এস এম সামছুর রহমান,বাগেরহাট
সুন্দরবনে একের পর এক বনদস্যু বাহিনী প্রধানসহ প্রায় অর্ধশত বনদস্যু নিহত হলেও থেমে নেই জেলে-বাওয়ালী অপহরণ। আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপনের বিপুল পরিমান টাকা। গত দুই বছরে র্যাব, পুলিশ ও কোষ্টগার্ডের সফল অপারেশনে প্রায় অর্ধশত বনদস্যু নিহত হয়। এই হতাহতের পর আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সুন্দরবন সংলগ্ন সাগরে নিয়োজিত জেলেরা সুন্দরবনে যাতায়াত নির্বিঘœ হবে বলে মনে করেছিল। কোন ভাবেই দমানো যাচ্ছে না সুন্দরবনের বনদস্যু বাহিনীকে। নতুন নতুন বাহিনী গঠন করে বনদস্যুরা এখনও করছে রাম রাজত্ব। গত এক সপ্তাহে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় ৫৪ জেলে অপহরণ হয়েছে।
সুন্দরবনে মৎস্য আহরণে নিয়োজিত জেলে ও বাগেরহাট উপকূলীয় মৎস্যজীবী কল্যান সমিতি সূত্রে জানাগেছে, গত এক সপ্তাহে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকুলীয় এলাকা ও সুন্দরবনে নিয়োজিত ৫৪ জেলে ও বাওয়ালীদের মুক্তিপনের দাবীতে অপহরণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২৮ মার্চ বাকী বিল্লাহ বাহিনী সুন্দরবনের শিফসা নদী থেকে মুক্তিপনের দাবীতে ১২জন জেলেকে অপহরণ করে। এসময়ে ওই বনদস্যু বাহিনী ১৮ টি মৎস্য ট্রলার থেকে ৫মন মাছ ও মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এদিনের অপহৃত জেলেদের নিকট থেকে মোটা অংকের অর্থ মুক্তিপনের জন্য দাবী করা হচ্ছে বলে জেলেদের পরিবার জানায়। এর দুইদিন আগে ২৬ মার্চ বঙ্গোপসাগরের ১ নং বয়া এলাকা থেকে মাহাবুবুর রহমান ওরফে সাইজে বাহিনী ৩০ টি ফিসিং ট্রলার থেকে একজন করে মাঝি (চালক/ চুকনী) কে মুক্তিপনের দাবীতে অপহরণ করা হয়। এই বাহিনীর সদস্যরা অপহৃতদের মুক্তিপনের জন্য জনপ্রতি দুই লক্ষ টাকা দাবী করেছে। অপরদিকে ২২ মার্চ সুন্দরবনের মৃগামারী খালা এলাকা থেকে মোর্তজা বাহিনী ৫ টি নৌকা থেকে ১২ জেলেকে অপহরন করে। এদের কাছ থেকেও মোট অংকের টাকা মুক্তিপন নির্ধারন করা হয়েছে। বনদস্যু বাহিনীগুলোর মধ্যে বাকী বিল্লাহ, মাহাবুবুর রহমান সাইজ্যে ও মোর্তজা বাহিনী নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করেছে বলে সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালীরা জানায়।
এদিকে বাগেরহাট উপকূলীয় মৎস্যজীবী কল্যান সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী শেখ ইদ্রিস আলী জানান, গত এক সপ্তাহে ৬১ জেলেকে অপহরন করা হয়েছে। অপহৃত প্রত্যেকের নিকট দুই লক্ষ টাকা মুক্তিপনের দাবী করা হয়েছে। এই ঘটনার পর মৎস্যজীবী ও মৎস্যজীবী পরিবারগুলোর সদস্যরা চরম আতঙ্ক ও উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছে। শুধু বনদস্যুদের নির্মূল করলে হবে না। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতা গডফাদারদেরও নিমূল করার দাবী জানান ইদ্রিস আলী।
র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন র্যাব-৮ সূত্রে জানাযায়, ২০১০ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত র্যাবের ২১ টি সফল অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসকল অভিযানে ১৬ জন বনদস্যু গ্রেফতারের পাশাপাশি ৬ জন বনদস্যু বাহিনীর প্রধানসহ ৩০ জন বনদস্যু র্যাবের সাথে গুলিবিনিময়ে নিহত হয়। একই সময়ে র্যাব প্রায় দেড়শত দেশী-বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র ও দেড় সহস্রাধিক গোলাবারুদ উদ্ধার করে। এছাড়া চলতি বছরের ফেব্র“য়ারী ও মার্চ মাসে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে গামা বাহিনীর প্রধান জুলফিকার আলী গামা ও সোহরাব বাহিনীর প্রধান সোহরাব নিহত হয়।
নতুন নতুন বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে সুন্দরবনে অপহরণ ও মুক্তিপনের বিষয়ে র্যাব-৮ এর পটুয়াখালী ইউনিটের লে. কমান্ডার নুরুজ্জামান জানান, জেলে-বাওয়ালী ও পর্যটক বান্ধব সুন্দরবন গড়তে সুন্দরবনের বনদস্যুদের দমনে র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা গুলোর অধিবাসীদের অধিকাংশই তাদের জীবিকা নির্বাহের কেন্দ্রস্থল এই সুন্দরবন। ঐশ্বর্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর জীব বৈচিত্রে ভরা সুন্দরবনে পর্যটক আগমনও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পিরোজপুর ও ভোলা জেলার কয়েক লাখ উপকূলীয় মানুষ বিগত কয়েক দশক ধরে সুন্দরবনে মধু, কাঠ, গোলপাতা, চিংড়ির পোনা, কাঁকড়া, সাদা মাছ ও শুটকি আরোহন করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাকে সংগী করে এসকল মানুষ প্রতিনিয়তই জীবন যুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে বনদস্যুদের অপতৎপরতা। প্রায় দুই যুগ ধরে বনদস্যুদের অপতৎপরতা সুন্দরবন কেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সীমাহীন দুর্ভোগ আর আতংকের কারন হয়ে দাঁড়ায়। বনদস্যুদের এই অপতৎপরতার কারনে অনেক জেলে-বাওয়ালী জীবন ভয়ে এবং মুক্তিপনের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছে। বনদস্যু মুক্ত সুন্দরবনে জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে জেলে বাওয়ালীরা সরকারের নিকট দাবী জানিয়েছেন।