সকালে ঘুম থেকে জাগার পর ''আদর্শ হাউজওয়াইফ হতেই হবে?'' শিরোনামে একটি খবর দৃষ্টিগোচর হলো। দেশের নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে তার শশুড়বাড়ির লোকজন হত্যা করেছে বলে তার পরিবারের দাবী। সচরাচর এসব হত্যাকান্ড ঘটানো হয় যৌতুকের লোভে। কিন্তু এবারের খবর'টা একটু অন্যরকম। মেয়েটা পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। এটাই তার অপরাধ এবং তার জন্য নিজের জীবন দিয়ে সেই অমার্জনীয় অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হলো। এমনসব নেতিবাচক ঘটনাগুলো প্রচন্ড পীড়া দেয় জন্য ইদানিংকালে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছি। কিন্তু ওই খবরের কমেন্ট সেকশনে কিছু জনের মন্তব্য দেখে যারপর নাই টাস্কি খেলাম! অত্যাধুনিক এই যুগেও কিছু মানুষের মানসিকতা হীন-ই রয়ে গেলো! আত্মনির্ভরশীল মেয়েদের নিয়ে আমাদের সমাজের অনেকের মনে এখনো অনেক ভয়। স্বামীর অবাধ্য হলো কেন, মেয়ে নিশ্চয় পরকীয়া করেছে, চাকুরীজীবি মেয়ে বিয়ে না করা ই ভালো ইত্যাদি হাজারো আগ্রাসী আর ঘৃণিত মন্তব্য। কিছু কিছু মন্তব্যের স্ক্রীনশট পেলাম। এসব নিয়ে বলবার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছি। কেবলমাত্র আপনাদের জন্য এখানে সংযুক্ত করলাম:
পত্রিকা পড়ে যতটুকু জেনেছি, ছেলের পরিবার চায় বাড়ির বৌ'কে ‘আদর্শ গৃহিনী’ হতে হবে। মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা থাকতেই পারে। সবার বোধশক্তি, আদর্শ, মানসিকতা, চাহিদা একরকম হবেনা; সেটা খুব স্বাভাবিক। তাই, তাদের চাওয়া নিয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু বিয়ের আগে সেসব মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে স্বচ্ছ কথাবার্তা হবার দরকার ছিল। মেয়ের বাবা নাকি চাইতেন যে, মেয়েটা সাবলম্বী হোক। তারমানে, দুই পক্ষের চাওয়ায় বিস্তর পার্থক্য; একদম মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ! খুব ভালো করে দুই পরিবারের নিজ নিজ অবস্থান পরিষ্কার না করে জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নেয়াটা নিছক ই ছেলেমানুষী ধরণের কাজ। দুই পক্ষের আদর্শিক মতামত, মন-মানসিকতা, বেসিক চাহিদাগুলো মিলে গেলে তবেই না আত্মীয়তার সম্পর্কে জড়ানো যেতো। তেল আর জল'কে জোর করে মিশাতে চাইলেই তো আর মিশবেনা। খুব স্বাভাবিক এই বোধটুকু আমাদের কেন হয়না জানিনা।
আরো জানতে পারি, মেয়েটির প্রেমের বিয়ে। প্রেমিক ছেলেটি তার বৌকে চাকরি করতে দিবেনা এটাও সে জানতো। তবুও কেন ওই ছেলেটিকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করলো, ব্যাপার'টা ঠিক বুঝতে পাচ্ছিনা। সে তো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে। নিতান্তই আবেগের বশে এতো বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিতে গেল, এমনটা ভাবতে দ্বিধান্বিত হচ্ছি। অনেকটা জেনে শুনে বিষপানের মতো অবস্থা! হয়তো পরিস্থিতির চাপে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। অথবা ভেবেছিলো যে ছেলেটি সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে। সত্যি কারণ আমাদের জানা নেই। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, তার সঙ্গী নির্বাচন ভুল ছিল। যার ফলাফল, নিজেকে বিসর্জন!
তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের নিয়ে কী বলবো, ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা। মানুষ এমন বর্বর হতে পারে কেমনে! দুইপক্ষ বসে একটা সুন্দর সমাধান করতে পারতো। সেটা সম্ভব না হলে, আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল- বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। একটা অসুস্থ সম্পর্ক দিনের পর দিন টেনে নিতে গেলে এমন কিছু বিপত্তি ঘটে যায়; যার পরিণতি হয় ভয়াবহ রকমের।
আমাদের সমাজে একজন মেয়ের কখনো কখনো এমন মুহূর্ত আসে, যখন সংসার আর ক্যারিয়ার মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। এমন অবস্থা যে তাকে যেকোন একটি বেছে নিতে বাধ্য করা হয়। মান-সম্মান আর সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে অধিকাংশ সময় অনেক সম্ভাবনাময়ী মেধাবী মেয়ে ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে সংসার'কে বেছে নেয়। মনের বিরুদ্ধে হলেও সবকিছু মেনে নিয়ে সংসার করে যায়। মেয়েরা স্ব-নির্ভর হলে নাকি শ্বশুরবাড়ির বাধ্য থাকতে চায়না। অনেক পরিবার ই এই ভয়ে তটস্থ থাকে। এটাই বুঝিনা যে, বাধ্য করবার কী আছে! তারা তো আর গরু-ছাগল না যে তাদের পোষ মানতে বাধ্য করতে হবে। যে যার অবস্থান থেকে সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে যুগের পর যুগ সুন্দরভাবে পাশাপাশি পথ চলা সম্ভব। এজন্য কোনো জোর-জবরদস্তি, ছল -চাতুরির প্রয়োজন পড়েনা।
পুরুষের মতোই একটি মেয়ের মধ্যে থাকতে পারে অপার সম্ভাবনা। তার মনে উঁকি দিতে পারে, বিশ্বজয়ের ভাবনা। আর সবার মতো তারও অধিকার আছে, নিজের সুন্দর স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করবার। কারো অধিকার নেই, কোনো মেয়ের পায়ে শিকল দেবার। ইদানিং বেশ লক্ষণীয় একটা ব্যাপার হয়েছে যে, অনেক পরিবার বিয়ের সময় দেখে শুনে উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে নির্বাচন করবে কিন্তু বিয়ের পর তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে চাকুরী করতে দেবেনা। ভেবে পাইনা, কেন এমন বিষম চিন্তা- চেতনা!
আরেকটি বড় সমস্যা হলো, মাস্টার্স পাশ একটা মেয়েকে বিয়ের বাজারে একটু 'বয়স্ক' বলে গণ্য করা হয়। তথাকথিত 'পাবলিক ডিমান্ড' কমে যায়। এজন্য এখনো মেয়েদের বয়স তেইশের ঘরে গেলেই বাবা-মা'র কপালে একটু করে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করে। বিয়ে দেবার জন্য মরিয়া হয়ে যায় । সময় থাকতে বিয়ে দেয়া না গেলে উপযুক্ত ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবেনা, এমন ভাবনা থেকে তারা এমনটি করে। যার কারণে বেশিরভাগ (বিশেষ করে মফস্বল ও গ্রামের) মেয়েদের অনার্স তৃতীয় অথবা চতুর্থ বর্ষে থাকতে বিয়ে হয়ে যায়। তারপর শুরু হয়, তার জীবনের মহাযুদ্ধ। একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে স্বামী -সংসার সামলানো। আবার বিয়ের পরপর ই আসে সন্তান নেবার চাপ। এতকিছুর চাপে কেউ কেউ আপন পথের খেই হারিয়ে ফেলে।
আবার ধরুন, বিয়ের পর তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেবার সুযোগ দেয়া হলো। তাতেও কি তার ঝক্কি ঝামেলা কম পোহাতে হয়? মোটেও না। ক্যারিয়ার, স্বামী -সন্তান, সামাজিকতা সবকিছু সামলাতে গিয়ে সে একসময় নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভুলে যায়। স্বামী চায় লক্ষী বৌ, সন্তানকে মানুষ করতে গেলে আদর্শ মায়ের কোনো বিকল্প নেই। চাকুরীক্ষেত্রে প্রত্যাশা করা হয় একজন দক্ষ এমপ্লয়ী; সে নারী হোক কিংবা পুরুষ। সবখানেই তার নিজের অস্তিত্ব ও সামর্থ্য প্রমানের অগ্নি-পরীক্ষা!
একজন পুরুষ যখন যে কাজে ডুব দেন, সে কাজের মধ্যেই থাকতে পারেন। কিন্তু একজন নারী'কে অফিসের টেবিলে বসেও ভাবতে হয়, তাকে কাজ শেষ করে দ্রুত ঘরে ফিরতে হবে। রাতের খাবারটা তো সময়ের অভাবে রেঁধে আসা হয়নি! ছোট বাচ্চা থাকলে তো কথা ই নেই। বাচ্চা'টা নিরাপদে আছে তো, তাকে ঠিকমতো খাওয়ানো হয়েছে তো ইত্যাদি হাজারো চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এর বাদেও শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, নিজের বাবা -মা সবাইকে ভালো রাখবার ব্যাপারটা তো মানবিকবোধ থেকে আপনা-আপনি চলে আসে। সংসারের হাজারো কাজের কথা আলাদা করে আর নাইবা বললাম। সব দায়িত্ব সামলাতে সাহায্যকারী তেমন কাউকে পাশে পাওয়া না গেলেও, কোথাও একটুখানি তালগোল পাকিয়ে গেলে তাকে কটাক্ষ করবার মানুষের অভাব নেই। এত প্রেশার নিয়েও সে সবার চোখে একজন 'সফল নারী' হবার জন্য প্রতিনিয়ত প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তাদের সামনে এগিয়ে দেবার বদলে আমাদের সমাজের কিছু মানুষ অহেতুক মিথ্যা দায় চাপিয়ে উল্টো পা টেনে ধরে।
একজন নারী গৃহিনী হলে সবাই তাকে তুচ্ছ ভাবে। তার আশে-পাশের কাছের মানুষের দ্বারা অবহেলিত, নিগৃহীত হয়। অর্থ উপার্জন প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না হতে পারলে আমরা স্রেফ বলে বলে বসি, সে কোনো কিছু করেনা। আবার, নিজের মান নিয়ে মাথা উঁচু করে চলবার জন্য প্রতিষ্ঠিত হবার ধাক্কাও তাকে প্রতিনিয়ত ভেঙে ফেলতে চায়। তবুও নারী তার অসীম ধৈর্যশক্তি নিয়ে সব বাধা মাড়িয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে চলে। একজন নারী-ই পারে অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে এবং অপরিসীম আত্ম-প্রত্যয়ী হয়ে তার ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট জীবন কে সমান্তরালে এগিয়ে নিতে। এমন বহুবিধ গুণাবলীর কারণেই নারীরা অনন্যা, অতুলনীয়া, প্রাণ-সঞ্চারকারিণী।
পরিশেষে, পুরুষ সমাজ এতকিছুর পরেও আমরা তোমাদের থেকে খুব বেশি কিছু চাইনা। শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে আমাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু, নিজেদের বিকশিত করবার সুযোগটুকু চাই। তোমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্বজয়ের সঙ্গী হতে চাই। রবি ঠাকুরের ভাষায় বলে যেতে চাই -
'' আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
আজ শুধু করি নিবেদন--
আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্রনন্দিনী॥''
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ফটো
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০২০ সকাল ৮:২১