঠাকই ছিল কিন্তু তারা চলে যাবার পর তানিয়াকে কোম্পানি থেকে বের করে দেয়া হল। কারণ, তানিয়া মিস ফারহানার কথা রাখতে পারেনি সেজন্য। অস্ট্রিয়া থেকে আগত দুজন ছেলে তানিয়াকে এক রাতের জন্যে তাদের বিছানায় চেয়েছিল। আর সেটার জন্যে মিস ফারহানা মোটা অংকের টাকা নিয়েছিল। তিনি তানিয়াকে অর্থের লোভ আর প্রমোশন এর অফার করেছিল। কিন্তু তানিয়া রাজি হয়নি। কি বুঝলেন , সুন্দরী মেয়ের সৌন্দর্য্যও মাঝে মাঝে অভিশাপ হয়ে দাড়ায়। হ্যাঁ , তানিয়া তার আত্মসম্মান বাঁচিয়েছে এটা হয়ত আপনার কাছে প্রশংসার যোগ্য কিন্তু চাকরি হারিয়ে সে কত বড় বিপদে পড়েছে সেটা হয়ত আপনার মাথায় আসবেনা!
ঘটনা ৩ -
ফাহিম ছোট খাটো একটা কোম্পানিতে সেলসম্যান হিসাবে কাজ করে। মাসে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা ইনকাম করে। অফিসের বস ফাহিমের কাজে অনেক খুশি। ফাহিম খুব তাড়াতাড়ি মিষ্টিকথায় ক্লায়েন্টস পটাতে পারে। দেখতে সুন্দর , ফর্সা আর লম্বা। কিন্তু বেশিদূর লেখা পড়া করতে পারেনি , বাবা মারা যাবার পর । এইতো কিছুদিন আগেই তার বাচ্চা হল । সব ঠিকঠাকই ছিল। বউয়ের প্রেগ্ন্যান্সির সময় ফাহিমের পরিচয় হয় রাইসার সাথে। রাইসা সাউথ আফ্রিকা থাকে । বর্ণবাদের জন্য মোটামুটি বিখ্যাত দেশটি। রাইসা দেখতে অনেক সুন্দরী। বিদেশী, সাদা চামড়া। এদিকে ফাহিমের বউয়ের গায়ের রঙ গাঢ় শ্যামলা, দেখতে সুন্দরী না হলেও ফাহিমকে নিয়েই তার ধ্যান-জ্ঞান । গায়ের রঙের জন্য ফাহিমও তার বউকে পছন্দ করেনা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলে। শুধু ভাল অংকের যৌতুকের টাকার জন্যে বিয়েটা করা। প্রেগ্ন্যান্সির সময় ফাহিম তার বউকে বাপের বাড়ী দিয়ে আসে। আর এদিকে ভিডিও কলে রাইসার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে । রাইসাকে বিয়ে করে পাচ বছর সংসার করলে নাকি সাউথ আফ্রিকায় পার্মানেন্ট ভাবে থাকা যাবে।
ফাহিমের একটা বাচ্চা হয়েছে এখন । বয়স মাত্র আট মাস । ফাহিমের স্ত্রী , ফাহিমের ছবি নিয়ে পুলিশ স্টেশনে বসে আছে। ফাহিম নিখোঁজ ! এতটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে সে সাউথ আফ্রিকা গিয়েছে। পুলিশের ভাষ্যমতে , সে সেখানের কোন এক সুপার শপে সেলস ম্যানের কাজ নিয়েছিল। কিন্তু সেখানের কোন এক লোকাল গ্যাং টাকা ছিনতাই এর সময় ফাহিমকে গুলি করেছে। ভেরিফিকেশন এর জন্যে তার স্ত্রীকে থানায় ডাকা হয়েছে!
ঘটনা ৪ -
আল্ট্রাসোনাগ্রাফী এর পর সায়মা জানতে পারল তার ছেলে হচ্ছেনা । বাসায় এসে অনেক কান্না ! সায়মার স্বামী ব্যাপারটা বুঝতে পারছেনা । কারণ তার ফ্যামিলি থেকে ছেলে হওয়া লাগবে এমন কোন আবদার করেনি। সায়মাকে তার স্বামী বিষয়টা জিজ্ঞেস করাতে সায়মা বলল, মেয়ে হলে অনেক সমস্যা । অনেক খেয়াল রাখতে হবে তার । নাহলে যে কেউ যৌন হয়রানি করবে । বলে রাখা ভালো, সায়মা যখন ক্লাস এইটে পড়ে তার আপন খালুর হাতে সে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল।
সায়মার স্বামী তাকে বলল, এটার কি নিশ্চয়তা আছে তোমার ছেলে অন্য মেয়েকে হয়রানি করবেনা? সায়মা প্রতিত্তুরে বলল, আমার ছেলে ধর্ষণ করুক তাতে ওর তো আর কিছু হবেনা। কিন্তু মেয়ে হলে তাকে কে বিয়ে করবে? সায়মার স্বামী হতবাক হয়ে গেল এই উত্তর শুনে।
কয়েক মাস পরে আবার সায়মা কান্না করতে লাগল । এবারও তার স্বামী তার কান্নার কারণ জানতে চাইলে সে বলল , তোমার গায়ের রঙ তো শ্যামলা , একে তো মেয়ে তার ওপর যদি গায়ের রঙ তোমার মত হয় তাহলে তো তার বিয়ে দিতে সমস্যা হবে। আমরা কি এই বাচ্চাটাকে অপারেশন করে ফেলে দিতে পারিনা? যে প্রাণ পৃথিবীর আলো দেখেনি তাকেই মেরে ফেলতে চাই নিজের মা!
শুনেছি সায়মার নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে । তার স্বামী তার মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে !
অনেক গুলো ঘটনাই পড়লেন। এবার আসি আমি কেন সাদা মেয়ে বিয়ে করব তার প্রসঙ্গে । আমার এক ফ্রেন্ড ছিল যার উচ্চতা ছিল চার ফুট দুই ইঞ্চি আর গায়ের রঙ ছিল কালো। সে অর্ডার দিয়ে জুতার সোল উঁচু করে বানাত। কিন্তু বেশি গেলে তার উচ্চতা চার ফুট চার ইঞ্চি গিয়েই ঠেকত। তার একটা ইচ্ছা ছিল যত যাই হয়ে যাক আমি অনেক লম্বা আর সাদা মেয়ে বিয়ে করব। এর কারণ জানতে চাইলে সে বলত , তাদের যেই বাচ্চা হবে সে যেন তার মত উপহাসের পাত্র না হয়। সে যেন একটা ভাল সুস্থ জীবন পায় । তাকে যেন মাথা নিচু করে চলতে না হয়। বন্ধু এখন আমেরিকায় তার বউয়ের উচ্চতা ছয় ফিট ২ ইঞ্চি । দুজনকে পাশাপাশি প্রথম দেখে হাসি থামাতে পারিনি আমি।
নাহ ! আমার ইন্সপিরেশন আমার বন্ধু না । আর আমি বিয়েও করতে চাইনা । একাকী জীবন অনেক সুখের আমার মতে । জৈবিক চাহিদার জন্যে সাদা মেয়ে বিয়ে করার কোন মানে হয় না । আসলে কে এই বিভাজন সৃষ্টি করেছে সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু এটা নিউক্লিয়ার ব্রিক্রিয়ার মত যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। নারী এখন পণ্য । কাল থেকে সাদা হবার জন্যে ক্রিম, ফিগার ঠিক ঠাক করার জন্যে মেডিসিন। কালো গায়ের রঙ তাতে কি? ছোট জামা , ব্রা স্ট্রাপ বের করে রেখে , স্বচ্ছ / মশারির কাপড় পরে নিজেকে আকর্ষনীয় করে তোলা তো যায়ই। সবকিছুতেই একটা কৃত্রিম কৃত্রিম ভাব। এখন আর কেউ ভাল মনের মানুষ খুজেনা । সবাই লেনদেন নিয়ে ব্যস্ত। মেয়ের চাহিদা টাকা আর ছেলের চাহিদা শরীর। এই ব্যস্তবতা মেনে নিতে হবে যদি বিয়ে করতে চান! হয় আপনি আরেকজনের ছেড়ে দেয়া ভালবাসার মানুষকে গ্রহণ করবেন অথবা আপনার ভালবাসার মানুষকে অন্যের জন্য ছেড়ে দেবেন। আর এই প্রক্রিয়ার মাঝে নষ্ট হচ্ছে ভালোবাসার পবিত্রতা! হয়ত মানুষকে মানুষ ভাবলে এই বর্ণবাদের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারবেন। পৃথিবীর সময় তো ফুরিয়ে আসছে , কি মনে হয় যুগ যুগ ধরে যেই নিয়ম চলে আসছে পৃথিবী ধ্বংসের আগে সেটা পরিবর্তন হবে?
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১:২৭