somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্ষ্যাত গল্প

১৭ ই আগস্ট, ২০১০ সকাল ৭:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রচণ্ডশীত। চারদিক কুয়াশার চাদরে ঢাকা। যা শীত পড়েছে! কাঁথার ভেতর থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না। ঘুমের মধ্যে অবচেতনভাবে হাত-পা বেরিয়ে গেলে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যায়। শীতে দাঁতে-দাঁতে কাঁপন লাগে।

রাতের শেষ ভাগ। ফজরের আজান ভেসে আসছে।
আসসালাতু খাইরুমমিনান্নাউম...
ফসলের মাঠ পেরিয়ে দূর এবং নিকটের সবদিকের গ্রাম থেকে কুয়াশায় ভর করে আজানের সুর ভেসে আসে। সে এক অবিচ্ছিন্ন সুর।
দয়াল মিয়া ঘুম থেকে উঠে পড়ে। কয়েকবার আড়মোড়া দিয়ে অলসতা দূর করে। হাতে হাত ঘসে শরীরের উত্তাপ বাড়ায়। বিছানা থেকে নেমে ওজু করে নামাজে দাঁড়ায়।নামাজ শেষ করে মোনাজাত ধরে-
দয়াল আল্লাহগো.....
কতগুনাহ করছি মাবুদ হিসাব নাই
তুমি পানাহ নাহি দিলে উপায় নাই
দয়াল আল্লাহগো....
মোনাজাত শেষ হলে রহিমা খাতুন নিঃশব্দে জলচৌকিতে একথালা কড়কড়া ভাত আর ভাতের মাড় দিয়ে রাধা একবাটি জলপাইয়ের টক এনে রাখে। পাতের কিনারে কিছুটা লবণ।
দয়াল মিয়া একসময় পাটের ব্যবসায় করতেন। লোকে এখনো ব্যাপারী বলেই ডাকে।এখন জমিজিরাত যা আছে চাষাবাদ করেন।

আঙ্গুল চেটেপুটে খেয়ে উঠে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। শব্দ করে বলে আলহামদুলিল্লাহ-
ঘুমন্ত ছেলের শরীরের কাঁথা একটানে সরিয়ে দিয়ে বলে-
-উঠ ঘুম থাইক্কা, বেইল বারডা নাগাদ ঘুমাইলে ভাত মিলব? ক্ষেতে পইখ পড়ছে। তাড়াতাড়ি ক্ষেতে যা।
মুর্শিদ আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় চোখ কচলাতে থাকে।
কান্না কান্না গলায় মাকে ডাকে।
-ও মায়ো...
রহিমা খাতুন ছেলের কাছে এসে ছেলেকে বুকে টেনে নেয়। মায়ের বুকের উষ্ণতায় ছেলের কান্না থামে। একটা সুতি শাড়ী ভাঁজ করে ছেলের শরীরে বেঁধে দেয়।
-মায়ো, মেলা ঠান্ডা পড়ছে আইজ যামুনা।
-ক্ষেতে পইখ পড়ছে বাপ। পইখে গমক্ষেত নষ্ট করলে খাইবি কী? যাও আব্বা ইসকুলের সময় হইলে চইল্লা আইসো।
ওদিকে দয়াল মিয়া লাঙ্গল জোয়াল নিয়া বের হয়ে গেছে। ভোরের আলো এখনো ফোটেনি।ঘন কুয়াশা ভেদ করে দয়াল মিয়া মাঠের দিকে যেতে থাকে হালের বলদ নিয়ে। বাপের পেছন পেছনই মুর্শিদ মিয়া বেরিয়ে পড়ে। পুটলিতে কয়েকটা মোয়া আর কিছু চাল। একটা দিয়াশলাই। অন্য হাতে একটা টিনের থালা , একটা বাঁশের কাঠি ।
গমের চারা গজাতে শুরু করলে পাখিরা বড় জ্বালাতন করে। অঙ্কুরিত চারাগুলো পাখিরা তুলে ফেলে। তাই ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে পাখি তাড়ায়। সময় করে দিনে দু'বেলা সকাল আর বিকাল। এদু'সময়ে বেশি পাখি পড়ে।
মুর্শিদ মিয়া পেছন থেকে বাপের গলা শুনতে পায়।

তুই যদি আমার হইতিরে
ও বন্ধু,আমি হইতাম তোর
কোলেতে বসাইয়া তোরে
করিতাম আদররে....
মুর্শিদ মিয়া বুঝতে পারে বাপজানের অনেক কষ্ট। বাপজানের জন্য তার মায়া লাগে।বাপজানের এত কষ্ট!কিসের এত কষ্ট?
কুয়াশার জন্য এক বিঘা দূরের বস্ত্ত ও দেখা যায়না। কিন্ত্ত অনেক দূরের শব্দ শোনা যায়। মনে হয় শব্দটা বুঝি এই কাছ থেকেই আসছে।
কৃষকের গলার শব্দ। কেউ আপন মনে গান করছে।
-কদম তলায় দিও দেখা বন্ধু কেউ যেনো না জানে...
-ও গনি মিয়া একচিলুম তামুক ধরাও দেহি।
-হেই যা ...হাট...আরেয্যা...বায়ে যা বায়ে...ডানে ঘোর ডানে..যা..হট।
মুর্শিদ মিয়া ভেবে অবাক হয় এতদূরের শব্দ শুধু সকালেই কেন শোনা যায়? অথচ দিনের বেলা যখন কুয়াশা থাকেনা তখন অনেক দূর থেকে ডাকলেও শোনা যায় না?
মুর্শিদ মিয়া গমক্ষেতের আইলে এসে ঢেঁড়ার ভেতর থেকে কিছু শুকনা নারা বের করে আগুন ধরায়। হাত পা গরম করে।
ও কি শীত! শরীরের রক্ত বরফ হয়ে গেছে।
শরীর গরম করে ঢেঁড়াতে এসে বসে। এখনো পাখিরা আসেনি।
কাকগুলো কা কা করতে করতে উড়ে আসছে। মুর্শিদ মিয়া বাঁশের কাঠি আর থালা হাতে নেয়। কাক জমিতে বসার আগেই আওয়াজ তোলে টিংটিং টিংটিং....ছলেরে ছলে..................
চারদিক থেকে অন্যান্য ছেলেমেয়েরাও একই সুরে বলে উঠে ছলেরে ছলে....ঐকতান ছড়িয়ে পড়ে দূর থেকে দূরে। আবার আওয়াজ উঠে ছলেরে ছলে ...
মুর্শিদ মিয়া খুশি হয়। পুটলিটার দিকে তাকিয়ে মুর্শিদ মিয়ার কুলসুমের কথা মনে পড়ে।
-ঐ ছমির আইছস নিহি রে?
-হ আইছি
-কুলসুম আইব নারে?
-আইব আইব।
পাখি তাড়িয়ে এসে মুর্শিদ ঢেঁড়াতে এসে বসে। এ ঢেঁড়া দয়াল মিয়া আমন ধানের নারা দিয়ে তৈরী করে দিয়েছে ছেলের জন্য। ঢেঁড়ার ভেতরটা খুব গরম। শীত আর কুয়াশা থেকে বাঁচা যায়।
কুলসুম তার পাশের জমির মালিকের মেয়ে। পাশাপাশি হওয়ায় দু'জনের খুব ভাব। তার আসাতে দেরি হওয়ায় সে পেরেসান বোধ করে। কুলসুমের জমিতে পাখি পড়লে সে সেগুলিও তাড়িয়ে দিয়ে আসে।

- কু.....উ। আমি আইছি মুর্শিদ।
-তুইতো একশো বছর বাঁচবিলো। একটু আগে আমি তোর কথা জিগাইতেছিলাম।
-ক্যান আমার কথা জিগাইতেছিলি?
মুর্শিদ লজ্জা পায়। তার মুখ লাল হয়ে উঠে। কিছু বলতে পারে না। হঠাৎ তার কি যেনো মনে পড়ে।
-কুলসুম আনছস নি?
-আনছি।তুই আনছস?
-হ,আনছি মা'য় দিছে।
-মায়ের কাছ থেইকা ডিম আর তেল লুকাইয়া আনতে আনেতইতো দেরি হইয়া গেলো। তোর চাইল দে। রান্দন শুরু করি। আর একখান কাম কর ঐ ডোবা থাইকা এক ডেকচি পানি লইয়া আয়। আমার ডেকচি লইয়া যা। তাড়াতাড়ি।
-কুলসুম বড় দেখে মাড়ি ঢেলা জোগাড় করে। আগের দিন জমিয়ে রাখা শুকনা নারা দিয়ে রান্না শুরু করে। ডিম আর ভাত। দু'জনে মিলে মজা করে খায়।
ফাঁকে ফাঁকে পাখি তাড়ায়।
-রান্দন ভালা হইছে কুলসুম। মজা হইছে।
-হ,আমারও মজা লাগতাছে। তাড়াতাড়ি খা হেতারা দেকলে কিন্ত্তক শরম হইব।
খেতে খেতে চারদিকে আলো ফোটে। কয়াশা কমে আসে। সব ছেলেরা একসাথ হয়। শুরু হয় গল্প। কে কতটা গালি শিখেছে তার গণনা। ঢিল ছোঁড়া প্রতিযোগিতা। কে কত দূরে নিতে পারে। শুরু হয় কুস্তি। কে কাকে মাটিতে ফেলতে পারে। কুস্তির কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা। কে কার সাথে কুস্তি লড়বে তার সিদ্ধান্ত।
একসময় বেলা বেড়ে গেলে তারা বাড়ি চলে যায়। যখন আর পাখি পড়েনা। কেউ কেউ স্কুলে যায়। কেউ যায় না। মুর্শিদ মিয়া স্কুলে যায়। তার বাবার স্বপ্ন ছেলে শিক্ষিত হবে। দারিদ্রতার কারণে নিজে বেশি দূর পড়তে পারেনি বলে একটা ক্ষোভ আছে ভেতরে। অথচ দয়াল মিয়ার পেছনের বেঞ্চের ছেলেরা এখন শহরের বড় চাকুরে। ঈদে-চান্দে বাড়িতে আসলে তাদের দেখলে কষ্টটা বাড়ে।
আবার যখন রোদ পড়ে আসে, বিকেল হয়, তখন ছেলে মেয়েরা আবার এসে হাজির হয় তাদের মিলন মেলায়।

মুর্শিদ মিয়ার প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়। প্রতিদিনই মা'য়ের কাছে ক্ষেতে না যাবার কথা বলে। আবার প্রতিদিনই জমিতে যায়।
পাখি তাড়াতে এসে ঘুমের মোহ ভুলে যায়।
তারা একসাথে আওয়াজ তোলে-ছলেরে ছলে...সে আওয়াজ কুয়াশা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে দূর থেকে দূরে। সে সুরে সকাল জেগে উঠে নিদ্রা ভঙ্গ করে। সে সুরে সন্ধ্যা আসে, রাত হয়। কুয়াশা পড়ে। শীত নেমে আসে। দূর্বাঘাস ভিজে,কেলাইয়ের সতেজ সবুজ পাতারা ভিজে, সরিষার ফুল ভিজে চপচপে হয়। মটরশুটির পুষ্ট ডগা আরো পুষ্ট হয়। মটরের ফুলে, কেলাইয়ের ফুলে, সরিষার ফুলে ভ্রমর গুনগুন করে। মৌমাছি উড়ে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৫৮
৩৩টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×