somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : টুশি একটি নক্ষত্রের নাম

১০ ই জুন, ২০১৩ সকাল ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দক্ষিণ কোনার নারিকেল গাছের পাতায় শেষ দুপুরের রোদের টুকরো গুলো ঝলমল করে আছড়ে পড়ছে। একটু পরপর প্রচন্ড বাতাসে লম্বা নারিকেল গাছের মাথাটা তিন-চার হাত এদিক-সেদিক সরে যাচ্ছে। আমার পেছনের বুড়ো আমগাছের শুকনো পাতা গুলো ঝরে ঝরে পড়ছে। পাতা গুলো উড়তে উড়তে আমার পায়ের কাছ দিয়ে ঘুরে ফিরে কয়েক হাত দূরে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে থমকে যাচ্ছে। তারপর আরেকটু বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে আরেক জায়গায় গিয়ে থমকে যাচ্ছে। মা মুখে আঁচল দিয়ে শব্দ করে কাঁদছে। মার কান্নার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিনা। হয়তোবা আমি শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু আমার অজান্তেই আমার মন সেই কান্নার শব্দ গুলো আমার কানে প্রবেশ করতে দিচ্ছেনা। মার চোখ দিয়ে জলের ফোটা গুলো টুপটুপ করে গালের ওপর আছড়ে পরছে। তারপর নদীর স্রোতের মতো করে গাল বেয়ে নিচের দিকে নামছে। মা চরম মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে মার থেকে তিন-চার হাত সামনে রাখা একটি নিচু খাটের দিকে। সেই খাটে ছোট্ট একটা মানুষ প্রচন্ড শান্ত ভাবে শুয়ে আছে, সারা শরীর ধবধবে সাদা কাপরে মুড়িয়ে। শুয়ে থাকা সেই ছোট্ট মানুষটা আমার বোন। আমি ডাকি টুশি।

***

তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। সবে মাত্র নাইন পেড়িয়ে টেনে উঠেছি। মোটামুটি খেলাধুলা আর আড্ডাবাজিতে স্কুলের সেরা ছিলাম আমি। সেই সুবাদে স্কুলে আমার বন্ধু-বান্ধবের অভাব ছিলনা। সব বন্ধুরই আমার প্রতি ছিল প্রচন্ড আগ্রহ। স্কুলের এমন কোন বন্ধু বাকী ছিলোনা, যার বাসায় আমি যাইনি। বন্ধুদের বাবা-মা ও আমাকে তাদের ছেলের মতই দেখতো। কিন্তু আমি সেইসব বন্ধুদের বাসায় যেতে চাইতাম না বেশি একটা, যাদের পিচ্চি পিচ্চি বোন আছে। কেমন যেন হিংসে হতো। ওরা আমার কাছে এসে ওদের পিচ্চি পিচ্চি বোনদের গল্প করতো। একজন বলতো ওর বোন নাকি বড় হলে দেখতে পুরোপুরি পরীর মতো হবে। আরেকজন গালে খামচির দাগ দেখিয়ে বলতো, আমার বোনকে কোলে নিতে গিয়ে খামচি খেয়েছি। আমরা একসাথে একবার এক মেলায় গেলাম। সারা বিকেল ঘুরাঘুরি করলাম। এটা-ওটা খেলাম। খুব মজা করলাম। সন্ধ্যার আগে আগে যখন চলে আসবো, তখন বিশু আর রাজু বললো ওদের নাকি আরেকটু কাজ বাকী আছে। ওরা খেলনার দোকানে গিয়ে এইটা-সেইটা দেখতে লাগলো। ওরা সাদা দুইটা পুতুল কিনলো। ওদের ছোট বোনের জন্য। ওদের পুতুল কেনা দেখে আমার খুব ইচ্ছে করলো আমারও একটা পুতুল কিনতে। কিন্তু আমি কার জন্য কিনবো? আমার তো ছোট ভাই-বোন কেও নেই। মনমরা হয়েই মেলা থেকে বের হয়ে এলাম। কিন্তু আমার পুতুল কেনার ইচ্ছেটা মন থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। মাঝপথে এসে হঠাৎ করে আবার মেলায় গিয়ে আরেকটা পুতুল কিনে আনলাম। পুতুল হাতে বাসায় ঢোকার পর মা বললো,

“কিরে এইটা দিয়ে তুই কী করবি!”

আমি কোন কথা না বলে সোজা আমার রুমে গিয়ে পুতুলটা আমার ওয়্যারড্রবের ওপর সুন্দর করে রেখে দিলাম। তারপর থেকে পুতুলটার দিকে তাকালেই একটা স্বপ্ন এসে চোখের সামনে ঘুরাঘুরি করতো। একটা ছোট্ট বোনের স্বপ্ন। তাঁর ঠিক একবছর পর আমার স্বপ্নটা পূরণ হতে চললো। আমার মা ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান জন্ম দিলেন। যেদিন আমার বোনের জন্ম হলো, সেদিন আমি আমার প্রতিটা বন্ধুর বাসায় গিয়ে খবর দিয়েছিলাম- আমার একটা ফুটফুটে ছোট্ট বোন হয়েছে। তোদের বোনদের চাইতে হাজার গুন সুন্দর। এই কথা শুনে রাজু খুব হাসছিলো। বলেছিলো, সবার বোনকেই সবাই পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর বোন মনে করে। আর বিশু এই কথা শুনে আমার সাথে কথাই বন্ধ করে দিল। বোনের নাম আমি কাওকে রাখতে দিলাম না। কাওকেই না। শুধু একমাত্র আমি নাম রাখলাম- টুশি।

***

আকাশের কোনায় সাদা সাদা মেঘ ঘুলো একটু একটু করে নড়াচড়া করছে। মাথার ওপর আম গাছটার ডালে বসে একটা শালিক ডাকছে। দূরে নাম না জানা একঝাক পাখি উড়ে যাচ্ছে। আকাশের নীলে পাখি গুলোকে কেমন কালো দেখাচ্ছে। বাবা খাটটার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। কান্না লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরপর মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দু’হাত দিয়ে চোখ জোড়া মুছে নিচ্ছেন। তারপর আবার নিজেকে একজন ব্যস্ত মানুষ হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। বাবা কিছুতেই চাচ্ছেন না, তাঁর দৃষ্টি তাঁর থেকে সাত-আট হাত সামনের খাটের দিকে নিতে। কিন্তু তারপরেও বারবার তাঁর দৃষ্টি সেই খাটের দিকে চলে যাচ্ছে, যেখানে ছোট্ট একটা মানুষ প্রচন্ড শান্ত ভাবে শুয়ে আছে। সারা শরীর ধবধবে সাদা কাপরে মুড়িয়ে। শুয়ে থাকা সেই ছোট্ট মানুষটা আমার বোন। আমি ডাকি টুশি।

***

টুশির বয়স যখন তিন, তখন থেকেই ও আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি, ততক্ষণ ও আমার পিছু লেগেই থাকতো। একটু পরপরই এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলতো,

“ভাইয়া চক্কেত দাও! ভাইয়া চক্কেত দাও!”

বাইরে থেকে আসলেই গায়ে ঝাপ দিয়ে পরবে। টুশি মনির মেজাজ কোন কারনে একটু খারাপ থাকলেই আমার ওপর দিয়ে ধকল যাবে। তখন আমার মুখে খামচি দেবে, কান ধরে টানবে অথবা মাথার চুল ধরে ঝুলে পরবে। বাবাকে বিচিত্র কোন কারনে ভয় পেত। তাই বাবার সামনে তেমন একটা যেত না। মা চোখ রাঙিয়ে বকা দিত। তাই মাকেও মারতে পারতো না। আর আমাকে মারলে তো উল্টো আমি হেসে হেসে চুমু খাই, চকলেট দেই। তাই আমার ওপরই কারনে অকারনে ঝাপিয়ে পড়তো। আমিও মহানন্দে দুষ্টু টুশি মনির কোমল হাতের অত্যাচার পেতে ইচ্ছে করেই রাগিয়ে দিতাম। আর মা বলতো,

“দুইটাই বদের হাড্ডি হয়েছে।”

বাবা শুধু মুখ টিপে হাসতেন।

***

চারজন মানুষ খাটটা কাঁধে তুলে নিলেন। সেই চারজনের মধ্যে আমিও একজন। রাস্তার ধুলোবালি হালকা বাতাসে উড়ে এসে চোখে-মুখে লাগছে। রাস্তার দু’ধারের গাছ গুলোর ডাল-পালায় এসে পাখিরা ভীড় করছে। মাঝেমাঝে কিছু পাখিরা ডানা ঝাপটিয়ে আওয়াজ করছে। সামনের দিকে যে দু’জন খাটটা কাঁধে করে রেখেছে, তাদের মধ্যে একজন বিশু। আমার কিশোর জীবনের বন্ধু। যেদিন টুশির জন্ম হলো সেদিন ওকে বলেছিলাম, ওদের সবার বোনের চাইতে আমার বোন সুন্দর। এই নিয়ে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। অনেকদিন কথা বলেনি। অনেকদিন পর যখন বুঝতে পেরেছিলাম, সবার বোনকেই সবাই কতটা আদর করে, ভালোবাসে, সেদিন বিশুর কাছে গিয়ে স্যরি বলে ওর রাগ ভাঙ্গিয়েছিলাম। ওর বোনটার বয়স এখন প্রায় ছয় হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই বিশুকে দেখলে দৌড়ে গিয়ে ওর কোলে আছড়ে পরে। আমাদের সাথে বিশুও খাটটা কাঁধে করে আছে। খাটের মধ্যে চুপটি করে নিঃশব্দে শুয়ে আছে ছোট্ট একটা মানুষ। সারা শরীর ধবধবে সাদা কাপরে মুড়িয়ে। শুয়ে থাকা সেই ছোট্ট মানুষটা আমার বোন। আমি ডাকি টুশি।

***

আমি যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম, তখন টুশির বয়স তিন। ছোট-ছোট পায়ে সারাদিন এঘর থেকে ওঘরে দৌরে বেড়ায়। আমি বাসায় আসলে আমাকে দেখে মাঝে মাঝে দরজার আড়ালে লুকায়। তারপর যখন টুশিকে শুনিয়ে মা-কে টেনে টেনে বলি,

“মা এই চকলেট গুলো কে খাবে? বিশুর বোনকে দিয়ে দিলে কেমন হয়?”

তখন টুশি প্রচন্ড বেগে ছুটে এসে আমার শার্ট ধরে ঝুলে পরে। তারপর হাত-পা ছুড়ে শব্দ করে কাঁদতে থাকে। আমি কোলে নিয়ে এত্ত এত্ত মজার চকলেট বের করে শান্ত করি। দুইটা চকলেট ও মুখে দিলে একটা আমার মুখে ঢুকিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে এমন হতো, একটা চকলেট মুখে ঢুকিয়ে বলতো, খাবোনা। আমি বলতাম, তাহলে আসো চকলেটটা জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে আসি। টুশি বলতো, না ফেলবো না। আমি বলতাম, তাহলে চকলেটটা কী করবে দুষ্টু টুশি মনি? টুশি মাথা নেড়ে বলতো, তুমি খাবে। আর না খেলে তো চিরচেনা সেই কান্না আছেই। বাধ্য ছেলের মতো দুষ্টু টুশি মনির আধখাওয়া কত চকলেট যে আমার পেটে ঢুকেছে, তাঁর ইয়ত্তা নেই। একদিন ভার্সিটি থেকে আসার সময় চকলেট আনতে ভুলে গেলাম। তখন ওর বয়স চার। যতই বয়স হচ্ছে, টুশি মনির দূরন্তপনা ততই বাড়ছে। বাসায় আসার পর দেখলাম টুশি দরজার আড়ালে লুকিয়েছে। তারপর মনে পড়লো চকলেট না আনার মতো বিরাট একটা অপরাধ করে ফেলেছি আমি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম,

“আমার জানু পাখিটা কই রেএএএ...!!”

টুশি ধড়মড় করে ছুটে আসার সময় দরজার সাথে ধাক্কা খেল একটা। আমি টান মেরে ওকে কোলে তুলে নিলাম। টুশির কান্না দেখে আমিও কেঁদে ফেলেছিলাম। আধঘন্টা পর যখন কান্না থামালো, তখন দেখি ওর মাথার সামনের দিকে একটা জায়গা ফুলে গেছে। টুশিকে কোলে করে বাসা থেকে বের হয়ে সোজা চকলেটের দোকানে গেলাম। পরিচিত দোকান। দোকানদারকে টুশি ডাকে ম্যাও মামা। ঠিক কী কারনে ম্যাও মামা ডাকে, সেইটা আমি কোনদিনই জানতে পারিনি। দোকানদার টুশিকে দেখে বত্রিশটা দাত বের করে বললো,

“টুশি মনির মাথায় কী হয়েছে গো?”

টুশি বললো,

“ছিং হইছে।”

ম্যাও মামা বললো,

“তোমার শিংটা তো অনেক সুন্দর।”

আমি দোকানদারকে ধমক দিয়ে বললাম,

“ধুর মিয়া! পরে আবার শিং বানানোর নেশায় পরে যাক। আলতু-ফালতু কথা বাদ দিয়ে চকলেট দ্যান।”

দোকানদারের হাত থেকে চকলেট গুলো নিয়ে সোজা বাসার দিকে হাটা দিলাম।

***

কবরস্থানের পাশেই মসজিদ। আছর নামাজ পরে মুসল্লীরা মসজিদ থেকে বের হচ্ছে। মসজিদের পাশেও আমাদের বাসার সামনের নারিকেল গাছটার মতো একটা নারিকেল গাছ আছে। বিকেলের ঝিকঝিকে সোনালী রোদে পাতা গুলো নিজেদেরকে মাখিয়ে নিচ্ছে। বাতাস আর রোদের সাথে পাতাগুলো খেলা করে চলেছে। জানাযাহ এর জন্য সবাই সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়েছে। আমি সামনের কাতারের মাঝামাঝি স্থানে দাঁড়িয়ে আছি। হুজুর এসে কিছুক্ষণ কথা বলে আল্লাহু আকবার বলে নামাজ শুরু করলেন। হুজুর যেখানে দাড়িয়েছেন, তাঁর থেকে কয়েক হাত সামনে একটা খাট রাখা। খাটের মধ্যে চুপটি করে নিঃশব্দে শুয়ে আছে ছোট্ট একটা মানুষ। সারা শরীর ধবধবে সাদা কাপরে মুড়িয়ে। শুয়ে থাকা সেই ছোট্ট মানুষটা আমার বোন। আমি ডাকি টুশি।

***

টুশির বয়স যখন দুই পেড়িয়েছে, তখন থেকেই টুশি রাতে আমার সাথে ঘুমায়। তিন বছরে একদিনও আমি টুশিকে ছাড়া ঘুমায়নি। প্রথম প্রথম ইচ্ছে করে গল্প শুনাতাম টুশিকে। একবছর পর হঠাৎ খেয়াল করলাম, টুশি প্রত্যেকদিন ঘুমানোর আগে আমার মুখের গল্প শোনার নেশায় পরে গেছে। টুশি আমার বুকের ওপর শুয়ে চুপ করে ভুতের গল্প শুনতো। তারপর কিছুক্ষণ গল্প বলার পরেই ওর ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ পেতাম। একদিন পূর্নিমা রাতে টুশি ঘুমানোর আগে জানালার দিকে তাকিয়ে বললো,

“ভাইয়া দ্যাখো দ্যাখো আজকে রাত হায়নাই।”

আমি বললাম,
“রাত তো হয়েছে। কিন্তু পূর্ণিমার আলোতে দিনের মতো দেখাচ্ছে।”

টুশি বললো,

“ভাইয়া পূর্ণিমা কী?”

আমি ওকে পূর্ণিমা দেখাতে আমাদের ছয় তলা বাসার ছাদে নিয়ে গেলাম। তারপর দূরের ছোট ছোট জোনাকী দেখালাম, বড় একটা চাঁদ দেখালাম। কয়েকটা তারার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। টুশি কোলে বসে, গলা পেঁচিয়ে ধরতে ধরতে বললো,

“ভাইয়া ঐ বড় তারাটার নাম কী?”

আমি বললাম,

“আমি তো ঐটার নাম জানিনা। তোমাকে পরে একদিন বলবো, ক্যামন?”

“আচ্ছা।”

এর কয়েকদিন পর থেকেই ও ঘুরেফিরে আমার কাছে এসে বলতো, ভাইয়া ভাল্লাগেনা। আমার ভাল্লাগেনা। কয়েকজন ডাক্তার দেখানোর পরেও যখন কোন কাজ হচ্ছিল না, তখন শহরের নামী একটা বেসরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় টুশিকে। ধরা পরে ব্লাড ক্যান্সার। আমার টুশির দিকে আমি তাকাতেই পারছিলাম না। নিজেকে কেমন যেন পৃথিবীর সবচাইতে পাপী, ব্যর্থ, নিকৃষ্টতম একজন মনে হচ্ছিলো। আমরা জীবন দিয়ে চেষ্টা করছিলাম ওকে ভালো করার।

***

ছোট্ট একটা কবর খোঁড়া হয়েছে। আড়াই হাতের মতো। ফালি ফালি করে কাটা বাশের টুকরো গুলো কবরের একপাশে রাখা হয়েছে। কবরে নারিকেল পাতা দিয়ে তৈরী একটা মাদুর বিছানো হচ্ছে। টুশি খাটের ওপর শুয়ে আছে নিঃশব্দে। আমি আস্তে করে খাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। ছোট্ট মানুষটা কেমন নড়াচড়া ছাড়া একদম চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ আমি থাবা দিয়ে টুশিকে আমার কোলে তুলে নিলাম। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

“এই দুষ্টু টুশি মনি এই! আমার কাছ থেকে চকলেট কেড়ে নিবিনা? আমি আবার তোকে এত্তগুলা চকলেট কিনে দেব। এত্ত এত্ত চকলেট তুই মাথায় নিয়ে হাটতেও পারবি না। এই দুষ্টু টুশি মনি এই! আমার বুকে ঘুমাবি না? আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে তিন মাথা ওয়ালা ভূতের গল্প শুনবি না? তোকে না বলেছিলাম, একটা পাখা ওয়ালা ঘোড়া কিনে দেব? তারপর তুই আমাকে সেই ঘোড়ার পেছনে উঠিয়ে পরীর দেশে ঘুরতে নিয়ে যাবি। এই দুষ্টু টুশি মনি এই! আমি তোকে এখানে একা একা রেখে যাবোনা। তুই একদম ভয় পাবিনা, ক্যামন? এই দেখ আমি। দেখ দেখ। আমার গালটা একবার ছুয়ে দিবিনা তুই? এই দুষ্টু টুশি মনি এই!”

আমার কাছ থেকে জোড় করে টুশিকে সবাই নিয়ে গেল। পেছন থেকে আমার হাত পা শক্ত করে কয়েকজন ধরে রাখলো। আমার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও নিজেকে ছাড়াতে পারছিনা। আমি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলছি,

- আমার বোনকে আমি এখানে রেখে যাবোনা। ও আমাকে ছাড়া একদম ঘুমুতে পারেনা। আমি আমার বোনকে আবার বাসায় নিয়ে যাবো। আবার গল্প শোনাবো। চকলেট কিনে দেব। আমার বোন আমার বুকে ঘুমুবে। আমার বোনকে আমি এখানে রেখে যাবোনা।

ছোট্ট মানুষটাকে আলগোছে কবরে নামানো হলো। ফুটফুটে আমার বোনটাকে কবরে নামানো হলো। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এঘর থেকে ওঘরে ছুটে চলে যেই ছোট্ট মানুষটা, তাকে কবরে নামানো হলো। ধবধবে সাদা কাপরের ওপর মুঠি মুঠি মাটি পরতে লাগলো। আস্তে আস্তে সাদা কাপরে পেঁচানো আমার ছোট্ট বোনটা মাটির আড়ালে চলে গেল। আমি নিস্পলক চেয়ে থেকে অবশেষে চারপাশটা অন্ধকার দেখতে লাগলাম। আমার জ্ঞান ফিরলো রাত প্রায় একটায়। সারা শরীর কেমন ব্যাথায় ছেয়ে গেছে। খাট থেকে নেমে আমার ড্রয়ারটা খুলে সিগারেট বের করলাম। লাইটার খুঁজতে আরেক ড্রয়ারে হাত দিতেই কচকচ আওয়াজ করে ড্রয়ার থেকে বের হয়ে এল কিছু চকলেটের প্যাকেট। চকলেট গুলো পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। সিগারেটটা খুব জোড়ে জোড়ে টানতে লাগলাম। সিগারেটের প্রতিটা টানে কলিজা পুড়ে ছাই করার চেষ্টা করলাম। জানালার কাচ ভেদ করে পূর্ণিমার আলো ঘরের ভেতর আছড়ে পড়ছে। সিগারেটের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পুড়িয়ে আলগোছে বেড়িয়ে এলাম রুম থেকে। তারপর সোজা ছয়তলা বাসার ছাদে চলে গেলাম। বড় একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে চাঁদটা চারিদিক তাঁর আলো দিয়ে মাখিয়ে রেখেছে। দূরে, নিচে জোনাকীরা টিপটিপ করে জ্বলছে। আকাশে বড় একটা তারা দেখা যাচ্ছে। আমি তারাটার একটা নাম দিলাম-টুশি। এই নক্ষত্রের নাম আজ থেকে টুশি। ছয়তলার ওপর থেকে নিচের পিচ ঢালা পথের দিকে একবার তাকালাম। ল্যাম্পপোষ্ট থেকে আলো বের হয়ে রাস্তাটার অনেকটা আলোকিত করে রেখেছে। রাস্তার মাঝখানে একটা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটার ছায়া ডানদিকে দু’হাত লম্বা হয়ে পড়ছে। আমার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। আমি ছাদের রেলিং পেরিয়ে কার্ণিশে এসে দাড়ালাম। আরেকবার টুশি নামের নক্ষত্রের দিকে তাকালাম। আমাকে কেমন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমি দু’হাত দিয়ে আমার প্যান্টের পকেট চাপড়ে বললাম, এই দেখ দুষ্টু টুশি মনি, তোর জন্য কত্তগুলা চকলেট এনেছি। এই দেখ আমার পকেট ভরা চকলেট। তুই একটু অপেক্ষা কর আমি আসছি। আমি আবার রাস্তাটার দিকে তাকালাম। কুকুরটা চলে গেছে। রাস্তাটাকে এখন বড় খালি খালি লাগছে।

(নিঃসঙ্গ কল্পচারী ভাইকে দেখে ভেবেছিলাম, দেখি, আমিও কিছু একটা লিখতে পারি কিনা। গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশ করার পর অনেকেই ভালোলাগা জানিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন, অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। বানান ভুল নিয়ে কিছুটা সমস্যায় ছিলাম। যথাসম্ভব ঠিকঠাক করার চেষ্টা করেছি।)


সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৩ রাত ৮:৩০
৪৫টি মন্তব্য ৪৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×