চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের ডাকা অবরোধ চলছে গত ৩০ আগস্ট থেকে। অবরোধটি তারা ডেকেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নাম ব্যবহার করে। শিবির ট্রেনে কয়েকবার ককটেল হামলা এবং পাথর নিক্ষেপ করে। কিন্তু ঘটনাগুলি গণমাধ্যমে স্থান পেলেও অতটা আলোচনা হয়নি যতটা হচ্ছে ১০ সেপ্টেম্বর শিক্ষকবাসে হামলার পর। হামলায় ৯ শিক্ষকসহ ১৪ জন আহত হয়। এই ঘটনার পরপরই শিক্ষকসমিতি মিছিল করে। সিনেটের জরূরী সভায় নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয়। পরদিন ছাত্ররাও প্রতিবাদমিছিল করে এবং শিক্ষকরা এক ঘন্টা কর্মবিরতি পালন করে। আজকেও শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন করছেন। আমি আমার শিক্ষকদের উপর সন্ত্রাসী হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। শাটল ট্রেনে বিদ্যার্থীদের উপর বোমা হামলার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এ হামলা যারা করেছে তারা আর যাই হোক ছাত্র নয় তারা সন্ত্রাসী পদবাচ্য। আমার ছয় বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষকদের উপর এ ধরণের হামলা এই প্রথম। যদিও শিক্ষার্থীদের উপর বহু হামলা/নির্যাতন হয়েছে কিন্তু তার প্রতিবাদ হয়নি। হয়নি বললে ভুল হবে, বলা উচিত আসলে শিক্ষকদের দ্বারা হয়নি। তাহলে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা কি প্রতিবাদযোগ্য নয়?
দুটো ঘটনার কথা বলছি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের।
ঘটনা -১
২০০৯ সালের মে মাসের শেষের ঘটনা। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি সবে ছ'মাস। পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের ২য় বর্ষের এক ছাত্রলীগের গুণ্ডা শামসুন্নাহার হলের সামনে একই বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেনীর এক ছাত্রীকে মারধর করে।
এই ঘটনার ৩ দিন পরেও অই গুণ্ডার বিরুদ্ধে প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিল না। তাকে প্রতিদিন ক্যাম্পাসে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে দেখা গেলেও পুলিশ তাকে খুঁজে পেল না। উপরন্তু ছাত্রীটিকে নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল স্বয়ং ভিসি এবং প্রশাসনের শিক্ষক শাখার পুলিশ অর্থাৎ প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক মুখে টুঁ শব্দটি করলেন না। ৩য় দিনে যখন ৩টি হলের ছাত্রীরা বিক্ষোভ করছিল তখন হলের প্রভোস্ট রা তাদের হল থেকে বের না হতে নানা ভয়ভীতি দেখায়। মিছিলের মধ্যে কয়েকজন শক্ষক বাজে ব্যবহার করে ছাত্রীদের সাথে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে অবশেষে অই ছাত্রলীগ কর্মীকে আজীবনের জন্যে বহিষ্কার করা হয়।
ঘটনা ২-
২০১০ সালে হঠাৎ করেই প্রশাসন শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়িয়ে দিল প্রায় ৭৫%। প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা একটা মানববন্ধন কর্মসূচীর ডাক দেয়। মানববন্ধন শেষে তারা স্মারকলিপি দেবে উপাচার্য বরাবর।
অতি নিরীহ একটা কর্মসূচী ছিল শিক্ষার্থীদের। জমায়েত ছিল মাত্র এক থেকে দেড়শ' জনের। কিন্তু না, এরকম নিরীহ কর্মসূচীর মাঝখানে শিক্ষক পুলিশের সাব ইন্সপেক্টরদের একজন চন্দন পোদ্দার গিয়ে মেরে বসল বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মী সুজন কান্তি দে কে।
ব্যস, সেই এক দেড়শ' শিক্ষার্থীকে দ্বিগুণ হতে আরেক ফাগুন এর অপেক্ষা করতে হয় নি। মুহূর্তেই দশগুণ হয়ে গেছিলো। প্রায় হাজার দু'য়েক শিক্ষার্থী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
প্রায় সপ্তাহ খানেক তারা শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ জানায়। শান্তিপূর্ণ এই অর্থে যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সম্পদের ক্ষতি করে নি , কোন শিক্ষককে অপমান করে নি। তারা তো আর লীগ/শিবিরের কর্মীদের মত বেয়াদব নয় যে আপনাদের মানে মহান শিক্ষকদের মেরে ধরে দাবি আদায় করত।
অথচ প্রশাসন নির্বিকার। মহামান্য উপাচার্য তার কক্ষ থেকে উঁকি দিয়েও হয়ত দেখেন নি, দেখবেনও কী ভাবে, তিনি তার চাটুকারদের পরিবেষ্টন থেকে বের হলে তো! যদিও তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে সমস্ত পত্রিকার মূল্যবান জায়গা কিনে বিজ্ঞাপণ দিচ্ছিলেন যে এটা গুটি কয়েক বামপন্থী দুষ্কৃতিকারীর কাজ। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। মানুষ তো অন্ধ ছিল না ! যারা প্রশাসন আর দলীয় ঠুলি চোখে দেন না তারা জানেন, বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে জানার পর এই আন্দোলনে দেশের বাইরে থেকেও বহু ছাত্র সংগঠন সংহতি জানায়।
আর কোন উপায় না দেখে আগস্টের ২ তারিখে ছাত্ররা নগরীর ২ নম্বর গেইটে অবস্থান নেয়। উদ্দেশ্য ছিল নগরবাসীকে জানানো বিশ্ববিদ্যালয়কে কী ভাবে সাধারণের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত করছে প্রশাসন। অইদিন রাষ্ট্রীয় লেঠেল বাহিনী ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বহু শিক্ষার্থীকে নির্যাতন ও আটক করে।
প্রতিবাদে পরদিন আরো উত্তাল হয়ে উঠে আন্দোলন। সবথেকে নিকৃষ্টতম দিন মনে হয় আমার মতে। শিক্ষক পুলিশের সরাসরি নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় লেঠেলবাহিনী ছাত্রীদের উপরে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। উপাচার্য মশাই তার পালিত ছাত্রলীগের কিছু গুণ্ডা দিয়ে ভাংচুর। চালায় এবং যার দায় চাপায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর।
উপরের দুটো ঘটনাতেই আমাদের মহান শিক্ষকেরা কোন প্রতিবাদ জানালেননা। ব্যতিক্রম ছিলেন অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম এর মত শিক্ষক । সেদিন শিক্ষকদের কোন সংগঠন প্রতিবাদ তো দূরের কথা টুঁ শব্দটিও করলেন না। দরদ দেখিয়ে আহা উঁহু করলেও শান্তি পেতাম।
ছাত্রীদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় সারাদেশে নিন্দার ঝড় উঠলেও আমাদের মহান শিক্ষকেরা (যারা আজ প্রতিবাদমুখর) তারা ঠুলি পরে বসেছিলেন। পাছে ক্যারিয়ার না নষ্ট হয় আবার! ধিক!
প্রশাসনবান্ধব শিক্ষক (?)দের মধ্যে অনেকের ভূমিকা বেশ উজ্জ্বল। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পুলিশের ইন্সপেক্টর জসিম (বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতির কারনে বিখ্যাত), সাব ইন্সপেক্টর চন্দন পোদ্দার (গৃহকর্মীকে ধর্ষণের মামলা করেন তার স্ত্রী নিজেই), কনস্টেবল তৌহিদ (ছাত্র উপদেষ্টা), সার্জেন্ট আলী হায়দার আরো অনেকেই। এরা ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করেন, তাদের বাসায় ফোন করে হুমকি দেন। আরো একজন মহান শিক্ষকের কথা উল্লেখযোগ্য, মিল্টন বিশ্বাস নামের অপদার্থ, বেয়াদব কুলশিরোমণিটি কালের কন্ঠে কয়েক গণ্ডা উপসম্পাদকীয় লিখেছিলেন। তাতে বলেছিলেন ছাত্রীদের উপর কোন হামলা হয় নি। তারা নিজেরা হলের ভিতর দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে গিয়ে আঘাত পেয়েছেন। এই অসভ্যটি ছাত্রীর খাতা লিখে দেয়ার অপরাধে পদাবনতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। বলাবাহূল্য এসব লিখে তিনি উপাচার্যের নেকনজরে আসার চেষ্টারত ছিলেন ।
বাদবাকী সকল সম্মানিত শিক্ষকগণ মূক-বধির-নেত্রহীন অবতার রূপধারণ করেছিলেন সেই সময়ে। মনে আছে আমার বিভাগেরই এক শিক্ষক দরজা লাগিয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন সে সময় (তিনি এখন বেশ প্রতিবাদমুখর)।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বগি গ্রুপের চেলারা যখন প্রতিদিন, প্রতিটি ট্রেন এ সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানী করে, মারধর করে, ইভ টিজিং করে তখনো আপনারা চুপ থাকেন। শিবির যখন হলের শিক্ষার্থীদের হয়রানী করে আপনারা চুপ থাকেন কিংবা আপনাদের দলীয় দর্শন আপনাদের চুপ করিয়ে দেয়।
যে সব প্রক্টর সাধারণ শিক্ষার্থীকে মারতে লজ্জা পাননা তারাই আবার ছাত্রলীগের ১ম বর্ষের গুণ্ডার হাতেই মার খেয়ে নির্লজ্জ হাসি হাসেন। তাদের পিতা সম্বোধন করেন। প্রশাসন এদের লালন করেন বাহবা দেন। তাদের জন্যে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমাদের শিক্ষকরা নীরবতার অবতার হয়ে যান।
প্রকৃত অর্থেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনে শিক্ষক-পুলিশ-দলীয় পরিচয় একাকার হয়ে যায়। কে শিক্ষক কে পুলিশ বুঝতেই পারা যায় না। সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে যান সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। অথচ সেই রুদ্রমূর্তি মিনমিনে মিইয়ে যেতে কিম্বা ওদা/ ফোঁতা হয়ে যেতে দেখি অইসকল ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারদের সামনে। কোন শিক্ষার্থী শিক্ষকদের লিফট ফাঁকা পেয়ে তা ব্যবহার করলেও তো আপনারা প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদ করেন না তো কেবল শিক্ষার্থী আক্রান্ত হলে! ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক তখন আপনারা শ্রেনী সংঘাত জ্ঞান করেন।
শিবির এই অবরোধের ডাক দেয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই ট্রেনে ককটেল হামলা করেছে। কই আমাদের শিক্ষকরা কেন তার প্রতিবাদ করলেন না? প্রতিদিনের হামলা, হুমকির মুখেও শিক্ষার্থীরা ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। আমাদের মহান শিক্ষকরা কেন কুলুপ এঁটে রাখলেন আদর্শের গুহ্যদ্বারে?
তাহলে কি শিক্ষার্থীদের উপরই কেবল হামলা করা যায়?
কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবার আগে দয়া করে ভাববেন সেটি আপনাদের সাথেও হতে পারে।
দু'টি ঘটনারই ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংগৃহীত ছবির লিঙ্ক -
১। Click This Link
২। Click This Link
ব্লগ লিঙ্ক-
Click This Link
Click This Link
নিউজ লিঙ্ক
১। Click This Link
২। Click This Link
৩। Click This Link