জীবন গিয়াছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার
তখনো যদি দেখা হয় তোমার-আমার
মুখোমুখি আমি আর শৈশব
মাঝখানে ব্যবধান ঊনিশ অথবা কুড়ি অথবা......
অনেকখানি সময়তো চলে গেলো। জীবনানন্দের মহিনের ঘোড়াগুলো আজ প্রস্তর যুগ পেরিয়ে আধুনিকতার বিদায় ঘন্টা বাজাতে বাজাতে আধুনিকতার চৌকাঠে পা রেখেছে। এক রৈখিক চিন্তার বেড়াজাল ছিন্ন করে আমরা এখন বহু রৈখিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছি প্রতি মুহূর্তে। পৃথিবী প্রবেশ করেছে সম্পূর্ণ নতুন, আলাদা, ঐতিহাসিক এক সময়ে যে সময় ধারন করে বহুজাতিক ব্যবস্থা, বিশ্বায়ন, সর্বগ্রাসী পূঁজিবাদ এবং দূরত্ব। এ সময় মানে www., ২৪/৭ বানিজ্য, আকাশ চেঁরা সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি, হাতে হাতে মুঠোফোন, pick n’ mix জীবনাচারণ, আমাদের ঘরের আংগিনায় PEPSI’র ক্যানে এ পাতাবাহার। এই পৃথিবী মানে ক্ষনস্থায়ীত্ব আর অস্থিরতা আর দূর্বোধ্যতা। এখানে ব্রাজিলের আমাজন জংগলের কোন এক প্রজাপতির পাখার ঢেউ আলোড়ন তোলে হংকং এর স্টক এক্সচেঞ্জে অথবা ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ফুটবল কোর্টে।
দুই
খুব বেশীদিন আগের কথা নয়। আমার আকাশ তখনো তেমন করে কালো হয়নি সময়ের নির্মম আঘাতে আজকের মতো। তখন চোখে বর্ষিত হতো দূর ভবিষ্যতের তিমির বিদারী অনুসূর্যের আলো। ঠোঁটে কঠিন পণ তালা আটাঁ। পৃথিবী কে বদলাবার শপথ তখনও ফিকে হয়নি একটুও, কিন্তু ফিকে হতেও সময় নেয়নি। দুঃসহ সেশন জ্যাম, তথাকথিত নেতাদের দৌরত্ব, পত্রিকান্তরে প্রকাশিত মানুষের পাহাড়তূল্য সম্পদের হিসেব, মহামারীর মতো এসিড কিংবা ধর্ষণের বিস্তার- প্রশ্নের জবাব মেলে না। গণতন্ত্রের আড়ালে রাজতন্ত্র। জোট-মহাজোটের সমীকরণ, সংলাপ সংলাপ খেলা, “পার্লামেন্ট আদ্যন্ত শুঁয়োরের খোঁয়াড়” – লেলিনের বাণী মেনে নিয়ে তার অনুসারীদের বিভিন্ন নির্বাচনী জোট সেই সাথে জনসভায় শ্রুতি-প্রতিশ্রুতি-প্রতিজ্ঞার শর্ত বিসর্জন দিয়ে ছিমছাম জনপ্রতিনিধি।
“আমাদের উত্তমর্ণদের কাছে প্রতিজ্ঞার শর্ত চেয়ে তবু
তাহদের খুঁজে পাই ছিমছাম কুনুইয়ের ভারে
বসে আছে দূর বিসারিত সব ক্ষমতার লোভে”
- সাতটি তারার তিমির, জীবনানন্দ দাশ
তিন
স্বাধীনতার ৩৭ বছর পেরিয়ে গেছে। ইতিহাস বদলেছে বোধহয় তার চেয়ে বেশী।জন্মের পাপ মোচন হয়নি আজ অবধি। দীর্ঘ সময় ধরে নিক্রিয় সেক্টর কমান্ডার আজ সক্রিয়। বাধা আসছে পদে পদে। বায়তুল মোকাররমের সামনে কখনো জরুরী আইন ভঙ্গ হয়না। এ যেন বাংলাদেশের হাইড পার্ক। আছে কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী। ধর্ম-অর্থ-কামকুশীলব কিংবা এসব থেকে অলীক আসন্ন জিহাদ দেখিয়ে, নির্বাচনী ফসল ফলিয়ে নিজেরা ক্ষুধার্ত পংগপালের মতো আত্মসাত করছে আলো-অন্ন-আকাশ-নারীকে। এদের হাতে অমানবিক তলোয়ার, ঘোরাচ্ছে সর্বত্র। জনগণ বস্তুত চোখে সর্ষেজ্যফুল দেখছে। প্রেম ও যুদ্ধ যেমন সময়কালে অনৈতিক এরা ততোধিক অনৈতিক। এরা কখনো এই শিবিরেএই শতাব্ণ গালে চুমুা খায়, কখোনো অন্য দলের সঙ্গে তলে তলে শরীক হয়ে নিজেদেরও আখের গোছায়। এরা সেই সব শেয়ালের মতো যারা জন্ম জন্মান্তরের শিকারের তরে দিনের বিস্মৃত আলো নিভে গেলে পাহাড়ে, বনের ভিতরে প্রবেশ করে।
“মানুষ এখন বিশৃংখল।
দিনের আলোর দিকে তাকালেই দেখা যায় লোক
কেবলি আহত হয়ে মৃত হয়ে স্তব্ধ হয়;
এছাড়া নির্মল কোন জননীতি নেই
যে মানুষ-সেই দেশে টিকে থাকে সেই
ব্যক্তি হয়-রাজ্য গড়ে-সাম্রাজের মতো ভুমা/চায়। এছাড়া অমল কোনো রাজনীতি পেতে হলে/তবে উজ্জল সময় স্রোতে চলে যেতে হয়।/সেই স্রোত আজো/এই শতাব্দির তরে নয়”
-সাতটি তারার তিমির,জীবনানন্দ দাশ
চারদিকে চলছে সংস্কার। জন্ম জন্মান্তরের পাপ ধুয়ে ফেলবার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন কীটনাশনক। কিন্তু ভুলে যাওয়া হচ্ছে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। চিরুণী অভিযানে অনেকেই আজ জেলে। আনেক সংস্কারবাদির ভাগ্যেও শিঁকে ছিড়েনি। কালো টাকা, ঘুষ আর চাঁদাবাজির অভিযোগে অনেক ব্যবসায়ী হয় পলাতক না হয় জেলে। হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান অনিশ্চিত। এদিকে চালের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এ যেন শুদ্ধিকরণের মহা উতসব। কিন্তু যখন বলি “Who will guard the guards?”তখন বলা হয় “Shut Up”
“আলো অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়,-কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়,- শান্তি নয়, - ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে বোধ জন্ম লয়!
আমি তাকে পারিনা এড়াতে”
-ধূসর পান্ডুলিপি, জীবনানন্দ দাশ
শেষ
মানুষ হিসেবে আশাবাদী হওয়াটা ইদানিংকালে মনেহয় বোকামির পর্যায়ে পড়ে। আশেপাশে কালিগোলা অন্ধকার। “বহুকাল কেটে গেছে বহুতর স্লোগানের পাপে”, কিন্তু আমাদের বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘতর হয়েছে শুধু। আমাদের অধিকাংশের জীবন “মৃত মৃগদের মতো”। দেশটাকে জীবনানন্দের মতো জীবন মৃত্যুর ভেদরেখা মুছে দেয়া এক “মায়াবী পারের দেশ” বলে মনে হয়না আর। বরং তার-ই মতো মনে হয় –
“রক্তে রক্তে ভরে আছে মানুষের মন
রোম নষ্ট হয়ে গেছে...গেছে ব্যবিলন
পৃথিবীর সব গল্প কীটের মতন
একদিন ভেঙ্গে যাবেঃ হয়ে যাবে ধূলো আর ছাই”
-রূপসী বাংলা, জীবনানন্দ দাশ
তবুওতো মানুষ বেচেঁ থাকে। চালের দীর্ঘ সারির মাঝেও দাঁড়িয়েও মানুষ খোঁজে স্বপ্নের দেশ। প্রান্তিক মানুষও একদিন মাথা তুলে দাড়াঁতে চায়। দিগন্তের কাছে। বোকামি জেনেও আশায় বুক বাঁধে। আশ্রয় খোঁজে সেই জীবনানন্দের কাছেই-
“আমি তবু বলিঃ
এখন যে কটা দিন বেচেঁ আছি সূর্যে সূর্যে চলি
দেখা যাক পৃথিবীর ঘাস
সৃষ্টির বিষের বিন্দু আর
নিষ্পেষিত মানুষ্য তার
আধারেঁর থেকে আনে কি করে, যে মহা নীলাকাশ
ভাবা যাক-ভাবা যাক
ইতিহাস খুড়ঁলেই রাশি রাশি দুঃখের খনি
ভেদ করে শোনা যায় শুশ্রূষার মতো শত শত
শত জল ঝর্নার ধ্বনি।”
-বেলা অবেলা কালবেলা, জীবনানন্দ দাশ
২০০৮ সাল

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




