ইদানীং কন্যা সন্তানকে ছেলেসুলভ সম্বোধনে ডাকার সংস্কৃতিতে ক্রমশই অভ্যস্ত হয়ে উঠছি আমরা। সোজা ভাষায়, আদর করে মেয়ে সন্তানদের ‘মা’ কিংবা ‘আম্মু’ না ডেকে তাদের সম্বোধন করছি ‘বাবা’ কিংবা ‘আব্বু’ বলে। উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর অনুকরণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবারগুলোতেও এভাবে ডাকবার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মেয়ে সন্তানকে ‘বাবা’ কিংবা ‘আব্বু’ বলে ডেকে আমরা নিজেদের স্মার্ট ভাবলেও এর পেছনে যে নারীসমাজকে চরমভাবে হেয় করা হচ্ছে তা কিন্তু কেউই ভেবে দেখছি না।
এই সংস্কৃতিটি আমাদের দেশে আমদানি করবার পেছনে বহুজাতিক একটি কোম্পানির অবদান অনস্বীকার্য। কোম্পানিটির বিশ্বখ্যাত প্রসাধনী সামগ্রীর বিজ্ঞাপনে নিজ মেয়েকে ছেলেসুলভ সম্বোধন তথা ‘বাবা’ বলে ডাকতে দেখা গিয়েছিল আজ থেকে বছর কয়েক আগেই। এখনো কালে-ভদ্রে সেই বিজ্ঞাপনটি প্রচারিত হয়ে থাকে আমাদের মিডিয়ায়। এই সংস্কৃতিটির প্রসারে সেই বিজ্ঞাপনটি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তা বলা যেতেই পারে।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মূলত সম্ভাবনাময় দেশগুলোতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের পথ সুগম করে নেয়। এ উদ্দেশ্যে চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে টার্গেটকৃত দেশটির সংস্কৃতি পাল্টানোর এক বড় এজেন্ডা থাকে এসব বহুজাতিক কোম্পানির। কন্যা শিশুকে ছেলেসুলভ সম্বোধন তথা ‘বাবা’ কিংবা ‘আব্বু’ বলে ডাকার সংস্কৃতির পেছনেও তাদের কোনো দুরভিসন্ধী থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
এবার বিশ্লেষণ করা যাক যে, কন্যা সন্তানকে এভাবে ডাকায় কী ক্ষতি। তার আগে জানা প্রয়োজন এভাবে ডাকার উদ্দেশ্য কী? কন্যাশিশুকে ছেলেসুলভ সম্বোধনে ডাকার তত্ত্ব উদঘাটিত হয়েছে বহুজাতিক প্রসাধনী কোম্পানিটির সেই বিজ্ঞাপনেই। সেখানে কালো রঙের এক মেয়ে বিজ্ঞাপনের প্রসাধনী সামগ্রীটি ব্যবহারের বদৌলতে রাতারাতি ফর্সা হয়ে যায়। ফলে এয়ার হোস্টেসের চাকুরি পেয়ে দিনকয়েকের মধ্যেই মেয়েটি নিজের সাথে সাথে সংসারের ভাগ্যও বদলে ফেলে। টানাপড়েনের সংসারে মেয়েটির যে পিতাকে আগে এককাপ চা পেতেও বেগ পেতে হতো, প্রসাধনী সামগ্রীর কল্যাণে ফর্সা হয়ে যাওয়া সেই মেয়েটি চাকুরির প্রথম বেতন পেয়ে তার পিতাকে উন্নত মানের রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় ভোজনের উদ্দেশ্যে। খুশি হয়ে তখন বৃদ্ধ সেই পিতা তার মেয়েকে ‘বাবা’ বলে ডাক দেয়।
এই কাহিনীর মধ্য দিয়ে বোঝা গেল, মেয়েটি যখন উপার্জনক্ষম হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াল তখন সে আর বাস্তবিকই মেয়ে থাকল না, ছেলে হয়ে গেল। বর্তমানে এই তত্ত্বের ভিত্তিতেই যেসব দম্পতির ছেলে সন্তান নেই, কেবল মেয়ে সন্তান রয়েছে, তারা তাদের মেয়ে সন্তানটিকে ‘বাবা’ বলে ডেকে ছেলের অভাব পূরণে সান্ত্বনা খুঁজে থাকেন।
গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, এই সংস্কৃতির পেছনে আধুনিকতার মোড়কে নারীবাচক শব্দের প্রতি চরম অবহেলা এবং তাদেরকে ‘অপয়া’ মনে করবার সনাতন ধারণা লুকায়িত রয়েছে। কন্যা শিশুকে ছেলে সম্বোধনে ডাকবার মধ্য দিয়ে ‘মেয়ে’ শব্দটির প্রতি আমরা আমাদের আস্থাহীনতার জানান দিচ্ছি। বলতে চাচ্ছি, কন্যা শিশু নয়, বরং পুরুষ শিশুই আমাদের পরম কাক্সিক্ষত। তবে মেয়ে শিশু হয়ে গেলে আর কী করা, তাকে যতদূর সম্ভব পুরুষ বানানোর চেষ্টা করতে হবে। তার প্রতিভাকে বিকশিত করে স্বাবলম্বী করতে পারলেই সে আর মেয়ে রইবে না।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি ‘মেয়ে’ কিংবা ‘নারী’ এই শব্দগুলোর প্রতি নেতিবাচক ধারণা আরোপ করতে চাচ্ছি? একজন প্রতিষ্ঠিত নারী কি সমাজে তার নিজস্ব লিঙ্গ পরিচয়েই পরিচিত হতে পারেন না? কিংবা কোনো নারী যদি প্রতিষ্ঠিত নাও হতে পারেন, তার মানে কি এই যে, তার নারী পরিচয়টি অত্যন্ত অপমানকর?
নারীবাচক সম্বোধনের পরিবর্তে পুরুষবাচক সম্বোধনে ডাকবার মাধ্যমে মূলত নারী হয়ে জন্মগ্রহণকে তার বিড়ম্বিত ভাগ্য বলেই কৌশলে বোঝানো হয়। যারা কন্যা সন্তানকে পুরুষবাচক সম্বোধনে ডাকছেন তারাও মূলত পুরুষ সন্তান না পাবার বেদনায় কন্যা শিশুটিকেই ছেলে ভেবে ভেবে মনকে প্রবোধ দিচ্ছেন। এভাবে আমরা ক্রমশই কন্যা সন্তান এবং নারীবাচক শব্দগুলোকে মর্যাদাহীন করে দিচ্ছি। ফলে পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারী পরিচয় হয়ে উঠছে অমর্যাদাপূর্ণ।
একজন পুরুষ যেমন চায় না নিজেকে নারীবাচক সম্বোধনে সম্বোধিত করতে, ঠিক একজন নারীও নিশ্চয়ই চাইবে না পুরুষবাচক কোনো শব্দে পরিচিত হতে। নারী-পুরুষের লিঙ্গগত পার্থক্য চিরন্তন। নারী মাত্রই চায় নিজস্ব লিঙ্গ পরিচয়ে মর্যাদার সাথে পরিচিত হতে। সুতরাং, নারীবাচক শব্দের প্রতি আমাদের আস্থা বাড়াতে হবে। এটি না করে কন্যাসন্তানকে পুরুষবাচক সম্বোধনে ডাকবার সংস্কৃতি প্রচলন করলে আমরা নারীসমাজকে হীনমন্য করে ফেলব।
নারী কিংবা কন্যাশিশুর প্রতি সকলপ্রকার বৈষম্য দূরীকরণে আমাদের দেশসহ বিশ্বের সভ্য বলে দাবিদার দেশগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। নারীর নিজস্ব পরিচয়কে উন্নত করার পরিবর্তে পুরুষের পরিচয়ে তাকে পরিচিত করবার রেওয়াজ চালু হলে তাতে পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজব্যবস্থায় আস্থার জায়গায় নারীকে নিয়ে আসাটা হুমকির মুখে পড়বে। বাড়বে নারীর প্রতি বৈষম্য। আশা করি নারীবাদীরা ব্যাপারটি গভীরভাবে ভেবে দেখবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




