এক
নাঈমার খুব ইচ্ছা সে একটা প্রেম করবে। আবজাব প্রেম না, একেবারে জীবন-মরণ প্রেম। যাকে ভালোবাসবে তার জন্য দুঃসাহসিক সব কাজ করবে। যখন তখন প্রেমিকের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে যাবে। বাড়িতে ফিরে এসে মা’র বকা খাবে। বড়ভাই এবং বাবা কঠিন কঠিন সব কথা বলে তাকে ঘরে বন্দি করে রাখবে। সে বন্দিনী হয়ে একা একা বালিশ ভিজিয়ে কাঁদবে। প্রেমে সুখ পেলেও কাঁদবে, দুঃখ পেলেও কাঁদবে। অনেক কাঁদবে। তার কান্না না হওয়ার রোগ আছে। সে অন্য মেয়েদের মতো অকারণে কাঁদতে পারে না। অনেক চেষ্টা করেও সে চোখে কান্না আনতে পারে না। কিন্তু তার কারো জন্য খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে।
ভালোবাসার জন্য কাঁদতে সে মানসিকভাবে নিজেকে মোটামুটি প্রস্তুত করছে। কাঁদার প্র্যাকটিসও শুরু করেছে ইদানীং। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মশ্ক করছে কোন সময় কোন ধরনের কান্না কাঁদবে। সবসময় কান্নার আওয়াজ এবং মুখভঙ্গি একরকম হয় না। ব্যাপারটা সে আয়নায় নিজেকে মুখ ভেংচিয়ে নানাভাবে ঝালাই করে নিচ্ছে। চোখের পানি মোছার মধ্যেও একটা ব্যাপার আছে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে পানি মোছার চেয়ে হাতের তালু দিয়ে মোছাটা অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন মনে হয়েছে তার কাছে। এটা আবিষ্কার করার পর তার প্রেমবিষয়ক কান্নার আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে।
কিন্তু নাঈমার প্রেম সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে সমস্যা আছে দুই জায়গায়। প্রথম সমস্যা তার বাবা মাওলানা আকলিমুদ্দিন। তিনি ময়মনসিংহ শহরের বড় মাওলানা এবং বিরাট ধনীলোক। মাওলানা এবং ধন- এই দুই জিনিস একত্রিত হওয়া রীতিবিরুদ্ধ হলেও তার বাবা এই বিরল কৃতিত্ব হস্তগত করেছেন। তার বাবার জমির ব্যবসা। তার জমির ব্যবসা ময়মনসিংহ জেলায় এতোটাই বিস্তৃত যে, লোকজন আড়ালে তাকে জমিউদ্দিন নামে ডাকে। সামনে বলতে সাহস পায় না অবশ্য। কারণ জমির ব্যবসায়ী মানেই একটা ভয়ঙ্কর জিনিস। নাঈমা তার বাবাকে ভয় পায়, প্রচণ্ড ভয় পায়।
দ্বিতীয় সমস্যা- এই যুগে কেউ জীবন-মরণ প্রেম করে না। জীবন-মরণ প্রেমের যুগ শেষ হয়ে গেছে মোবাইল-ইন্টারনেট আবিষ্কার হওয়ার আগের বছর। এই জিনিস এখন আর সলিড খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই সেকেন্ডহ্যান্ড প্রেমে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নাঈমা সেকেন্ডহ্যান্ড ফালতু প্রেমে পড়তে রাজি না।
নাঈমার পুরো নাম কুররাতুল আইন নাঈমা। কুররাতুল আইন মানে হচ্ছে নয়নের শীতলতা। দুই ছেলের পর এক মেয়ে, তার বাবার চোখে শীতলতা এনে দিয়েছিল নাঈমা। মাওলানারা তাদের মেয়েদের অত্যধিক ভালোবাসে। এই কারণে মনে হয় খোদা তাআলাও মাওলানাদের উদারহস্তে কন্যাদান করেন। কিন্তু নাঈমার কোনো বোন নেই। বোন না থাকার কারণে মাওলানা আকলিমুদ্দিনের কন্যাবিষয়ক যাবতীয় আদর ভালোবাসা নাঈমাকে একা সইতে হয়। ভালোবাসও যে মাঝে মাঝে নির্যাতনের পর্যায়ে পৌঁছে যায়, নাঈমা তার বাবা আর দুই ভাইয়ের মাত্রাছাড়া ভালোবাসায় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পায়।
দুই
: আপনি কি চায়ে চিনি খান?
নাঈমা অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে জবাব দিলো, হ্যাঁ, খাই।
: আমার মনে হয় আপনার চায়ে চিনি খাওয়া উচিত না। কারণ আপনার হাসিটা এতোটাই মিষ্টি যে চায়ে চিনি না দিলেও কাপে ঠোঁট ছুঁয়ানো মাত্রই চা মিষ্টি হয়ে যাবে।
নাঈমার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। এতো অদ্ভুতভাবে কেউ কারো প্রশংসা করতে পারে!
নাঈমার সামনে যে লোক বসে আছে তার নাম মুফতি রায়হান হাবিব। দেওবন্দফেরত এই মুফতি সাহেব তাকে দেখতে এসেছে। ছেলের বাড়ি ভৈরব। কাপড়ের বিশাল বনেদী ব্যবসা। সুতরাং বিয়ের ব্যাপারে নাঈমার পরিবারের অনাগ্রহের তেমন কোনো কারণ নেই। তবে নাঈমা কিছুতেই এই দেখাদেখিতে রাজি ছিল না। তার বাবার সামনে সে কথা বলার মতো সাহস তার হয়নি।
ছেলের পরিবারের মহিলারা আনুষ্ঠানিকভাবে নাঈমাকে দেখে যাওয়ার পর তাকে একা ঘরে রেখে সবাই চলে গিয়েছিল। মুফতি লোকটা নাকি একান্তে তার সঙ্গে কথা বলবে। ভয়ে অসহ্যরকম ভ্যাঁপসা গরম লাগছিল নাঈমার। মুফতি সাহেব ঘরে ঢুকেই তাকে সালাম দিয়েছিল। সামনে বসতেই দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার। মনে হচ্ছিল তার কোমর থেকে শাড়ি খুলে পড়ে যাচ্ছে।
তবে এখন আর ভয় ডর কিছুই করছে না। অনেকক্ষণ হলো কথা বলছে দুজনে। একটা মানুষ এতো সুন্দর করে কীভাবে কথা বলতে পারে, সেই কথা ভেবে বারবার নিজেই তিরস্কার করছে নিজেকে।
: আপনি কি জানেন ময়মনসিংহের মেয়েদের গালে তিল বেশি থাকে?
নাঈমার হাত অনিচ্ছাকৃতভাবেই তার বাম গালের টোলের ওপর চলে গেলো। সেখানে একটা তিল এতোদিন অনাদরে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলছিল। এখন তিলটাকে মহামূল্যবান মনে হচ্ছে। সে তিলের ওপর থেকে হাত সরিয়ে হেসে ওঠলো। লোকটিও আলতো করে হেসে ফেললো।
: এটা হয়। একটা তথ্য বলি আপনাকে। একজন মানুষ কখনোই জিহ্বা দিয়ে নিজের কনুই স্পর্শ করতে পারে না। এটা কিন্তু তথ্য নয়। তথ্য হলো, নব্বই ভাগ লোক এই তথ্য জানার পর জিহ্বা দিয়ে নিজের কনুই স্পর্শ করার চেষ্টা করে। আপনারও এখন জিহ্বা দিয়ে কনুই ছুঁতে ইচ্ছা করছে তাই না? দুজনেই শব্দ করে হেসে ওঠলো।
নাঈমার গালের বাম পাশটা গরম হয়ে ওঠেছে। সে হাত দিয়ে একবার গালের উষ্ণতা অনুভব করলো। কারো গালের একটা পাশ যে শুধু গরম হতে পারে এই শারীরিক জ্ঞান তার এতোদিন জানা ছিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছে মুফতি লোকটা তার গালের তিলটার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা মনে আসতেই তার হাত আপনাআপনি গালের দিকে চলে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত করছে বারবার।
: আপনাকে আমি একটা মিথ্যা কথা বলেছি। ময়মনসিংহের মেয়েদের গালে যে তিল বেশি থাকে, এই বিষয়টা আমি বানিয়ে বলেছি। আপনার গালের তিলটা দেখে কিছু একটা বলতে ইচ্ছে করলো তাই বলে ফেললাম।
নাঈমা মনে মনে বললো, আপনার সত্য বলার দরকার নেই। আপনি সারাজীবন মিথ্যা বললেও আমি আপনার সব কথাকে সত্য বলে ধরে নেবো।
: আপনি কি মিথ্যা বলেন? রায়হান হাবিব জিজ্ঞেস করলো।
: বলি না। একেবারে অসম্ভব না হলে কখনো মিথ্যা বলি না।
: সত্য বলার অভ্যাস অত্যন্ত চমৎকার একটা জিনিস। সত্য হলো একটা আত্মিক শক্তি। এটা অন্তরে থাকলে আপনি অনেক কিছুই খুব সহজে জয় করতে পারবেন। কখনো প্রেম করেছেন?
নাঈমা কিছু না বলে ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়লো। কি অকপটে সবকিছু বলে ফেলে লোকটা!
: প্রেম হলো উম্মুল কিযব-মিথ্যার আম্মাজান। যে প্রেম করবে তাকে অবশ্যই মিথ্যা বলতে হবে। হয়তো প্রেমিকাকে খুশি করার জন্য, নয়তো পরিবারের কাছে, বন্ধুদের কাছে; কোথাও না কোথাও তাকে মিথ্যা বলতেই হবে। আবার প্রেমের অনেক উপকারী দিকও আছে। কিন্তু সেগুলো আপনাকে আমি বলতে পারবো না। আমার অভিজ্ঞতা কম! হেসে ওঠলো দুজনেই। ওপাশের ঘর থেকে রায়হানের বড়বোন গলা খাঁকাড়ি দিলেন। চুপ হয়ে গেলো দুজনেই আবার।
: আপনি যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটেন তখন মাটি আপনার পা জড়িয়ে ধরে না?
: কেন?
: আপনার পা দুটো এতো সুন্দর, যে পথে হাঁটেন সে পথ তো আপনার পা দুটোকে ছেড়ে দেবার কথা না।
নাঈমা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। নাঈমার সারাজীবনে সে কোনোদিন কোনো ছেলের সঙ্গে এতোক্ষণ কথা বলেনি। তার হাত-পা ঘেমে ওঠছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে লোকটার কথা। বুকের মধ্যে কেমন প্রেম প্রেম লাগছে। এই লোকের জন্য অযথাই তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চোখের কোণে এরই মধ্যে জল টলমল করছে। কি আশ্চর্য!
তিন
নাঈমা মাদরাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। চিনি ছাড়া চা। এক সপ্তাহ হলো সে চিনি ছাড়া চা খাচ্ছে। মাদরাসার আয়াকে দিয়ে সে ফ্লাস্কে করে দোকান থেকে চা আনিয়ে খায়। এই সুবিধা তার বিত্তবান বাবার কারণে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত।
এমন সময় আয়া এসে বললো, আপা, আপনের চিঠি আসছে। বলেই একটা সাদা খাম হাতে ধরিয়ে দিলো। চিঠির উপর শুধু তার নামটা লেখা আছে, আর কিছুই না। নাঈমা বেশ অবাক হলো, এই যুগে কেউ অফিসিয়াল চিঠি ছাড়া চিঠি লিখে না। কে তাকে চিঠি লিখলো? চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে চিঠিটা খুললো সে-
চিঠির শুরুতে কোনো সম্বোধন লিখতে পারলাম না বলে দুঃখিত। আপনি জানেন কিনা জানি না, আপনার সঙ্গে আমার বিয়েটা সম্ভবত হচ্ছে না। কেন, সেটা পরে বলছি। তার আগে বলে নিই, আপনার কথা কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছি না। আমি কি আপনার প্রেমে পড়েছি? অদ্ভুত, বড়ই অদ্ভুত!
প্রেম হলো পৃথিবীর সবচে বড় আর্ট। এটা শিখতে হয় না, মনের মধ্য থেকে অনুভব করতে হয়। যে যতো বেশি অনুভব করতে পারবে সে ততো বড় আর্টিস্ট। যে যতো গভীর করে বিভিন্নভাবে প্রেমকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে সে ততো ভালো আর্টিস্ট, প্রেমশিল্পের যোগ্য সমঝদার।
এবার বলি কেন আপনার সঙ্গে আমার বিয়েটা না হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আমি দেওবন্দ থেকে মুফতি হয়েছি ঠিকই কিন্তু আমার মনটা সম্ভবত মুফতি হয়নি। আমার ঘুরে বেড়ানোর বাতিক আছে। ঘুরে বেড়ানো বলতে ইবনে বতুতার মতো আর কি! এরই মধ্যে বাংলাদেশে চৌষট্টি জেলার বিয়াল্লিশটিতে আমি সফর করে ফেলেছি। বাকি আঠারোটাও করে ফেলবো খুব শিগগির। আর আপনার সঙ্গে যদি বিয়ে না হয় তাহলে প্রতিজ্ঞা করেছি বাংলাদেশের সবকটি উপজেলা সফর করবো। একদম গৃহহীন হয়ে পথে নেমে পড়বো।
এখন আপনিই বলুন, এমন যার ঘুরে বেড়ানোর বাতিক তার সঙ্গে কোন বাবা তার মেয়ের বিয়ে দেবে? আপনার বাবাও রাজি হননি ভবঘুরে ছেলের সঙ্গে তার মেয়েকে বিয়ে দিতে। আমার বাবা-মা আমাকে অনেক বুঝিয়েছে এই যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ানো থেকে নিবৃত হতে, কিন্তু পারেনি। কতোবার যে আমি মাদরাসা থেকে পালিয়ে কতো জায়গায় চলে গিয়েছি!
কী করবো বলুন, ঘরে আমার মোটেও মন বসে না। কয়েকদিন থাকলেই দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তাই আবার বেরিয়ে পড়ি। এজন্য বাবার কতো বকা যে আমাকে শুনতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ভ্রমণ আমার কাছে নেশার মতো, এটা না করলে আমার মনে হয় আমি মরেই যাবো। ঘর আমাকে টানে না। আমাকে টানে কেবল নতুন পথ, নতুন সবুজ, নতুন মানুষ...!
কিন্তু আমি চাই ঘর আমাকে টানুক। আমার ঘরে এমন কিছু থাকুক যার জন্য আমি সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে আবার ঘরে ফিরে আসবো। কেউ পাগলের মতো আমার জন্য অপেক্ষায় থাকুক। কেউ আমার বিরহে একা কাঁদুক। আমি বেরিয়ে যাবার সময় কেউ পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলুক- ‘মাথার কসম, আবার এসো।’ কিন্তু এমন করে কেউ কোনোদিন বলেনি কখনো।
যেখানে যেভাবেই থাকবেন, অনেক সুখে থাকবেন- আজীবন এই কামনাই করবো।
পুনশ্চ : আপানার দুটো জিনিস আমাকে এখনও নেশাগ্রস্ত করে রেখেছে। আপনার বাম গালের তিলটা আর আপনার অদ্ভুত সুন্দর পা দুটো। আবার যদি কোনোদিন দেখা হয়, আমার ইচ্ছা আমি আপনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবো। সেই সুযোগ কি আমায় দেবেন আপনি?
ইতি
রায়হান হাবিব
নাঈমার চোখের জলে চিঠি ভিজে যাচ্ছে। কিছুতেই চোখের জল আটকে রাখতে পারছে না। সে কাঁদছে, ভীষণভাবে কাঁদছে। বর্ষার অবিরাম জলধারার মতো অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে তার বাম গালের একাকী তিলটা।