সাপকে দড়ি ভেবে যে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত গোটা জাতিকে করতে হবে
একজন বলছিলেন, “ওরা আপনাদের বাচ্চাদের মারেনি। এত জিওপলিটিক্স বোঝেন, এত শিল্প-সাহিত্যের রাজনীতি বোঝেন, কিন্তু এটুকু বোঝেননি—কোনো সরকার এভাবে হত্যা করে ক্ষমতা পোক্ত করে না।”
তার যুক্তি শুনে থমকে গিয়েছিলাম। কারণ আমি তখনও রক্তাক্ত সেই দিনগুলোর স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছি। সাত তলায় স্নাইপারের গুলিতে যখন শিশুদের বুক ঝাঁঝরা হচ্ছিল, আমি তখনও বিশ্বাস করছিলাম—রাষ্ট্র এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। আন্দোলন দমন করতে গিয়েই হয়েছে এ নৃশংসতা। কিন্তু আজ পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, হয়তো আমরা সবাই এক বিশাল ভূরাজনৈতিক খেলায় ঘুঁটি ছিলাম।
হত্যা, রক্তপাত—এসব কখনো একক রাষ্ট্রের স্বার্থে হয় না। এর পেছনে থাকে গভীর ষড়যন্ত্র, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্বার্থের সংঘাত। মানব ইতিহাসে পাতায় পাতায় এমন উদাহরণ ছড়ানো। সাপকে দড়ি ভেবে ভুল করেছে জাতি—এটাই আজ প্রমাণিত।
রাষ্ট্র ক্ষমতার পালাবদল: এক অদৃশ্য হাতের খেলা
যখন আমরা রাস্তায় নেমে বলছিলাম “তোমরা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা ও নৈতিক অধিকার হারিয়েছ, ইউ স্টেপ ডাউন!”, তখন মনে হয়েছিল এটাই ন্যায়। কারণ আমাদের বাচ্চাদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজ বুঝি, যাদের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করছিলাম, তারা হয়তো কেবল আড়ালের পুতুল।
তারা স্টেপ ডাউন করল। কেবল করলই না—পালাতে বাধ্য হলো।
তারপর কী হলো?
দেশের ক্ষমতা চলে গেল তাদের হাতে, যাদের হাত রক্তে রঞ্জিত।
যারা আমাদের আন্দোলনের কুশীলব ছিল, তারাই ক্ষমতার সিংহাসনে বসল।
এখন দাঁড়াল কি? আমরা কি মৌলবাদীদের হাত শক্ত করতে সাহায্য করলাম?
আমরা কি সেই অদৃশ্য ডিপস্টেটের কৌশলে ব্যবহৃত হলাম?
তাহলে কি আমিই অপরাধী
ইউসুফ সরকারের মুখোশ উন্মোচন
আজ যারা ক্ষমতায়, তাদের উপদেষ্টাদের তালিকাই সব বলে দেয়। দেখুন—
১. মুহাম্মদ ইউসুফ
২. আসিফ নজরুল
৩. শারমিন মোর্সেদ
৪. আদিলুর রহমান খান
৫. ফারুক ই আজম
৬. মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী
৭. সিএ আবরার
৮. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
৯. ফরিদা আক্তার
এই নামগুলো কেবল ব্যক্তির তালিকা নয়, এক বিপজ্জনক মতাদর্শের প্রতীক।
এদের পেছনে রয়েছে মৌলবাদী চক্র, যারা রাষ্ট্র দখলের আগে ডিপস্টেটের সহায়তা নিয়েছে। আন্দোলনের ভেতর ঢুকে আমাদের বিশ্বাসকে ব্যবহার করেছে।
আমরা ভেবেছিলাম, এরা পরিবর্তন আনবে। কিন্তু এদের আসল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র কাঠামো দখল করা।
আজ সেটা স্পষ্ট।
হত্যার আসল উদ্দেশ্য
সাত তলার ছাদ থেকে স্নাইপারের গুলি ছুটে যাচ্ছিল।
শিশুদের বুকের ভেতর দিয়ে রক্ত ছিটকে যাচ্ছিল।
বলুন তো, কোনো সরকার কি এত বোকা যে নিজের ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য এভাবে শিশু হত্যা করবে?
না, সরকার কখনোই এমন করে না।
কারণ এমন হত্যাকাণ্ডে জনমতের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়।
এটা রাষ্ট্রের জন্য আত্মহননের সমান।
তাহলে কে করেছিল?
উত্তর একটাই—যারা তখন আন্দোলনকে উস্কে দিচ্ছিল, তারাই।
কারণ তারা জানত, যদি এই হত্যার দায় রাষ্ট্রের কাঁধে চাপানো যায়, তাহলে সরকার পতন অবশ্যম্ভাবী।
আর পতনের পর তারা সেই শূন্যস্থান দখল করবে।
ঠিক সেটাই ঘটেছে।
আমাদের ভুল এবং প্রায়শ্চিত্ত
আমরা আন্দোলন করেছিলাম বিশ্বাস থেকে।
আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম ন্যায়বিচারের জন্য।
আমরা ভেবেছিলাম, এই আন্দোলনের মাধ্যমে দায়ীদের জবাবদিহি করানো যাবে।
কিন্তু বাস্তব হলো—আমরা সেই সাপকে দড়ি ভেবেছিলাম।
আমরা ভেবেছিলাম এরা আমাদের বন্ধু, আমাদের মুক্তির শক্তি।
কিন্তু এরা ছিল আমাদের ধ্বংসের কারণ।
আজ মৌলবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে।
আমাদের আন্দোলনের শক্তিকে ব্যবহার করে তারা নিজেদের ক্ষমতার সিঁড়ি বানিয়েছে।
এখন গোটা জাতিকে তার মূল্য দিতে হচ্ছে।
ব্যক্তিগত প্রশ্ন: আমি কি অপরাধী?
এখন আমি একা বসে ভাবি—
যখন বলেছিলাম “তোমরা রাষ্ট্র পরিচালনার নৈতিক অধিকার হারিয়েছ, ইউ স্টেপ ডাউন!” তখন কি আমি ভুল করেছিলাম?
যখন আমার কণ্ঠে, আমার কলমে, আমার অবস্থানে আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলাম, তখন কি আমি মৌলবাদীদের হাত শক্ত করেছিলাম?
যদি তাই হয়, তবে কি আজ আমিই অপরাধী?
আমাকেও কি প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে?
আমার প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়।
কারণ আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম, সেখানে সত্যকে চেনা অসম্ভব ছিল।
সত্যকে বিকৃত করা হয়েছিল।
আমরা যা দেখেছিলাম, তা ছিল সাজানো দৃশ্যপট।
ইতিহাসের শিক্ষা: ভুল চেনার সাহস
মানব ইতিহাসে অনেক জাতিই এমন ভুল করেছে।
রুশ বিপ্লব থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ—সবখানে দেখা যায়, সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করা হয়।
তাদের আবেগ, তাদের ক্ষোভকে রাজনৈতিক শক্তি শোষণ করে।
অবশেষে ক্ষমতা যায় অন্যদের হাতে, আর জনগণ থেকে যায় ধ্বংসস্তূপে।
আমরা সেই একই ভুল করেছি।
কিন্তু ভুল চেনার মধ্যেই আছে মুক্তির সম্ভাবনা।
আজ যদি আমরা সাহস করে বলি—
হ্যাঁ, আমরা ভুল করেছি।
আমরা সাপকে দড়ি ভেবেছিলাম।
আমরা সেই ভুলের দায় স্বীকার করছি।
তাহলে হয়তো আমরা নতুন প্রজন্মের জন্য সতর্কবার্তা রেখে যেতে পারব।
শেষ কথা
আজ মৌলবাদীরা ক্ষমতায়।
তারা রাষ্ট্রীয় কাঠামো দখল করে নিয়েছে।
আমাদের আন্দোলনের রক্ত, আমাদের শিশুর প্রাণ দিয়ে তারা তাদের সিংহাসন গড়েছে।
আমরা যারা তখন রাস্তায় ছিলাম, যারা তাদের উত্থানে অজান্তে ভূমিকা রেখেছিলাম—
আমাদের কাঁধেই এখন দায়।
এই দায় থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো সত্য প্রকাশ করা এবং ভবিষ্যতের জন্য ইতিহাসের শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া।
হ্যাঁ, আমি অপরাধী নই।
কিন্তু আমি দায়মুক্তও নই।
আমার প্রায়শ্চিত্ত হলো এই স্বীকারোক্তি:
আমি সাপকে দড়ি ভেবেছিলাম।
এবং আমি চাই, আর কেউ যেন সেই একই ভুল না করে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



