আপনার পড়া প্রথম বই কি ছিল?
ব্রেমেনের গায়কদের গল্প? নাসিরুদ্দীন হোজ্জা? ঠাকুরমার ঝুলি? চাচা চৌধুরী, না আরব্য রজনীর গল্প? নাকি ইসলামের কোন এক খলীফার আটার বোঝা মাথায় নিয়ে গরীব প্রজার ঘরে পৌঁছে দেয়ার কাহিনী?
বোধোদয় হবার পর থেকে যেসব বই পড়ার অভিজ্ঞতা স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পাই, তার মধ্যে আরো অনেকগুলোর সাথে বিশেষ করে এ বইগুলোর কথাও বেশ মনে পড়ে। মায়ের মুখে অবশ্য আরো পুরনো গল্প শুনতে পাই, পড়তে শেখার আগের গল্প। পুঁচকে আমি বাবার এনে দেয়া ছবিওয়ালা বইগুলোর দিকে রাজ্যের আগ্রহ নিয়ে নাকি চেয়ে থাকতাম, আর কি ঘটছে বুঝতে না পারলে গিয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে আসতাম। পড়তে শেখার পরও প্রথমদিকে পড়ার চেয়ে শুনতেই ভাল লাগতো কখনো কখনো।
আরো একটু যখন বড় হলাম, প্রাইমারিতে পড়ি, তখন বইয়ের তালিকায় নতুন করে যোগ হল 'তিন গোয়েন্দা'। প্রথমে ভাল লাগত না, মনে আছে একবার ভাইয়ের ওপর রেগে গিয়ে কোনটার যেন পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম গোটাকয়েক। তারপর আস্তে আস্তে একসময় নিজেই নেশায় পড়ে গেলাম।
এরপর শুরু হল কিশোর ক্লাসিকের পালা। শার্লক হোমস আর জুলভার্নের পেটমোটা সমগ্রের সাথে ঘর ভরল সেবা আর প্রজাপতির পুঁচকে সাইজের লোভনীয় বইগুলো দিয়ে। 'তিন গোয়েন্দা' আর ভাল লাগে না, বন্ধুদের ভাল লাগার কথা শুনলেই নাক কুঁচকে বসে থাকতাম। তখনই একটু একটু করে ভাবতে শিখেছিলাম জীবন নিয়ে, হাইস্কুলের গণ্ডী পেরোইনি তো, চোখে রঙের খেলা! নানান ধ্যান-ধারণা আর দর্শন তখন থেকেই শেকড় গেড়ে বসে মনে, যার অনেক কিছুই বদলে গেছে পরে, তবে কিছু আছে সেই আগের মতই, পুরনো সব বইয়ের গন্ধ নিয়ে।
বাঙ্গালি লেখকদের বই তুলনামূলকভাবে কম পড়া হত তখন, হুমায়ুন আহমেদ আর জাফর ইকবাল ছাড়া। এদের ভক্ত হতে পারিনি অবশ্য কখনো। নাইন-টেনের দিকে দুজন লেখকের অসম্ভব ভক্ত হয়ে পড়লাম। এদের একজন হলেন জয় গোস্বামী। দুটো মাত্র বই পড়েছি এই কবির, দুটোই আবার উপন্যাস! এত বেশি অন্যরকম..মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো একেবারে! প্লেটোনিক ভালবাসার ধারণাটা মাথায় গেড়ে বসে তখনই, এখন আর নেই অবশ্য। তবে তাঁর কাছ থেকেই অনেক কিছু অন্যরকম করে ভাবতে শিখেছিলাম।
আর দ্বিতীয়জন, বুদ্ধদেব বসুর 'তিথিডোর' পড়ে তো আমি অবাক! একেবারেই আমার মত এক চরিত্র ছিল সেখানে। তার ওপর আমার কোন কোন বন্ধুও যখন তাই বলল, আমাকে আর পায় কে! খুবই ভাল লেগেছিল, তাই কয়েক বছর পর খুব আগ্রহ নিয়ে আবার পড়তে বসি বইটা, কিন্তু আগের মত করে নিজের ছায়া আর খুঁজে পাই নি। "পাল্টে গেছি"-মনে মনে ভাবলাম।
কলেজে বই পড়েছি খুব কম, আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আবিষ্কার করলাম, ফিকশনের ওপর আগের মত টান আর নেই। ঝুঁকে পড়লাম নন-ফিকশনের দিকে। মানবিকের কোন বিষয় নিয়ে কেন পড়ছি না সে শোক আগেই ছিল, এসময় আরো বাড়ল। মায়ের অনেক করে বলার পরও যে ধর্ম বিষয়ক বই খুবই কম পড়তাম, তা নিয়েও দেখা গেল এসময় নিজে থেকেই অনেক পড়াশোনা শুরু করেছি।
কাজের চাপে স্কুলজীবনের মত অতো বই পড়া এখন আর হয় না, তবু চেষ্টা করি সবসময়ই পড়ার মধ্যে থাকতে। বইকে যখন বলা হয় 'soul food', অনেকের মত আমারো একে অত্যুক্তি মনে হয় না। 'তিথিডোর'-এর একটা কথা খুব মনে পড়ে-বই না পড়লে আমরা শুধু নিজের মনের কথাই জানতে পারি, আর বই অন্যের মনের কথা জানারও সুযোগ করে দেয়। তাই আবুল ফজলের মত করে আমিও সবসময় বলতে চাই-
"বই আমার সঙ্গী; নিত্যসঙ্গী, শয্যাসঙ্গীও।"