২৭ বছরের স্বপ্ন সত্যি হওয়াটা আনন্দের। চোখে পানি চলে আসাটাও খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। আমারও তাই হয়েছিলো। এতোদিনের এতো কষ্ট, এতো দীর্ঘ সব পথ পাড়ি দিতে হয়েছে মোটামুটি একা একাই। আর তাই এই আনন্দটাও পেয়েছি একা একাই। হ্যাঁ, পাশে হয়তো একজন ছিলো, এবং হয়তো তার সাথে আমার বন্ধনটা একটু অন্যরকম, না, বরং দুনিয়ার আর সবার থেকে আলাদা একটা বন্ধন, তবুও তার অতীত আর আমার অতীত এক নয়।সে ছোট বেলা থেকে এই স্বপ্ন নিয়েই বড় হয়েছে, যে জানতো, সে পারবে যদি সে তার সবটা দেয়।কিন্তু আমার জন্য ব্যপারটা ছিলো অনেক ভিন্ন। আমি জানতাম না আমি পারবো কিনা। কেননা অনেক অনেক বাধা ছিলো পথে। এক পুরনো বন্ধু বলেছিল, “তোমার চান্স ১% এরও কম।“ আমি কিছুই বলিনি। হেসেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, কেন সবচেয়ে কম সুযোগ বোঝাতে কেন মানুষ ১% দিয়ে শুরু করে? আমি করলে হয়তো দশমিকের পর দুই তিনটা শূণ্য বসিয়ে এরপর ১ বসাতাম। হ্যাঁ। সুযোগ এতটাই কম ছিলো। কিন্তু তবুও আমি পেরেছি।
আমি জানতাম, আর কিছুক্ষণ পর ব্যথায় আমার শরীর কাতরাবে। মস্তিষ্কটা ডিফেন্স মেকানিজম হিসেবে অজ্ঞান হয়ে যেতে চাইবে, পেটের ভেতরের সব কিছু বের হয়ে আসতে চাইবে। শরীরের ওজন বেড়ে কয়েকশ কেজি হয়ে যাবে। হাড়গুলো মড়মড় করবে। কিন্তু এও জানতাম , কিছুই হবে না। কেননা মাসের পর মাস শরীরটার উপর দিয়ে এতো অত্যাচার হয়েছে তো এজন্যই। আমার মস্তিষ্ক অজ্ঞান হবে না। সম্পূর্ণ ব্যথাটুকু আমি উপভোগ করবো। আর দশটা মানুষ হয়তো কেঁদে একাকার হয়ে যেতো। কিন্তু আমি কাঁদবো না। এই ব্যথাটুকুর জন্যই আমি অপেক্ষা করেছি, নিজের রাতগুলো আর দিনগুলোকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করেছি। শুধুমাত্র ওইদিনের ঐ সময়টার জন্যই।
কিন্তু কি পেলাম? আসলে মানুষ কি পায়? কটা মানুষ নামধাম জানবে, একটা মেডেল হয়তো? অভিজ্ঞতা সনদ? দামী চাকুরী? কিন্তু এসব কি আর কেউ পাচ্ছে না? আমার মতন এই কষ্টো এই পরিমান ব্যথা ওরা সহ্য করেনি। বরং ওদের অনেকে পৃথিবীতে এমন অবস্থানে আছে, যেখানে আমি কখনোই যেতে পারবো না। কিন্তু আমি এও জানি, এই কষ্ট থেকে আমি যা পেয়েছি, তা ওরা কেউ পায়নি। ওরা স্বপ্নও দেখেনি তার। আমি পেয়েছি একটা অনুভূতি।
আমি দেখেছি আমরা কতটা ভঙ্গুর। আমি দেখেছি, এই পৃথিবীটা কতটা ভঙ্গুর। একটা ছোট কাচের জারের মধ্যে যেন কটা পিঁপড়ের বসবাস। আর এই জারটা ভাসছে ড্রেক প্যাসেজে। হ্যাঁ, ড্রেক প্যাসেজ। কেননা এর থেকে ভয়ানক সাগর আমি আর দেখিনি। গিয়েছিলাম একবার ওখানেও।তা বছর চারেক আগের কথা। পর্বতপ্রমাণ ঢেউ আর তার মধ্যে যেন বাদামের খোসার মতন আমার জাহাজ। অন্ধকার রাতে একা পাথুরে দ্বীপের লাইটহাউজে আটকে আছে যে লোকটা, সে কল্পনাতে যে ঝড়কে যেমন মনে করে, ঠিক তেমন ঝড় ছিলো আমাদের চোখের সামনে। তারমধ্যে ভেসেছে আমার জাহাজ। আমাদের এই কাচের জারটা যদি ভেঙ্গে যায়, আমাদের আর ঠাই কই? সেই যে সুন্দর মায়াবী চোখের চিত্রল হরিণ, শক্তির প্রতীক হাতি, কিংবা চোখের সামনে রঙধনুর খেল দেখানো আমাজনের সেই হামিংবার্ড? কিংবা ৫২ হার্জে গান বাজানো ঐ নিঃসঙ্গ তিমিটা? ওদের কোথায় ঠাঁই হবে? আর আমরাই বা কোথায় যাবো?
৪০০ কিলোমিটার উপর থেকে দিনে ১৬টা সূর্যোদয়ের প্রত্যেকটায় পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখেছি আমি। আরবের মরুভূমি, আফ্রিকার সাভানাহ, সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ তুষার, হিমালয়ের পর্বতগুলোর মাথায় বরফের টুপি, আর দেখেছি উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে প্ল্যাঙ্কটনদের মায়াবী রঙের খেলা। রাতের অন্ধকারে যখন সাগরের বুকে ওদের নীলচে আলো ধিকিধিকি করে শত শত বর্গমাইল জুড়ে আলোর নৃত্য করে, তখন ওদেরকে কতটা আপন মনে হয়েছে তা আমি জানি। হয়তো জানে আমার পাশে বসে থাকা সেই মানুষটাও। মনে হয়েছে, আমাদের জন্মতো একই পৃথিবীর বুকে, কিসের এতো গর্ব? কিসের এতো হানাহানি? একি বাতাসে শ্বাস নিয়ে বড় হয়েছি, একই মাটিতে পা রেখে ঘুরে বেড়িয়েছি, তাহলে কিসের এতো দ্বন্দ? আমি অনুভব করেছি সবাই কতটা আপন, ওরা অনুভব করেনি।ওরা আমার মতন ৪০০ কিলোমিটার উপর থেকে পুরো পৃথিবীর জাতিগুলোকে একসাথে দেখেনি। একসাথে সূর্যোদয় হতে দেখেনি, মহাসাগরের বুকে আলোর খেলা দেখেনি। আমি দেখেছি।আমি বুঝেছি যে, আমরা এক।
সৌর কলঙ্কে পর্যবসিত
প্রাক্তন নভোচারী
সহপরিচালক, SPACE LINKERS BANGLADESH
১১ নভেম্বর, ২০৩৩
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ৮:০৫