মাঝে মাঝে আমার খুব মনে হয়, রবি ঠাকুরজি বাঙালির জন্য বাংলা ভাষায় যা লিখে গেছেন তারপর বাংলা ভাষায় আর কেউ কিছু না লিখলেও তেমন কোনো ক্ষতি হতো না। একজন মানুষের জীবনের এমন কোনো অনুভূতির স্ফুরণ নেই যার প্রকাশ ঠাকুরজির কবিতা, গান, গল্পে প্রকাশ পায়নি। প্রেম, বিরহ, সুখ, তাড়না, বঞ্চনা, বৈষয়িক, দেশপ্রেম, জাগৃতি- বাঙালির তাবৎ সেন্টিমেন্ট তিনি এতো সূক্ষ্মভাবে দেখেছেন এবং লিখেছেন যে, বাঙালির এখন আর চোখে না দেখলেও চলে। রবীন্দ্রনাথ যা দেখেছেন, তা-ই দিয়েই ভালোবেসে কাটিয়ে দেয়া যাবে দু-চার শতাব্দী।
কাজী নজরুলের প্রেম, নারী, যাতনা নিয়ে পাঠককূল যতোটা উদ্বেল রবি বাবুকে অতোটা খোলতাই করার সুযোগ দেননি কবি নিজেই। বড় ‘বেদনা-সহায়ক’ ছিলেন তিনি। ঠাকুরজির জীবনে নারী অনেক অম্লতা দিয়েছে। কবি বুকে সয়ে কাগজে কেঁদেছেন। নজরুলের মতো জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের মতো উল্লাস করার সাহস ঠাকুরজির ছিলো না হয়তো। স্বল্পভাষী কবি নীরবে সয়েছেন।
তবু মাঝে মাঝে ‘তব’ দেখা পাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়। মাঝে মাঝে দেখা পাওয়ার একটা ‘তব’ থাকলে না মাঝে মাঝে উপলক্ষ তৈরি হয়! কবিকে আঘাত করা নারীরা কতোই না সৌভাগ্যবতী!!
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?।
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
হারাই-হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে ॥
রবি ঠাকুরকে নিয়ে বললাম যখন, তখন লালন সাঁইকে নিয়েও কিছু কথা বলি।
কথা তো সেই সুফিবাদ নিয়েই। এখন সুফিবাদের নানা টার্ম দেখা যায়। কিন্তু লালনের যে সুফি ধরনটা আমরা আজ দেখছি সেটা কিন্তু অনেকাংশেই বানোয়াট। যেমন আজকাল প্রচার পাওয়া লালনের অনেক বিখ্যাত গান আসলে লালনেরই লেখা নয়। অন্য কেউ লিখে লালনের বলে চালিয়ে দিচ্ছে। কলকাতার গবেষক অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী সম্প্রতি ‘বইয়ের দেশ’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যেসব গান আজকাল লালনের গান বলে গাওয়া হয়, তাদের অনেকগুলোই আসলে লালনের গানই নয়।’
লালন ফকির আপাত নির্বিবাদী একজন লোক ছিলেন। তিনি নিজের মতো করে তার ধর্মীয় বিশ্বাস পালন করতেন। তিনি কারো কাছে গিয়ে বলেননি, আমি তো নতুন এক মতাদর্শের সন্ধান পেয়েছি। তোমরা আমার অনুসরণ করো...।
ঐতিহ্যগতভাবে ভাববাদী বাঙালি গ্রামীণ সমাজ তার ভাবধর্মী গানে আকৃষ্ট হয়ে তাকে ভালোবেসেছে, তার গান গেয়েছে, গানে প্রভাবিত হয়েছে।
সবকিছুর উর্ধ্বে লালনের গানই লালনের বড় পরিচয়। তার ভাববাদী গানই সর্বৈব।তার মতাদর্শ তেমন কোনো আদর্শিক মানদণ্ডে যুৎসই বলে বিবেচিত হয়নি। বর্তমানে তার নামে প্রচারিত যে কুরুচিপূর্ণ মতাদর্শ, সেটা মোটের ওপর একটা বোগাস জিনিস!
লালনদর্শনের সবচে আলোচ্য তত্ত্ব হলো দেহতত্ত্ব। দেহতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হলে বিশাল কাহিনী বলতে হবে। ছোট করে বলি, লালনের দেহতত্ত্ব ইসলাম সমর্থিত যেমন নয় তেমনি সায়েন্টিফিকভাবেও এই তত্ত্ব পরিত্যাজ্য। দেহ সাধনের মাধ্যমে পরমাত্মার সন্ধান পাওয়ার ধারণাটা একমুখী দর্শন। ইসলামি সুফিবাদে এই সাধনের ভিত্তি কিয়দংশ থাকলেও সামগ্রিকভাবে অগ্রাহ্য।
শ্রীমতি মহাত্মা গান্ধি যে দেহব্রত পালন করতেন তা সম্ভবত লালনের দেহতত্ত্ব দর্শনে প্রভাবিত ছিলো।
লালন সৃষ্টিকর্তাই বিশ্বাসী ছিলেন, সে হিসেবে তাকে নাস্তিক বলা যায় না। লালন কোনো প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতে বিশ্বাসী ছিলেন কি-না, সে প্রশ্ন আজও অপাঠযোগ্য। তবে তাকে তার দেহতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তিনি অবশ্যই ইসলাম ‘ধর্মহীন’।
সুতরাং তাকে মুসলমান বানানোর প্রচেষ্টা নিতান্ত অরণ্যে রোদন।
আমার লালনসখ্যতা নিয়ে আমার অনেক প্রিয়জনের উষ্মা রয়েছে। লালনসখ্যতার কারণ ও মুগ্ধতা বিষয়ে আরেকদিন বলবো। আজ না হয় এটুকুতেই ক্ষমা হোক!