রতন চোরার মনটা আজকে খুব খুশি। কার মুখ দেখে যে আজ ঘুম থেকে উঠেছিল সে! গুন গুন করে গান গাইতে থাকে মনের আনন্দে। পকেট থেকে চুরির মোবাইল ফোন টা একটু পর পর বের করে দেখতে থাকে সে। খুব দামী আর সুন্দর একটা ফোন চুরি করতে পেরেছে আজ সে। মনে মনে হাসতে থাকে যে এই যুগেও এত বেয়াক্কেল মানুষ থাকতে পারে যে এত দামী একটা ফোন একটু সাবধানে রাখতে পারে না। ভাবতে থাকে কিভাবে কত সহজে আজ ফোনটা সে চুরি করেছে।
রতন চোরা মগবাজার টিএন্ডটি বস্তিতে থাকে। বাপ মা এর ঠিক ঠিকানা নেই। টুকটাক পকেটমারি আর ঠেকায় পড়লে ছিনতাই করে। আজ সে দুপুরে একটা বাসে করে গাজীপুর যাচ্ছিল। বাস টা মোটামুটি ফাকাই ছিল। রতনের দুইটা সিট সামনে বাম দিকে এক মধ্যবয়সী লোক জানালার পাশের সিটে বসে ঘুমাচ্ছিল। পাশের সিট খালি। ডান পাশের দিকের সিটটাও খালি। লোকটার পাশের পকেট থেকে ফোনটার অর্ধেকের বেশি বের হয়ে ছিল। আর লোকটা জানালার দিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। মাথায় একটা ক্যাপ , কানে একটা ইয়ারফোন লাগানো ছিল। মুখ হা করা। মাথাটা কাত হয়ে কাঁধের উপর হেলে আছে। গভীর ঘুমে মগ্ন বোঝাই যাচ্ছে। বাসটা ফুল স্পীডে চলছে। সামনের স্টপেজে তেমন কোন যাত্রী উঠবে বলে মনেও হচ্ছে না। রতন এই সুযোগটিকেই কাজে লাগালো। ডানে বায়ে তাকিয়ে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগুলো। তারপর স্টপেজ আসতেই আস্তে করে ফোনটা পকেটে পুরে নেমে গেল। তারপর যত তারাতারি সম্ভব চলে গেল সেখান থেকে। সিমটা অবশ্য সাথে সাথেই ফেলে দিতে সে ভুলল না।
তারপর ভাবল এত দামী ফোন নিয়ে সে আজ অন্য কোথাও যাবে না। বাসাতেই ফিরে যাবে। সে ভাবতেও পারেছে না এত সহজে এত দামী একটা মোবাইল ফোন পেয়ে যাবে সে। যাক ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। এই ফোন বেচে যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে বেশ ভালো ভাবেই দিন কেটে যাবে তার। নতুন আর কোন ফোন চুরি না করলেও চলে যাবে ২ মাস বেশ ভালো ভাবেই।
এইসব ভাবতে ভাবতে চিন্তা করল যে এত সুন্দর একটা দিনটিকে সেলিব্রেট না করলেই নয়। আজকে চুটিয়ে মদ খাবে আর তাস খেলবে সে বন্ধুদের সাথে। বহুদিন পরে কিছু মালপানি পড়বে তার পেটে।
দিনে আর সে নতুন কোন ধান্দায় বের হল না বাসা থেকে। শুয়ে বসে পার করে দিল সারাদিন। সন্ধ্যায় বন্ধুরা এলে জমিয়ে চুরির গল্পটা শুনালো বন্ধুদের। আর বলল আজ আমি সবাইকে খাওয়াবো। চিয়ার্স! শিক কাবাব আর মদের সাথে জমে উঠলো তাসের আসর। এক চুমুক মদ আর এক কামড় কাবাব। তাস খেলাটা জমে উঠলো ভালোভাবেই। খেলা শেষে বন্ধুরা যে যার মত চলে গেল বাসায়। গভীর রাতে অবসান্ন শরীরে মাতাল অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ল।
অনেক বেলা হলে ঘুম ভাঙল রতনের। খুব কষ্টে চোখ খুললো। তাকাতে ভিষন কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও জোর করে তাকালো। কিন্তু এক চোখে কিছুই দেখতে পেল না। চোখে হাত দিয়ে দেখতে পেল সেখানে ব্যান্ডেজ। অন্য চোখ দিয়ে দেখলো মাথার উপর খোলা আকাশ। সে বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে এসব তার সাথে। তার স্পষ্ট মনে আছে সে রাতে তার ঘরেই ঘুমিয়ে ছিল। আশে পাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল সে কোন একটা রাস্তার ধারে পরে আছে। পাশে একটা নর্দমা। বাজে গন্ধ আসছে সেখান থেকে। কিছু মাছি অনেক্ষন ধরেই তার পায়ের উপর ভনভন করে উড়ছে। সে তারাতারি উঠে পড়ল। উঠতে গিয়ে প্রচন্ড জোরে টান লাগলো পেটে। পেটে হাত দিয়ে দেখলো সেখানেও ব্যান্ডেজ। প্রচন্ড ভয় পেল রতন। এসব কি করে হল তার সাথে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে থাকে সে। স্থানীয় এক লোকের সাথে কথা বলে বুঝতে পারল সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী এলাকায় সে এখন। পকেটে হাত দিয়ে দেখলো পুরো ফাকা। আস্তে আস্তে পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে এলো তার সামনে। কাল রাতে মদের আসরের পর মাতাল অবস্থায় ঘুমিয়ে যাবার পরেই তার এই অবস্থা। ডুকরে কেদে উঠলো সে। কিন্তু কে এই অবস্থা করলো তার। কে এই কাজ করতে পারে ভেবে পেল না সে। ভাবনার বিশাল অন্ধকার আচ্ছন্ন করলো তাকে। পেটে খাবার নেই, পকেটে টাকা নেই, এক চোখ নষ্ট,অচেনা জায়গা। আর কিছুই ভাবতে পারছে না সে। ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তার।
চলুন, নেপথ্যের কাহিনী কি আমিই খুলে বলছি। তার এই অবস্থার জন্য দায়ী অসাধু একজন ডাক্তার। সে আর তার কিছু সহচর বহুদিন ধরে এই লাইনে জড়িত। ছিচকে চোর আর ছিন্নমূল ছেলেই তার টার্গেট। অনেকদিন ধরেই নজর রাখে তার উপর যার কিডনী আর চোখের আইরিশ চুরি করে বিক্রি করবে আন্তঃজাতিক চোরাবাজারে। তাই চোরকে সাধারন যাত্রীবেশে প্রথমে লোভ দেখায়। সে ফাঁদে পা দিলেই ধরা খেয়ে যাবে। ফোনে বিশেষ লোকেশান ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং গোপন ক্যামেরা সেট করা আছে। যাতে সিম না থাকেলেও ট্র্যাক করা যায়। সেই অনুযায়ী চোর ফোন চুরির পরে কোথায় আছে, কি করছে আগে থেকেই জানতে পারে তারা।
সন্ধার পর থেকেই রতনকে চোখে চোখে রাখছিল তারা। রতন মাতাল হয়ে ঘুমানোর পরেই সুযোগ বুঝে অজ্ঞান করে ফেলে রতনকে। তারপর তাদের গোপন আস্তানায় নিয়ে কিডনী এবং চোখের আইরিশ অপারেশন করে নিয়ে নেয় তারা। তারপর ওকে নিয়ে ফেলে আসে সাতক্ষীরা সীমান্তে, ইছামতি নদীর উপকূলবর্তী এলাকায়। খুন করে না একদম। ভিক্টিম কে এইভাবে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে পাশবিক আনন্দ পায় তারা। ভিক্টিম ওই অবস্থায় ভিক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় পায় না আর থানাতেও মামলা করতে পারে না কারন তারা নিজেরাও চুরি ছিনতাই এর সাথে জড়িত। কাজেই কোন ধরনের আইনি সহয়তা পাবে না ভিক্টিম।
তারা এখন খুজে বেড়াচ্ছে নেক্সট টার্গেট কে। দেখা যাক, কে হয় তাদের নতুন শিকার।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৩:৪১