somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত উপমহাদেশের জন্য ধ্বংসাত্মক ছিল ।

০২ রা নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রখ্যাত লেখক নিয়াল ফার্গুসনের ‘এম্পায়ার হাউ ব্রিটেন মেড দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড’ এবং ব্রুস গিলের ‘দ্য লাস্ট ইম্পেরিয়ালিস্ট’-এর মতো বইগুলিতে দাবি করা হয়েছে যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা ভারত উপমহাদেশে ও অন্যান্য উপনিবেশে সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন এনেছে। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার এই রঙিন উপস্থাপনা ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে নাটকীয়ভাবে সঙ্ঘাতপূর্ণ। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ রবার্ট সি অ্যালেনের সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারত অঞ্চলে দারিদ্র্য চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা ১৮১০ সালে ২৩ শতাংশ থেকে ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ৫০ শতাংশেরও বেশি। বৃটিশ আমলে প্রকৃত শ্রম মজুরি হ্রাস পেয়ে প্রায় শূণ্যের কোটায় পৌছায়। তখন দুর্ভিক্ষ আরও ঘন ঘন এবং আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা ভারতীয় জনগণের জন্য উন্নয়য়ন নয় বরং একটি মানবিক বিপর্যয় ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, ১৮৮০ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদ ভারতের জন্য বিশেষভাবে ধ্বংসাত্মক ছিল। ১৮৮০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতিগুলি সোভিয়েত ইউনিয়ন, মাওবাদী চীন এবং উত্তর কোরিয়ার মিলিত সমস্ত দুর্ভিক্ষের চেয়ে বেশি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, যার সংখ্যা নূন্যতম ১০ কোটি। এটি মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নীতি-জনিত মৃত্যু সঙ্কট, যা সোভিয়েত ইউনিয়ন, মাওবাদী চীন, উত্তর কোরিয়া, পোল পটের কম্বোডিয়া এবং মেঙ্গিস্তুর ইথিওপিয়াতে সংঘটিত সমস্ত দুর্ভিক্ষ জনিত মৃত্যুর সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বড়।

বৃটিশ শাসনামলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটানোর জন্য দায়ী ছিল বেশ কিছু নীতি। প্রথমত, ব্রিটেন কার্যকরভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের উৎপাদন খাতকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ঔপনিবেশিকতার আগে, ভারত ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প উৎপাদক, বিশ্বের সব প্রান্তে উচ্চমানের টেক্সটাইল রপ্তানি করত। ইংল্যান্ডে উৎপাদিত টাউড্রি কাপড় সহজভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারতো না। এর পরিবর্তন হতে শুরু করে, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে বাংলা অধিগ্রহণ করে। ইতিহাসবিদ মধুশ্রী মুখার্জির মতে, ঔপনিবেশিক শাসন কার্যত ভারতীয় শুল্ক লোপ করে দিয়ে ব্রিটিশ পণ্যগুলিকে অভ্যন্তরীণ বাজার সয়লাব করার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু অত্যধিক কর এবং অভ্যন্তরীণ শুল্ক ব্যবস্থা তৈরি করে তারা ভারতীয়দের নিজেদের দেশে কাপড় বিক্রি করতে বাধা তৈরি করে।

এই অসম বাণিজ্য ব্যবস্থা ভারতীয় ব্যবসায়ী ও নির্মাতাদের পিষে ফেলে এবং কার্যকরভাবে দেশটিকে শিল্পহীন করে। ১৮৪০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যান্ড চায়না অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গর্ব করে বলেছিলেন, ‘এই কোম্পানি ভারতকে একটি উৎপাদনকারী দেশ থেকে কাঁচা পণ্য রপ্তানিকারী দেশে রূপান্তরিত করতে সফল হয়েছে।’ ভারতকে দারিদ্র্য নিমজ্জিত করে ইংরেজ শিল্প মালিকরা একটি অসাধারণ সুবিধা লাভ করেছিল। এবং এই উপমাহদেশের লোকেরা ক্ষুধা ও রোগের শিকার হয়েছিল। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গড়ায়, যখন ব্রিটিশরা আইনী কৌশলে লুণ্ঠনের একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যা সমসাময়িকদের কাছে ‘সম্পদের শোষণ’ হিসাবে পরিচিত। ব্রিটেন প্রধমে ভারতীয় জনগণের উপর কর আরোপ করে এবং তারপর ভারতীয় পণ্য নীল, শস্য, তুলা এবং আফিম কেনার জন্য ভারতীয় রাজস্ব ব্যবহার করে। এইভাবে তারা এই পণ্যগুলি বিনামূল্যে উপলব্ধ করে।

এই পণ্যগুলি সেসময় হয় ব্রিটেনের ব্যবহৃত হত বা সেখান থেকে বিদেশে পুনরায় রপ্তানি করা হত এবং ব্রিটেনের পকেটে সেই রাজস্বগুলি ঢুকতো। দেশটি তার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো উপনিবেশগুলিতে শিল্পোন্নয়নের জন্য অর্থায়নে ব্যবহৃত হত। এভাবে ব্রিটেন আজকের অর্থমূল্যে ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের পণ্য ভারত থেকে শোষণ করেছে। ব্রিটিশরা তাদের শোষণ নীতি চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে চরম নির্দয় ছিল। এমনকি, খরা বা বন্যা স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেললেও তারা ভারতকে খাদ্য রপ্তানি করতে বাধ্য করেছিল।

ইতিহাসবিদরা প্রমান করেছেন যে, ১৯ শতকের শেষের দিকে বেশ কয়েকটি ব্রিটিশ নীতি-প্ররোচিত দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ ভারতীয় অনাহারে মারা গিয়েছিল, কারণ তাদের সম্পদ ব্রিটেন এবং এর বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশগুলিতে চলে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক প্রশাসকরা তাদের নীতির পরিণতি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। কিন্তু তারা জেনেশুনে মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতে থাকেন এবং লাখ লাখ লোককে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাখেন। ভিক্টোরিয়ান যুগের শেষের দিকে ভারত উপমহাদেশের অস্বাভাবিক মৃত্যুসংকট কোন দুর্ঘটনা ছিল না। ইতিহাসবিদ মাইক ডেভিস যেমনটি বলেছেন, ‘ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী নীতিগুলি নৈতিকভাবে প্রায়শই ১৮ হাজার ফুট থেকে বোমা ফেলার সাথে সমতুল্য ছিল।’




সূত্র: আল-জাজিরা।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ২:৩৯
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×