somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিঠি

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ৮:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৭ বছরের স্বপ্ন সত্যি হওয়াটা আনন্দের। চোখে পানি চলে আসাটাও খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। আমারও তাই হয়েছিলো। এতোদিনের এতো কষ্ট, এতো দীর্ঘ সব পথ পাড়ি দিতে হয়েছে মোটামুটি একা একাই। আর তাই এই আনন্দটাও পেয়েছি একা একাই। হ্যাঁ, পাশে হয়তো একজন ছিলো, এবং হয়তো তার সাথে আমার বন্ধনটা একটু অন্যরকম, না, বরং দুনিয়ার আর সবার থেকে আলাদা একটা বন্ধন, তবুও তার অতীত আর আমার অতীত এক নয়।সে ছোট বেলা থেকে এই স্বপ্ন নিয়েই বড় হয়েছে, যে জানতো, সে পারবে যদি সে তার সবটা দেয়।কিন্তু আমার জন্য ব্যপারটা ছিলো অনেক ভিন্ন। আমি জানতাম না আমি পারবো কিনা। কেননা অনেক অনেক বাধা ছিলো পথে। এক পুরনো বন্ধু বলেছিল, “তোমার চান্স ১% এরও কম।“ আমি কিছুই বলিনি। হেসেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, কেন সবচেয়ে কম সুযোগ বোঝাতে কেন মানুষ ১% দিয়ে শুরু করে? আমি করলে হয়তো দশমিকের পর দুই তিনটা শূণ্য বসিয়ে এরপর ১ বসাতাম। হ্যাঁ। সুযোগ এতটাই কম ছিলো। কিন্তু তবুও আমি পেরেছি।

আমি জানতাম, আর কিছুক্ষণ পর ব্যথায় আমার শরীর কাতরাবে। মস্তিষ্কটা ডিফেন্স মেকানিজম হিসেবে অজ্ঞান হয়ে যেতে চাইবে, পেটের ভেতরের সব কিছু বের হয়ে আসতে চাইবে। শরীরের ওজন বেড়ে কয়েকশ কেজি হয়ে যাবে। হাড়গুলো মড়মড় করবে। কিন্তু এও জানতাম , কিছুই হবে না। কেননা মাসের পর মাস শরীরটার উপর দিয়ে এতো অত্যাচার হয়েছে তো এজন্যই। আমার মস্তিষ্ক অজ্ঞান হবে না। সম্পূর্ণ ব্যথাটুকু আমি উপভোগ করবো। আর দশটা মানুষ হয়তো কেঁদে একাকার হয়ে যেতো। কিন্তু আমি কাঁদবো না। এই ব্যথাটুকুর জন্যই আমি অপেক্ষা করেছি, নিজের রাতগুলো আর দিনগুলোকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করেছি। শুধুমাত্র ওইদিনের ঐ সময়টার জন্যই।

কিন্তু কি পেলাম? আসলে মানুষ কি পায়? কটা মানুষ নামধাম জানবে, একটা মেডেল হয়তো? অভিজ্ঞতা সনদ? দামী চাকুরী? কিন্তু এসব কি আর কেউ পাচ্ছে না? আমার মতন এই কষ্টো এই পরিমান ব্যথা ওরা সহ্য করেনি। বরং ওদের অনেকে পৃথিবীতে এমন অবস্থানে আছে, যেখানে আমি কখনোই যেতে পারবো না। কিন্তু আমি এও জানি, এই কষ্ট থেকে আমি যা পেয়েছি, তা ওরা কেউ পায়নি। ওরা স্বপ্নও দেখেনি তার। আমি পেয়েছি একটা অনুভূতি।

আমি দেখেছি আমরা কতটা ভঙ্গুর। আমি দেখেছি, এই পৃথিবীটা কতটা ভঙ্গুর। একটা ছোট কাচের জারের মধ্যে যেন কটা পিঁপড়ের বসবাস। আর এই জারটা ভাসছে ড্রেক প্যাসেজে। হ্যাঁ, ড্রেক প্যাসেজ। কেননা এর থেকে ভয়ানক সাগর আমি আর দেখিনি। গিয়েছিলাম একবার ওখানেও।তা বছর চারেক আগের কথা। পর্বতপ্রমাণ ঢেউ আর তার মধ্যে যেন বাদামের খোসার মতন আমার জাহাজ। অন্ধকার রাতে একা পাথুরে দ্বীপের লাইটহাউজে আটকে আছে যে লোকটা, সে কল্পনাতে যে ঝড়কে যেমন মনে করে, ঠিক তেমন ঝড় ছিলো আমাদের চোখের সামনে। তারমধ্যে ভেসেছে আমার জাহাজ। আমাদের এই কাচের জারটা যদি ভেঙ্গে যায়, আমাদের আর ঠাই কই? সেই যে সুন্দর মায়াবী চোখের চিত্রল হরিণ, শক্তির প্রতীক হাতি, কিংবা চোখের সামনে রঙধনুর খেল দেখানো আমাজনের সেই হামিংবার্ড? কিংবা ৫২ হার্জে গান বাজানো ঐ নিঃসঙ্গ তিমিটা? ওদের কোথায় ঠাঁই হবে? আর আমরাই বা কোথায় যাবো?
৪০০ কিলোমিটার উপর থেকে দিনে ১৬টা সূর্যোদয়ের প্রত্যেকটায় পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখেছি আমি। আরবের মরুভূমি, আফ্রিকার সাভানাহ, সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ তুষার, হিমালয়ের পর্বতগুলোর মাথায় বরফের টুপি, আর দেখেছি উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে প্ল্যাঙ্কটনদের মায়াবী রঙের খেলা। রাতের অন্ধকারে যখন সাগরের বুকে ওদের নীলচে আলো ধিকিধিকি করে শত শত বর্গমাইল জুড়ে আলোর নৃত্য করে, তখন ওদেরকে কতটা আপন মনে হয়েছে তা আমি জানি। হয়তো জানে আমার পাশে বসে থাকা সেই মানুষটাও। মনে হয়েছে, আমাদের জন্মতো একই পৃথিবীর বুকে, কিসের এতো গর্ব? কিসের এতো হানাহানি? একি বাতাসে শ্বাস নিয়ে বড় হয়েছি, একই মাটিতে পা রেখে ঘুরে বেড়িয়েছি, তাহলে কিসের এতো দ্বন্দ? আমি অনুভব করেছি সবাই কতটা আপন, ওরা অনুভব করেনি।ওরা আমার মতন ৪০০ কিলোমিটার উপর থেকে পুরো পৃথিবীর জাতিগুলোকে একসাথে দেখেনি। একসাথে সূর্যোদয় হতে দেখেনি, মহাসাগরের বুকে আলোর খেলা দেখেনি। আমি দেখেছি।আমি বুঝেছি যে, আমরা এক।

সৌর কলঙ্কে পর্যবসিত
প্রাক্তন নভোচারী
সহপরিচালক, SPACE LINKERS BANGLADESH
১১ নভেম্বর, ২০৩৩
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ৮:০৫
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×