রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৮৬১–১৯০১)
(উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে)
শুভম পাল
কিশোর রবীন্দ্রনাথ, ১৮৭৭; গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত
বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও ব্রাহ্ম দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের প্রথম চারটি দশক (১৮৬১–১৯০১) ছিল তাঁর শৈল্পিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শের বিকাশপর্ব।সূচিপত্র [আড়ালে রাখো]
১ পারিবারিক প্রেক্ষাপট
২ শৈশব ও কৈশোর (১৮৬১–১৮৭৮)
৩ ইংল্যান্ডে শিক্ষা (১৮৭৮–১৮৮০)
৪ শিলাইদহ
৫ পাদটীকা
৬ তথ্যসূত্র
পারিবারিক প্রেক্ষাপট
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম জোড়াসাঁকোর ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের পারিবারিক বাসভবনে। জোড়াসাঁকো ছিল সেযুগে “ব্ল্যাক টাউন” (বাঙালি অধ্যুষিত নগরাঞ্চল; ইউরোপীয়দের আবাসস্থল দক্ষিণ কলকাতা ছিল “হোয়াইট টাউন”) নামে পরিচিত উত্তর কলকাতার চিৎপুর রোডের (বর্তমান নাম রবীন্দ্র সরণি) নিকটে।[১] জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আশেপাশের অঞ্চলগুলি সেই সময় ছিল দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল এবং শহরের দেহব্যবসার একটি কেন্দ্র।[২][৩] রবীন্দ্রনাথের পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫) এবং মাতার নাম সারদা দেবী (১৮৩০–১৮৭৫)। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর বন্ধু তথা সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের প্রধান সংগঠক ও অনুশাসনকর্তা। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন ব্রাহ্মসমাজের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর অনুগামীরা তাঁকে মহর্ষি অভিধায় ভূষিত করে।[৪] আমৃত্যু দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতা।[৫] অস্পৃশ্যতা প্রথার কারণে কেবল মাত্র পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর-খুলনার পিরালী ব্রাহ্মণ কন্যারাই ঠাকুর পরিবারে বধূ হয়ে আসতেন।[৩]
[সম্পাদনা]
শৈশব ও কৈশোর (১৮৬১–১৮৭৮)
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পিতামাতার চোদ্দো সন্তানের মধ্যে কণিষ্ঠতম। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য পত্রিকা, সংগীত ও নাট্যানুষ্ঠানের এক পরিবেশে প্রতিপালিত হন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল সেযুগের বিদ্যোৎসাহী ও শিল্পোৎসাহী সমাজে এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সম্মানীয় দার্শনিক ও কবি। তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সেযুগের অভিজাত ও শ্বেতাঙ্গ-প্রধান ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের প্রথম ভারতীয় সদস্য। নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন একজন প্রতিভাবান সংগীতস্রষ্টা ও নাট্যকার।. [৬] তাঁর এক দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন এক স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। বালক "রবি"-র উপর এঁদের সকলের প্রভাব ছিল অপরিসীম। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে সামান্য বড়ো। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয় এবং তাঁর রচনার এক অনুপ্রেরণা। ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু বহু বছর রবীন্দ্রনাথের মনকে অশান্ত করে রেখেছিল। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও এই মৃত্যু এই চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়।
জীবনের প্রথম দশ বছরে পিতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাননি রবীন্দ্রনাথ। এই সময় দেবেন্দ্রনাথ প্রায়শই উত্তর ভারত, ইংল্যান্ড ও অন্যান্য স্থানে পর্যটনে রত থাকতেন।[৭][৮] এদিকে রবীন্দ্রনাথ মূলত পারিবারিক গণ্ডীর আবদ্ধ থাকতেন। একমাত্র স্কুলে যাওয়া ছাড়া অন্য সময় বাড়ির বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ফলত বাইরের জগৎ ও প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন বালক রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির ভৌতিক ও রহস্যময় সত্ত্বাটিও রবীন্দ্রনাথকে সন্ত্রস্ত করে রাখত। জীবনের এই পর্বে বাড়ির ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর নিজের ভাষায় এ ছিল এক "ভৃত্যরাজক তন্ত্র"।[৯] জানা যায়, এক এক সময় ছোটোদের শান্ত করতে ভৃত্যেরা তাদের মাথা পানীয় জলের বড়ো বড়ো পাত্রের মধ্যে চুবিয়ে রাখত।[১০] ভৃত্যদের সন্তুষ্ট রাখতে বালক রবীন্দ্রনাথ অল্প আহার করতেন। শ্যাম নামের একটি চাকর তাঁকে একটি খড়ির রেখার গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে রাখত আর ভয় দেখানোর জন্য রামায়ণের সীতাহরণের উপাখ্যান এবং রক্তপিপাসু ডাকাতদের ভীতিপ্রদ গল্পগুলি শোনাতো।[১১]
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আরম্ভ হয় দাদা হেমেন্দ্রনাথের হাতে। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ শারীরিকভাবে সুস্থসবল ও বলবান ছিলেন – তিনি গঙ্গায় সাঁতার কাটতেন, পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে বেড়াতেন এমনকি বাড়িতে জুডো ও কুস্তি অনুশীলন করতেন। বাংলা ভাষায় শারীরস্থান, অঙ্কন, ইংরেজি ভাষা (সেই সময় তাঁর সর্বাপেক্ষা অপ্রিয় বিষয়), ভূগোল, ইতিহাস, সাহিত্য, গণিত ও সংস্কৃত চর্চা করতেন গৃহে ও বিদ্যালয়ে।[১২] অবশ্য বিদ্যালয়ের ধরাবাঁধা শিক্ষাব্যবস্থা তাঁকে আকৃষ্ট করে রাখতে পারেনি। নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাদেমি, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ও শেষে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে কিছুকাল পড়াশোনার পর তিনি অবশেষে বিদ্যালয়ে যেতে অস্বীকার করেন। বিদ্যালয়ের নিষ্প্রাণ শিক্ষাব্যবস্থা পরবর্তীকালেও তাঁর দ্বারা সমালোচিত হয়েছিল।[১৩]
আট বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ কাব্যরচনা শুরু করেন। তাঁর এক দাদা তাঁকে এই কবিতাগুলি বাড়ির অন্য সকলকে পড়ে শোনাতে বলতেন। রবীন্দ্রনাথের এক শ্রোতা ছিলেন জনৈক ব্রাহ্ম জাতীয়তাবাদী, সংবাদপত্র সম্পাদক ও হিন্দুমেলা সংগঠক। এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন দীক্ষানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মণ্য সংস্কার অনুযায়ী মস্তক মুণ্ডন করে উপবীত ধারণ করেন রবীন্দ্রনাথ।[১৪] এরপর ১৮৭৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পিতার সঙ্গে কয়েক মাসের জন্য কলকাতার বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয় রবীন্দ্রনাথের। প্রথমে তাঁরা যান শান্তিনিকেতনের পারিবারিক এস্টেটে। ১৮৬৩ সালে এখানকার আম্রকুঞ্জ ও উদ্যানমধ্যে দেবেন্দ্রনাথ একটি দুই কামরার গৃহ নির্মাণ করেছিলেন।[১৫] প্রকৃতির সান্নিধ্যে এই দিনগুলি সম্পর্কে পরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: [১৬]"যাহা দেখিলাম না তাহার খেদ মিটিতে বিলম্ব হইল না – যাহা দেখিলাম তাহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট হইল। এখানে চাকরদের শাসন ছিল না। প্রান্তরলক্ষ্মী দিক্চক্রবালে একটি মাত্র নীল রেখার গণ্ডী আঁকিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাতে আমার অবাধসঞ্চরণের কোনো ব্যাঘাত করিত না।"[১৭][১৬]
কয়েক সপ্তাহ সেখানে অতিবাহিত করে তাঁরা আসেন অমৃতসরে। সেখানে হরমন্দির সাহিবের নিকট অবস্থান করে তাঁরা একটি শিখ গুরুদ্বারে প্রার্থনা করেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন ইংরেজি ও সংস্কৃত গ্রন্থাবলি, বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের জীবনী, এবং এডওয়ার্ড গিবন রচিত দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার।[১৮] এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সপুত্র দেবেন্দ্রনাথ যাত্রা করেন হিমালয়ের শৈলশহর ডালহৌসির (বর্তমানে হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে জম্মু ও কাশ্মীর-হিমাচল প্রদেশ সীমান্তের নিকটে অবস্থিত) উদ্দেশ্যে। ডালহৌসিতে ২,৩০০ মিটার (৭,৫০০ ফুট) উচ্চতায় বক্রোটা পাহাড়চূড়ার একটি বাংলোতে অবস্থান করেন তাঁরা। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হন রবীন্দ্রনাথ।[১৯] ছেদ পড়ে না পাঠাভ্যাসেও। হিমশীতল অতি প্রত্যুষে উঠে সংস্কৃত পড়তে বসতেন তিনি; দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের ছুটি পেতেন। তারপর আবার চলত পড়া। অবশ্য পড়তে পড়তে প্রায়শই ঘুমিয়ে পড়তেন রবীন্দ্রনাথ।[২০] দুই মাস ডালহৌসিতে কাটিয়ে পিতার সঙ্গে কলকাতায় ফিরে আসেন তিনি।[২১]
ইংল্যান্ডে শিক্ষা (১৮৭৮–১৮৮০)
ইংল্যান্ডে পাঠরত রবীন্দ্রনাথ, ১৮৭৯
১৮৭৮ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে।[২২][২৩] প্রথম দিকে তিনি ব্রাইটন ও হোভের মেদিনা ভিলায় ঠাকুর পরিবারের একটি বাড়িতে অবস্থান করেন। এখানে তিনি একটি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন (যদিও দাবি করা হয় যে তিনি ব্রাইটন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন; কিন্তু উক্ত কলেজের রেজিস্টারে তাঁর নাম পাওয়া যায় না)। ১৮৭৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও কন্যা ইন্দিরাকে তাদের মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে থাকার উদ্দেশ্যে।[২৪] ১৮৭৮ সালে বড়োদিনটি পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কাটানোর পর রবীন্দ্রনাথ দাদার এক বন্ধুর সঙ্গে চলে আসেন লন্ডনে। তাঁর আত্মীয়দের ধারণা ছিল লন্ডনে থাকলেই পড়াশোনায় অধিক মনোযোগ দিতে পারবেন তিনি।[২৩] সেখানে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে ভর্তি হন তিনি। যদিও কোনো ডিগ্রি না নিয়েই এক বছরের মধ্যেই দেশে ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ। তবে এই বিলেতবাসের সময় ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পেয়েছিলেন তিনি, যা পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্য, সংগীত ও নাটকে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। যদিও রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা বা পারিবারিক রক্ষণশীল ধর্মমত কোনোটিকেই নিজের জীবন বা সৃষ্টিকর্মের মধ্যে সাগ্রহে গ্রহণ করেননি; বরং বেছে নিয়েছিলেন এই দুই জগতের কিছু শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতাকেই।[২৫]
শিলাইদহ
স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, ১৮৮৩
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, এখন একটি পর্যটক আকর্ষণ
১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে পারিবারিক জমিদারির তত্ত্বাবধান শুরু করেন। বর্তমানে এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত। ১৮৯৮ সালে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরাও চলে আসেন শিলাইদহে। “জমিদার বাবু” নামে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ[২৬] এই সময় পারিবারিক বিলাসবহুল ঢাকাই বজরা পদ্মা-য় চড়ে সমগ্র জমিদারি তদারকি করে বেড়ান।[২৭] প্রজাবর্গের মধ্যে খাজনা আদায় (মূলত প্রতীকী) ও তাঁদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে তাঁদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করেন রবীন্দ্রনাথ। এই সৌজন্যে গ্রামবাসীরাও তাঁর সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করতেন।[২৮] এই দশকটিতে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন বহু গ্রন্থ এবং বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেন এক নতুন ধারার: ছোটোগল্প।[২৯][৩০] ১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে তিনি ঊনষাটটি ছোটোগল্প লিখেছিলেন। এই সব গল্পের উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছিলেন সাধারণ বাঙালির জীবনের নানা শ্লেষাত্মক উপাদান ও আবেগ থেকে।[৩১] সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬) ও কথা ও কাহিনী কাব্যগ্রন্থগুলি এই সময়েরই রচনা। এছাড়াও একাধিক উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন এই সময়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




