“তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে যে বেতন দেয়া হয়, তাতে আমার পকেট খরচও হয় না.....”- এই উক্তিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের, যিনি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের চাপে ঢাবিতে নিজের ক্লাস নেবার সুযোগ খুব কমই পেয়ে থাকেন। কেবল ইনিই নন, ঢাবির প্রখ্যাত বিভাগগুলোর শিক্ষকমণ্ডলীর একটি বড় অংশ ঢাবির কর্মক্ষেত্রের চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনকেই বেশি পছন্দ করেন।
‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে বিশ্বের দরবারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের সেই খ্যাতি খোয়া গেছে অনেক দিন আগেই। এখন দেশের ভেতরে অবস্থিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথেও মানে কুলিয়ে উঠতে পারছে না আমাদের আশা-আকাক্সক্ষার এই প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। দুর্ভাগ্যজনক এই পরিণতির জন্যে শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাবকেই বড় করে দেখা যেতে পারে।
ঢাবির শিক্ষকরা নিজেদের ক্যাম্পাসের চেয়ে অনেক বেশি সময় দিচ্ছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। তুলনামূলক বেশি টাকা উপার্জন করা যায় বলে ঢাবির ক্লাস মিস করে হলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়াটা ঢাবির গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এখন একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের তুলনায় তাদের কাছে ঢাবির ক্লাসের গুরুত্ব একেবারেই গৌণ। সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যান কর্তৃক যে ক্লাস রুটিন প্রদান করা হয়, অনেক শিক্ষকই তা অনুসরণ করেন না। স¤প্রতি ঢাবির একটি বিভাগে চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত রুটিন অনুসারে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে বলে, শিক্ষকদের একটি অংশ সেই রুটিনের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ক্লাসগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। অবশেষে সেসব শিক্ষকদের অনুকূল রুটিন প্রবর্তন করা হলে তারা ক্লাস করতে সম্মতি জানান। সারা বছর ঠিকমতো ক্লাস না নেয়ার ফলে সিলেবাস বাকি থেকে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে শিক্ষকবৃন্দ অনেক সময় বিশেষ সাজেশন্স দিয়ে দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে চান। আবার অনেকে পরীক্ষার আগে আগে সিলেবাস শেষ করার তাগিদে এত বেশি অতিরিক্ত ক্লাস নেন যে, ছাত্রদের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে যায় এতে।
ব মার্কেটে যেসব ডিগ্রির চাহিদা বেশি (যেমন, বিবিএ, এলএলবি), প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত সেসব ডিগ্রিই প্রদান করা হয়। আর এসব ডিগ্রির সাথে সংশ্লিষ্ট ঢাবির শিক্ষকবৃন্দই মূলত সেসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দিয়ে থাকেন। দেখা যায় যে, ছাত্রদের ক্লাস করবার মোক্ষম সময়- সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। দুপুরের পর ক্লান্ত শরীরে যখন তারা ঢাবির ক্লাসে প্রবেশ করেন, তখন তাদের ক্লাস করবার তেমন একটা এনার্জি থাকে না। ফলে, ক্লাসের মানও ভালো হয় না।
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে শুধু ক্লাস নেওয়াতেই সীমাবদ্ধ নন এসব শিক্ষকবৃন্দ। খাতা কিংবা এসাইনমেন্টও মূল্যায়নেও তারা ঢাবির চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করে থাকেন। উদাসীনতার সাথেই তারা সাধারণত ঢাবির এসব পেপার মূল্যায়ন করেন বলে পরীক্ষার ফলাফল দিতে দীর্ঘসূত্রিতার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। পক্ষান্তরে, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির খাতা মূল্যায়নে তারা বেশ তৎপর থাকেন। ফলে ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা শেষ হবার খুব কম সময়ের মধ্যেই ফলাফল দেয়া সম্ভবপর হয়। সিনিয়র ছাত্রদের দিয়ে ঢাবির খাতা মূল্যায়নের অভিযোগও রয়েছে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এসব কারণেই ঢাবির শিক্ষার মান দিন দিন কমছে আর বেড়ে যাচ্ছে অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মান। কঠিন ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে দেশের সেরা মেধাবীরা ভর্তি হচ্ছে ঢাবিতে। কিন্তু, এসব মেধাবীরা পাচ্ছে না মানসম্মত শিক্ষা। আর টাকার জোরে ধনীর দুলালরা সমীহ পাচ্ছেন ঢাবির শিক্ষকদের। অর্থের শক্তির কাছে আমরা আমাদের শিক্ষকদের নৈতিকতার পরাজয় প্রত্যক্ষ করছি। নিজেদের শিক্ষক কিভাবে টাকার কারণে পর হয়ে যাচ্ছেন, সে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হচ্ছে আমাদের।
যেসব শিক্ষক ঢাবির ক্লাসের চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তাদের প্রতি নিবেদন, আমরা, আমাদের অভিভাবকবৃন্দ এবং দেশের জনগণ আপনাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দেখে থাকেন। দেশের জনগণের অর্থে পরিচালিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার সুবাদেই আপনাদের কদর বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত বেশি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরই যদি আপনারা যৌক্তিক প্রাপ্যটুকু থেকে বঞ্চিত করেন এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে বেশি সময় ব্যয় করেন, তাহলে শিক্ষক হিসেবে দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে আপনাদের শ্রদ্ধার জায়গাটুকু খুব বেশি নড়বড়ে হয়ে পড়বে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




