হাতিরপুল কাঁচা-বাজার থেকে একটু উত্তরে, মোতালিব প্লাজার নিচে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরালো ফখরুদ্দিন। রাত বেশি হয়নি, তবু কারফিউ চলার কারনে দোকানপাট সব বন্ধ। রাস্তায় কোন যানবাহন যেমন নেই, তেমনি ফুটপাথেও কোন লোক চলাচল করছে না। এখন ভাদ্র মাস। এবার গরমের পাশাপাশি ঢাকায় প্রচুর বৃষ্টিও হচ্ছে। শেখ সাহেবকে পাকিস্তানে ধরে নিয়ে যাবার পর থেকে, সারা দেশে প্রচন্ড অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। শেখ সাহেবরে ধরলো সেই মার্চে আর এখন আগষ্ট মাস চলে। এতদিনেও সরকার তারে ছাড়লো না। দেশের মানুষ, ছাত্ররা নাকি পালিয়ে গিয়ে ইন্ডিয়া থেকে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে আসছে প্রতিদিন। তারা এবার মিলিটারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এইসব রাজনীতি সে বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। গতবছর নির্বাচনের পর, পেটের তাগিদে গ্রাম থেকে শহরে আসে ফখরুদ্দিন। তাদের গ্রামের আলতাফ, মগবাজারে এক ফার্নিচারের দোকানে একটা কাজ পাইয়ে দেয়। দোকানের ভ্যান নিয়ে, দোকানের মাল বিভিন্ন বাসা আর কারখানায় পৌঁছে দেবার কাজ। বিভিন্ন হরতাল, বনধ, মিঠিং-মিছিলের সময় যখন অন্য ড্রাইভাররা মাল টানতে সাহস পায়না তখন ফখরুদ্দিন দু’টি পয়সা বেশি পাবার আসায় ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এই কারনে মালিকের প্রিয় হতে তার বেশি সময় লাগেনি। মগবাজার বস্তিতে তার বাসার গলিতে যে গ্যারেজটা আছে, মালিকের পরামর্শে এ বছরের শুরু থেকে ওই গ্যারেজে ভ্যানটা রাখছে সে। তখন থেকে গ্যারেজের ভাড়া মালিকই দিচ্ছেন। আগে দিন শেষে দোকানের পেছনে একটা গ্যারেজে ভ্যানটা রেখে তাকে হেটে বস্তিতে আসতে হতো। এখন বস্তির গ্যারেজে ভ্যান রাখতে রাখতে মাঝে-মধ্যে নিজেকে ভ্যানটার মালিক মনে হয়। এই গন্ডোগোলের মধ্যে দোকান-পাট আর খুলছে না, মালিকও রোজ তার খোঁজ নিচ্ছে না। তাই মাঝে মধ্যে এই ভ্যান দিয়েই কিছু খ্যাপ মেরে বাড়তি টাকা কামানো যাচেছ। মার্চ মাসের হত্যাকান্ডের পর থেকে ঢাকা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। বড়লোক, মধ্যবিত্তের পাশাপাশি দিনমজুর, রিক্সাওয়ালারাও ভেগেছে। আগে রিক্সা ছাড়া অন্য কিছুতে মানুষ চড়তো না। এখন দিনের মধ্যে দু-তিন ঘন্টা কারফু তুলে নিলে যারা ঢাকায় পড়ে আছে, তাদের কাজ সারবার জন্য যা পায় তাতেই চড়ে বসছে। এতে যা পায় তাই লাভ, অল্প দুরত্বে বেশ কিছু টাকা কামাই করা যায়। বাপ ছেলে দু’জনের এতে বেশ ভালোই চলে যাচ্ছে। কিন্তু তার ছেলের বেশ কিছুদিন হলো মন খারাপ। গন্ডগোল শুরুর পর থেকে সে শুধু মা’র কাছে যাবো বলে বায়না করছে। তার মা গ্রামে থাকে। ফখরুদ্দিনের ছেলেটি একটু অপ্রকৃতস্থ, হাবা-গোবা ধরনের। গ্রামের মানুষ বলে, পোলারে জ্বিনে আছর করছে। গেলো চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ে গ্রাম থেকে তার ছেলেকে সে নিয়ে এসেছিলো, পিজিতে বড় ডাক্তার দেখাবে বলে। ডাক্তার দেখানোর পর ছেলেটাকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলো । ইচ্ছে ছিলো চিড়িয়াখানা দেখাবার পর, তাকে গ্রামে রেখে দিয়ে আসবে। কিন্তু তার মধ্যেই কি থেকে যে কি হয়ে গেলো, সেই চিড়িয়াখানা দেখাও হলো না, আর গ্রামে ফেরাও হলো না। ভাবছে, এবারের বর্ষাটা কমলেই গ্রামে চলে যাবে। সারাদিন যেভাবে মিলিটারিরা টহল দেয় আর যেভাবে গুলি চালায় তাতে যেকোনো সময়ে বেঘোরে প্রাণটা চলে যেতে পারে। প্রাণের মায়া বড় মায়া।
হাতের বিড়িটা শেষ করে চারিপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায় ফখরুদ্দিন। সন্ধ্যা থেকে কারফিউ শুরু হওয়ায় রাস্তা-ঘাট এখন পুরোটা ফাঁকা। তাড়াতাড়ি বস্তিতে ফেরা দরকার। ঘরে কোন রান্না-বান্না করা নেই। এখন ফিরে যেয়ে রান্না-করতে একটুও ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া ছেলেটাও দুপুর থেকে ‘মা মা’ করে বেশি ঘ্যান-ঘ্যান করছে। বাইরে কোন একটা হোটেলে ভালো কিছু খেয়ে ঘরে ঢুকে যেতে পারলে ভালো হয়। এতে ফিরোজের মনটাও হয়তো ভালো হবে। কিন্তু এখন খাবার হোটেল কোথায় খোলা পাবে কে জানে!
ফখরুদ্দিন তার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলো,“বাপ, ভূখ লাগছে?- কি খাবি?”
ভ্যানের ওপর বসে থাকা বারো বছরের ফিরোজ গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ে। একটু চুপ থেকে জবাব দেয়,“ভাত আর ডিমের ছালুন।”
আজব পোলা তার। দুনিয়ায় এত রকমের বাহারি খাওন থাকতে, তার পছন্দ ভাত আর ডিমের ছালুন। আপন মনে হেসে ওঠে ফখরুদ্দিন। রাত বাড়ছে দেখে সে ভেবেছিলো পাউরুটি আর কলা কিনে নিয়ে ঘরে ঢুকে যাবে। কিন্তু ফিরোজ ভাত খুব ভালোবাসে। বয়স বারো হলে কি হবে, ফিরোজ গরম ভাত পেলে ফকরুদ্দিনের থেকেও বেশি ভাত খেয়ে ফেলতে পারে। ফিরোজের মা আম্বিয়াও ডিমের ছালুন ভালো রান্দে। ছেলেটার তার মায়ের জন্য পেট পুড়ছে। সারাদিন তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। ভাত খেলে হয়তো ছেলের মন ভালো হতে পারে। মগবাজারে ইস্কাটন গার্ডেনের পিছনে একটা ঘুপচি মতো জায়গায় এক বুড়ি আছে, রাত্তিরেও ভাত বিক্রি করে। ওই বুড়ির কাছে যাওয়া যায়্। বুড়ির ব্যবহার খুব ভালো। এক্সট্রা ভাতের দাম রাখে না, আবার ঝোলও তিন চারবার নেওয়া যায়। ও’খান থেকে খেয়ে ঘরে ঢুকে যাওয়া যাবে। তার বড্ড খিদে পেয়েছে, কিন্তু যেতে হবে ঘুর পথে, মেইন রোড দিয়ে যাওয়া যাবে না। হোটেল কন্টিনেন্টালের সামনে একগাদা মিলিটারি; জীপ, ট্রাক, ট্যাঙ্ক নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। এলাকাটা থমথমে। এখন মিলিটারি দেখলে সাক্ষাত মৃত্যু।
দিনের বেলা যখন কারফিউ থাকেনা, তখনও সে মিলিটারিদের কড়া টহল দিতে দেখেছে। হিন্দু খোঁজার জন্য মিলিটারিরা মাঝে-মধ্যে লুঙ্গি খুলে চেক করে। সাথের বিহারীগুলো আরও খারাপ। হিন্দু হলে, লুঙ্গি-প্যান্ট কেড়ে নিয়ে, ল্যাংটো করে, রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখে। ফখরুদ্দিনের চক্ষের সামনে ঘটেছে এ ঘটনা। এরপর থেকে সে আরও সতর্ক হয়ে গেছে। চার কলেমা আউরে মুখস্ত করে রেখেছে। মিলিটারি ধরলে সে একবারেই পুরোটা বলে দেবে, যাতে ছেলের সামনে লুঙ্গি নিয়ে টানাটানি করে বেইজ্জতি হতে না হয়। ইদানিং ভোরবেলায় মিলিটারিদের রায়ের বাজারের দিকে লাশবাহী ট্রাক নিয়ে যেতে দেখে। এত মানুষ ক্যানো যে মিলিটারিরা মারছে, তার কোন উত্তর নেই তার কাছে। সবাই কি ইন্ডিয়ার চর! অবশ্য সে শুনেছে, এবার জয় বাংলার লোকদের কপালেও দুঃখ আছে। শেখের লোকরা যাতে গদি না পায় তার একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করা হবে। তবে শেখ সাহেব একটা বাপের ব্যাটা। সারা দেশের মানুষের মনে আগুন জ্বালিয়ে ছেড়েছে। এবার এসপার, না হয় ওসপার; কিছু একটা হবেই। যা হবার হোক, তবু এই আতঙ্কের শেষ হোক।
ভ্যান চালাতে চালাতে এসএসএল ওয়্যারলেস গেটের কাছে এসে একটু থমকে দাঁড়ায়। একটু কি বেশি রাত হয়ে গেছে? রাস্তায় কেউ নেই, এমনকি একটা কুকুরও না। ভ্যান থেকে নেমে রাস্তার পাশের ড্রেনে হালকা হতে বসে যায় সে। কারেন্টের খাম্বার আড়ালে কাজ সারতে সারতে খাম্বার গায়ে সাঁটানো একটা সিনেমার পোস্টারের দিকে চোখ যায় তার। ছাত্রদের রাজনৈতিক পোস্টার আর দেয়াল লেখণীর আড়ালে ইদানিং বাকি সবকিছুর বিজ্ঞাপন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সিনেমার নাম ‘নাচের পুতুল’। এ’বছর জানুয়ারীতে ছবিটা সে জনসন রোডের ‘আজাদ’ সিনেমা হলে দেখেছিলো। এর কিছুদিন পরেতো সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেলো। হালকা হয়ে সে আবার ভ্যানে উঠে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে। সিনেমা ফকরুদ্দিনের খুব প্রিয় একটা জিনিস। ‘নাচের পুতুল’ সিনেমায় নায়ক রাজ্জাক আর নায়িকা শবনম কি সুন্দর অভিনয়টাই না করেছিলো! ওই সিনেমায় নায়ক রাজ্জাকের নাম ছিলো ফিরোজ, আশ্চর্যজনকভাবে তার ছেলের নামে নাম। ফখরুদ্দিনের ছেলেটার চেহারাটা সুন্দর, শুধু মাথাটা ঠিক হয়ে গেলে একদিন সেও সিনেমার নায়কের মতো হিরো হয়ে উঠবে। আপন মনে ভ্যান চালাতে চালাতে সেই সিনেমার একটা গান ধরলো,‘ আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন, কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে....’
গানটা গুন গুন করতে করতে কতদুর যে চলে এলো বুঝে ওঠার আগেই, অকস্মাৎ দু’জন লোককে দৌঁড়ে আসতে দেখে ফকরুদ্দিন। শিরদাড়া দিয়ে একটা শীতল পরশ বয়ে যায় তার, যেনো বিপদের আঁচ পেয়েছে সে। কি ঘটতে চলেছে তা জানবার আগেই সে দেখে, মিলিটারির জীপ গাড়ির বহর লোক দুটির পিছনে ধাওয়া করেছে। ফকরুদ্দীন ভ্যান থেকে নেমেই জোরে জোরে কালেমা পড়া শুরু করে দেয়,“লা ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু মুহাম্মাদুর রসূলুল্ল-হ্। আশ্হাদু আল-লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহু-লা-শারীকালাহু ওয়া আশ্হাদু আন্না মুহাম্মাদান আ'বদুহু ওয়া রাসূলুহু।”
ফকরুদ্দীনের চার কালেমা পড়া শেষ হয় না, এর মধ্যেই জীপ থেকে গুলি চলে। গুলির শব্দে তার কালেমা গুলিয়ে যায়। কিছুতেই আর মনে পড়ে না। ফকরুদ্দিনের ছেলে ফিরোজ তখনও ভ্যানের ওপর গম্ভীরভাবে বসে। দৌঁড়াতে থাকা লোক দু’টো ভ্যানটা ক্রস করলে ফকরুদ্দিন লাফ দিয়ে পিছু হঠতে গিয়ে পাশের ড্রেনে পড়ে যায়। ক্রমাগত কয়েকটা গুলি চলে, আর সেই সাথে কিছু মানুষের আর্তনাদ। মনে হয়, কারো শরীরে গুলি লেগেছে। জীপগুলো ভ্যানটা ক্রস করলে ড্রেন থেকে উঠে আসে ফকরুদ্দিন। ভ্যানের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্য তার চোখ স্থির হয়ে যায়। ফিরোজ পেটে হাত দিয়ে রক্ত চেপে ধরে গোঙাচ্ছে। লাফ দিয়ে ফিরোজকে ধরে ফেলে ফখরুদ্দীন।
চিৎকার করে বলে,“বাপজান, কি হইছে তোর।” গুঙিয়ে উঠে ফিরোজ জবাব দেয়,
-“ভূখ লাগছে বাজান, ভাত খামু। প্যাটে ব্যাথা পাইছি বাজান, ভাত খামু।”
ফিরোজের নিথর শরীরটা ফখরুদ্দিন দুহা’তে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে। ঘটনার আকস্মিকতা এখনও তার মাথা থেকে যায়নি। বারবার চিৎকার করে সে ছেলের নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু তার বাপজান আর সাড়া দেয়না। নিস্তব্ধ পরিবেশে তার আর্তনাদ দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে। “ফিরোজ, আব্বা ওঠ, চল ভাত খাই, চল ভাত খাই।”
সেই রাতে ঢাকা শহরের মগবাজার, পুরাতন এলিফ্যান্ট রোড ইত্যাদি এলাকায় একটি বড় অপারেশন হয়। পাকিস্তানী মিলিটারীরা বাংলাদেশের একদল তরুণ সূর্য-সন্তান নিয়ে গঠিত গেরিলা বাহিনী ‘ক্রাক-প্লাটুন’-এর কয়েকজনকে ‘কণিকা’ নামের একটি বাড়ি হতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। রাতটি ছিলো ২৯ আগষ্ট ১৯৭১। সেই একই অপারেশনে, মধ্য রাতের পর অর্থাৎ ৩০ আগষ্ট ১৯৭১; ৮, মগবাজার হতে গ্রেফতার হন ক্রাক-প্লাটুনের আরও এক সূর্য সন্তান “আজাদ”। আজাদ, জাহানারা ইমাম পুত্র ‘শাফী ইমাম রুমি’র খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সহ-যোদ্ধা। পরদিন রমনা থানায় আজাদের সাথে দেখা করতে যান তার মা। রক্তাক্ত আজাদ সেদিন মায়ের কাছে ভাত খেতে চান। পরদিন ভাত নিয়ে রমনা থানায় আজাদের মা উপস্থিত হলেও, মা-ছেলের আর কোনদিন দেখা হয়নি। ১৯৮৫ সালে আজাদের মা মারা যান। কাকতালীয়ভাবে তার মৃত্যুর তারিখটিও ছিলো ৩০ আগষ্ট। এই দীর্ঘ চৌদ্দ বছর তিনি শুকনো রুটি খেতেন, তবু মুখে ভাত তোলেননি; তার পুত্রের মুখে ভাত দিতে পারেননি বলে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৯