নাগরিক শহরের যান্ত্রিক জীবন, অপ্রাপ্তি, অসাড়ময়তা, নৈরাশ্যের ঘেরাটোপে বন্দি মন। হাঁপিয়ে উঠে দম নেবার জন্যে যেই পরিচিত জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, দেখি আমার জানালার বিশাল আকাশটি সংকুচিতপ্রায়, নির্মাণাধীন দালানে ঢাকা পড়ার অপেক্ষায়। হঠাত্ করেই যেন আমার দম আটকে আসা একটা অনুভূতি হচ্ছিল।
তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্তে গ্রামে চলে এলাম গত বিকালটিতে, তখন বোধকরি গ্রামের সবাই অম্বুবাচী'র আয়োজনে ব্যস্ত।
বেশ স্বস্তি লাগছে এখানে এসে। না, দম নিতে তেমন কোন অসুবিধাও হচ্ছে না আর। গত সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি। গোড়ালি পর্যন্ত পানি উঠান জুড়ে। বাড়ির পিছনটা জঙ্গলমতো হয়ে আছে। মল্লিকার ঝোপগুলো বড় হয়ে গেছে অনেক। করবী গাছটার একটা ডাল ভেঙে পড়েছে দেখে আমার স্বপ্নগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। আম গাছে দু'একটা আম এখনো ঝুলছে, কাঁঠাল তো আছেই। পাশের উঠানের হরিতকী গাছে মুকুল এসেছে দেখে আমার প্রচণ্ড পাখি হতে ইচ্ছে করে। মনে মনে ঠিকও করেছি কাক হব। ছোটবেলায় পুকুর পাড়ের আমগাছ থেকে একটা কাকের বাচ্চা একবার পড়ে গেছিল। ভাই আর আমার অতিরিক্ত যত্নে মারা যাওয়া কাকের বাচ্চাটির কথা মনে পড়ে গেল।
বিদ্যুত বাবু এখানে অতিথি, মাঝে মাঝে আসেন। তবে খারাপ লাগছে না বরং সে আসলেই বেমানান ঠেকে আমার কাছে। কেরোসিন বাতি আর হারিকেনের আলোর কাছে আমার স্বপ্নগুলো ঋণী। বাতাসে বাতির শিখাটি দুলছে সাথে আমার ছায়াও। আলো আঁধারিতে দোদুল্যমান ছায়ার খেলা ভালো লাগে না আমার। ছোটবেলায় নিজের ছায়া নিয়ে কত কৌতুহলই না ছিল আমার! অন্ধকারে সেসব শৈশব আমার কাছে চলে আসে যেন হাত বাড়ালেই ফিরে পাব।
সন্ধ্যে থেকেই অবিরাম ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাক শুনে মোজার্ট, বিটোফেন এর মত সুরস্রষ্টাকে নস্যি মনে হচ্ছে আমার ওদের কাছে। আহির ভাঁয়রোর চেয়ে ব্যাঙের ডাকই যেন আমায় আজ বেশী সম্মোহন করছে।
অন্ধকারে ঘরে ঢুকে পড়া জোনাক পোকাটি যেন আরো কিছু শৈশবকে কাছে এনে দিল আমার।
সন্ধ্যে হতেই জোনাক ধরার প্রতিযোগীতায় নামতাম ভাইয়ের সাথে। হোমিও ওষুধের শিশিতে জোনাকি ভরে অন্ধকার ঘরে রেখে দেখাটাই ছিল খেলা।
জোনাকিটি বেরিয়ে যেতেই আমার ভাবনার ঘরে আবার নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে এল। বাইরে ঘরের চালায় বৃষ্টির শব্দ জোরালো হচ্ছে, ঝিঁ ঝিঁ-ব্যাঙের ডাক মিলিয়ে যাচ্ছে আর আমি অন্ধকারে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছি...
২৫ জুন ২০১১
রাত ১০.২৫