তার মুখ ছিলো ওড়না দিয়ে ঢাকা, পা দুটো বিক্ষত, চোখ শুকনো, হাতে শক্ত করে ধরে আছেন তার ভাইয়ের একটি ছবি। ফারজানা মজিদ; নয়দিন পায়ে হেঁটে ৪৫০ মাইল পাড়ি দিয়ে কোয়েটা থেকে করাচি এসেছেন।
আসলে ফারজানা মজিদের এই যাত্রা নয়দিনের নয়, তার দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয়েছিলো আজ থেকে সাড়ে চার বছর আগে। যখন তিনি একটি ফোনকল রিসিভ করেছিলেন- তার ভাইকে মাস্টাং নামক স্থান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারপর দীর্ঘ সাড়ে চার বছর তিনি অপেক্ষা করেছেন, কিন্তু তার ভাই আর কোনোদিন ফিরে আসেনি।
বেলুচিস্তানে যেটি সাধারণ ঘটনা, হঠাৎ করেই কোনো একজন তরুণ-যুবক হারিয়ে যায়, কয়েকদিন পর তার লাশ পাওয়া যায় শহর কিংবা গ্রামের কোনো এক প্রান্তে। কিন্তু ফারজানা মজিদের ভাই জাকির মজিদের কোনো লাশ বা সন্ধানও তিনি এতোদিনে পাননি।
বেলুচিস্তানের ইতিহাস আর দশটা ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ ইতিহাসের মতোই। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান কৌশলে বেলুচকে নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে নেয়। তাদের উপর চাপিয়ে দেয় পাকিস্তানের শাসনদণ্ড। শাসনের জন্য দুই ভাগ করা হয় বেলুচিস্তানকে। কিন্তু স্বাধীনতাকামী বেলুচরা এই পরাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। ১৯৪৮ সাল থেকেই বেলুচরা স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তোলে। কখনো সশস্ত্র কখনোবা নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু আন্দোলন আর সশস্ত্র সংগ্রামই স্বাধীনতা লাভের সবচে উৎকৃষ্ট উপায় নয়, যখন বিপক্ষে থাকে পাকিস্তানের মতো জান্তব সরকারের বন্দুকের নল। বেলুচদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পথে তাই প্রতিদিনই ঘটে গুপ্তহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, নিপীড়নের যাবতীয় দুর্ঘটনা, পাকিস্তানি মিলিটারি কর্তৃক। জাকির মজিদ সেই দুর্ঘটনারই একটি অংশ মাত্র।
ফারজানা মজিদের ভাই জাকির মজিদ পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ(?)-এর বেলুচিস্তান ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলি, গণযোগাযোগ এবং বেলুচিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ে সচেতন জাকির ইউনিভার্সিটিকেন্দ্রিক আন্দোলনে জড়িত ছিলেন মাত্র। জাকিরের নামে কখনোই কোনো ভায়োলেন্স বা উগ্রতার রেকর্ড ছিলো না। তাদের আন্দোলন ছিলো শান্তিবাদী।
ফারজানাও বেলুচিস্তান ইউনিভার্সিটি থেকে বায়োকেমিস্ট্রি থেকে গ্রাজুয়েশন করে মাস্টার অব ফিলোসফিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন এ বছর। এটা খুবই বিস্ময়কর একটি ব্যাপার, যেখানে বেলুচিস্তানের শিক্ষার হার পৃথিবীর সবচে নিম্নতম শিক্ষা-হারের অন্যতম সেখানে ফিলোসফিতে ফারজানার মাস্টার্স করা সত্যিই অবাক করার মতো বিষয়।
আর এটাই বাস্তবতা। পাকিস্তানের ধুরন্ধর শাসকগোষ্ঠী এই অঞ্চলের শিশু-কিশোরদের ছোট বয়সে পাঠশালায় যাবার বদলে তাদের হাতে তুলে দেয় অস্ত্র কিংবা আফিমের চারা। কারণ শিক্ষিত হলেই তারা হয়ে যাবে অধিকার সচেতন, মূল্য বুঝবে স্বাধীনতার, আওয়াজ তুলবে মুক্তির। যা ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’-এর জন্য কখনোই শোভনীয় নয়।
ফারজানা অনেক প্রতিবাদী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন, এক শহর থেকে ছুটে গেছেন আরেক শহরে, বিভিন্ন প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানতে চেয়েছেন ভাইয়ের হদিস, কোর্টে গিয়েছেন কিছু একটা ব্যবস্থা করার জন্য, বিভিন্ন সংস্থা আর সংগঠনের পদযাত্রায় অংশ নিয়েছেন, যারা হারিয়েছে তাদের ভাই কিংবা পিতা অথবা অন্য কোনো স্বজনকে। তার ভাইয়ের তালাশে তিনি সম্ভাব্য সব জায়গায় ধর্ণা দিয়েছেন।
যখনই তিনি শুনেছেন করাচি বা বেলুচিস্তানের কোথাও কোনো বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গেছে তখনই ছুটে গেছেন মর্গে; আর মনে মনে প্রার্থনা করেছেন- লাশটা যেনো তার ভাইয়ের না হয়। প্রতিটি দিন যায় আর ফিকে হতে থাকে তার ভাই জাকিরের ফিরে আসার সম্ভাবনা।
কয়েক মাস আগে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফারজানা বলেছিলেন-
‘আমার ভাইকে একটি কুলি ক্যাম্প থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। তার সঙ্গে আরও যাদেরকে তুলে নেয়া হয়েছিলো তাদের কাছে সে একটি চিরকুট দিয়েছিলো। ভালোবাসার চিরকুট- একটি বোতাম। সে তার জামার একটি বোতাম পাঠিয়ে আমাদের জানিয়েছিলো- সে বেঁচে আছে, মরেনি।’
ফারজানার কাহিনী এবং অন্য আরো শত শত বেলুচ পরিবারের কাহিনী পশ্চিমা বিশ্ব, এমনকি পাকিস্তানের জনগণেরও হয়তো কোনো সহানুভূতি জাগাতে পারবে না। অথচ ১৫ বছর বয়সী মালালা ইউসুফজাই যখন আহত হলেন তখন সেটা হয়ে গেলো মানবতার প্রতি নির্মম আঘাত, আন্তর্জাতিক প্রচারণা। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তার প্রতি সহমর্মী হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। কয়েকদিনেই মালালা একটি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তালিবান অধ্যুষিত সোয়াত উপত্যকায় তিনি শিক্ষার ব্যাপারে অনেক সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, তার এই সচেতনতা পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহি অবস্থাকে মোটেও সহনীয় করতে পারেনি।
নাবিলা রেহমান। একটি ছোট্ট মেয়ে, যার দাদী ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন। সে এখন আমেরিকায়। আমেরিকার কংগ্রেসে সে তার ঘটনার সাক্ষ্য পেশ করছে। সে তার ঘটনা বিশ্ববাসীকে জানানোর সুযোগ পাচ্ছে। পাকিস্তানের জনগণও অনলাইন এ্যাক্টিভিটিসের মাধ্যমে তার ঘটনাটিকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু ফারজানা? যে তার হারিয়ে যাওয়া ভাইকে খুঁজছে। যে তার ভাইয়ের মতো আরও হাজারো তরুণের নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর জানতে শুরু করেছেন দীর্ঘ রোডমার্চ। ফারজানার জন্য কি আন্তর্জাতিক মিডিয়া সহানুভূতিশীল হবে? বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তান বেলুচিস্তানে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য করে রেখেছে, আন্তর্জাতিক মিডিয়া কি সেই খবর কোনোদিন প্রকাশ করবে?
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার জন্য হয়তো বেলুচিস্তান ‘প্রবেশ নিষিদ্ধ’। কিন্তু প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো সোয়াতও। তবু সেখান থেকে মালালা বেরিয়ে এসেছে। হয়েছে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। সাহসিকতার পুরস্কার পেয়েছে অনেক। নাবিলা ইউএস কংগ্রেসের সামনে গিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেয়েছে- ‘কেনো তোমরা আমার দাদীকে ড্রোন হামলা করে হত্যা করেছো?’ তাহলে ফারজানা কেনো পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবেন না? ফারজানা কি পাকিস্তানের আইনপ্রণেতাদের কাছে এই প্রশ্ন করতে পারেন না- ‘আমার ভাই কোথায়?’
ফারজানা মজিদের ভাই এবং অন্যান্য বেলুচ তরুণ-তরুণী যারা ড্রোন হামলার শিকার নন, এমনকি তারা পাকিস্তানের তালেবানদের দ্বারাও আক্রান্ত নন; তারা এমন শক্তির দ্বারা প্রতিনিয়ত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন যারা তাদেরই শাসক, তাদের ভোটেই নির্বাচিত আইনপ্রণেতা।
ফারজানা তার যাত্রা চালিয়ে যাবেন। তিনি জানেন, যখন তিনি করাচি পৌঁছবেন তখন সেখানে পলিটিশিয়ান কিংবা জনগণের সমাগম তাকে স্বাগত জানাবে না। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মিডিয়া তার জন্য কোনো সুসংবাদ নিয়ে অপেক্ষা করবে না। তাকে তার যুদ্ধ একাকীই চালিয়ে যেতে হবে। যতোক্ষণ না তার ভাই ফিরে আসে ঘরে, হয়তো জীবিত নয়তো মৃত।
ডন অনলাইনের একটি মতামত অবলম্বনে