আরও একটি বিনিদ্র রাত আমি পার করছি। আজ নিয়ে ২৩ টি রাত আমি ঘুমাই নি। আমি প্রতি রাতেই ভাবি কাল রাতটি এমন হবেনা নিশ্চয়ই। আমি প্রতি রাতেই আশাহত হই। আমার আলো জ্বালতে ইচ্ছে হয় না। অন্ধকারেই আকাশ কুসুম ভাবি। আমার ঘরের জানালাটিতে তাকালেই অবারিত আকাশ দেখা যায়। আমার এ ঘরটিতে দুটো জানালা।একটিতে তাকালে দেখি নির্জন গলিপথে লাইটপোস্টের আলো কিংবা তার নিচে ঘুমিয়ে থাকা কুকুরটি। আর একটিতে তাকালেই আকাশ। তারাবিহীন এ আকাশ আমার চোখে স্বপ্ন জাগাতে পারে না। দু'য়েকটি তারা যদিও উঁকি দেয় কিন্তু তাদের দিকে চেয়ে আমার হাসিই পায়।
দু' গ্লাস জল খেয়ে খানিক টিভি দেখার চেষ্টা করে আবার ফিরে আসি জানালার ধারটিতে। হাতের কাছেই তিনটা নতুন বই পড়ে থাকা সত্ত্বেও আমি সেগুলির দিকে হাত বাড়াই না। বইগুলো আমার অফিসের কলিগরা দিয়েছিল। আমি বইগুলো খুলে ভেতরের পাতায় নাক ডুবিয়ে দেই। সেই ঘ্রাণ! ছোটবেলায় স্কুলে নতুন বই দিলে সারা পথ আমি বইয়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে আসতাম। সময় অনেক দূরে এনে ফেললেও সেই অভ্যেস আমায় আর ছাড়ে নি। বইগুলো স্বস্থানে রেখে আমি পুনরায় আকাশ দেখতে ব্যস্ত হই।জানালা দিয়ে এই ধোঁয়াচ্ছন্ন, রিক্ত আকাশ দেখে আমার চোখে ক্লান্তি আসার কথা হলেও ক্লান্ত হয় না চোখ দুটো।
আমার খুব ইচ্ছে করে এই মাঝ রাত্তিরে ছাদে গিয়ে আমার হাস্নাহেনা গাছটির পাশে চোখ বুজে বসে থাকি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে আমি বেশ শখ করেই হাস্নাহেনার একটা গাছ লাগিয়েছিলাম, ছোটকা' এনেছিল গাছের চারাটি। কিন্তু ঘরে সাপ ঢুকবে বলে হঠাৎই একদিন ঠাম্মা গাছটি কেটে দেয়। আমি হাস্নাহেনার কল্পিত গন্ধে বিভোর হই। এই বিভোরতাও আমায় খানিক তন্দ্রাচ্ছন্ন করতে বিফল হয়। বরং সেই বিভোর চোখে ভেসে উঠে কেটে ফেলা সেই চারাটি। কাটা ডাল আর উপড়ানো শিকড় দেখে স্কুল থেকে ফিরেই কাঁদতে বসেছিলাম 'আমার গন্ধফুলের চারা' বলে। পরে ছোট পিসি বেশ কয়েকটি বেলীফুলের চারা লাগিয়েছিল উঠানে।
মুহূর্তেই আমার মন উড়ে যায় বাড়ির সেই উঠানে যে উঠান আমায় টলোমলো পায়ে হাঁটতে দেখেছে, হাঁটতে হাঁটতে যার বুকে অজস্রবার লুটিয়ে পড়েছি। কিংবা যেই উঠানটি আমায় ভর দুপুরে মায়ের শুকাতে দেয়া আমসত্ত্ব চুরি করতে দেখেছে সেই উঠানে। আমার ইচ্ছে করে ওই উঠানটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে।
কিছুক্ষণ নির্জীব হয়ে পড়ে থাকার পর হঠাৎই অস্থির লাগে আমার। অস্থিরতা থেকে বাঁচতে ছুট লাগাই উর্ধশ্বাসে। ছুটতেই থাকি কেবল।ছুটতে ছুটতে খেয়াল করি আমি একা নই। আরো একটি মেয়ে ছুটছে, ওর কোচরভরা শিউলী ফুল। আমার মনে পড়ে গেল কোন এক শরতের দিনে স্কুল থেকে ফেরার সময় পথের পাশে শিউলী ফুল কুড়াতে কুড়াতে কখন যে সবাই আমাকে ফেলে গেছে খেয়াল ছিলনা। আমি ভয়ে মাইল দুয়েক পথ এমনি উর্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে এসেছিলাম। আমার সাথে ছুটে চলা এ কি তবে সেই আমিই?
এই 'আমি'র পেছনে ছুটতে ছুটতে আমি চলে আসি বিশাল এক মাঠে। মাঠে হাজার হাজার জোনাকী! আর আকাশে অসংখ্য তারা! আমার সামনে যেন দু' দুটো আকাশ সমান্তরালে রয়েছে। আমি পাগলের মত কোচর ভরে নিতে থাকি জোনাকী আর তারা। এক হাতে কোচর ধরে অন্য হাতে কখনো এক মুঠো তারা আবার কখনো মুঠো ভরে নিচ্ছি জোনাকী। তবুও আমার কোচর ভরে না। আমি কাতর হয়ে তারা কিংবা জোনাকী ধরতে থাকি। এবার সেই 'আমি'টি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করে এই তারা আর জোনাকীতে আমি কী করব? আমি জানাই আমার রিক্ত আকাশে সাজাব। সে এবার আমাকে বলে, 'আমার ফুলগুলো নেবে?' আমি কোচর পেতে ফুলগুলো নিতেই ভরে যায় সেটি।
তখুনি যেন তীক্ষ্ণ কোন শব্দ আমায় ফিরিয়ে আনে সেই জানালার পাশেই। শব্দটি পাহারারত পুলিশের বাঁশির। নিচে তাকিয়ে দেখি জনা তিনেক পুলিশ গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম এবার। মনে হল যেন অন্যদিনের তুলনায় আজ যেন তারা অনেক বেশিই। আমি নিশ্চিত এতগুলো তারা খানিক আগেও ছিলনা। আমি আবার আচ্ছন্ন হই তারা দেখতে দেখতে...৩০ মার্চ, রাত ২.৪৯