যখন ছোট ছিলাম তখন ঘরে ঘরে মুরগী পালিত হতো।গ্রামে তো বটেই শহরেও বাগান বা বারান্দার কোণে অনেকেই মুরগী পালতেন।মুরগী তখন ঘরের খাবার খেত,সেইসাথে আসেপাশে ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করত।তখন গরুর মাংসের দাম কম ছিল তাই ওটাই ছিল রেগুলার মাংশ। মুরগী খাওয়া হতো হঠাৎ হঠাৎ।তখন আমার কাছে মুরগীর মাংশ ছিল গরুর চেয়ে উপাদেয়।তখন আমরা শেয়ালের সাথে মুরগী ভাগাভাগি করে খেতাম।গ্রামের বাড়িতে মাঝে মাঝেই মুরগীর ঘরে শেয়াল হানা দিত।যদি দরজা খুলে আস্ত মুরগী নিতে না পারে তখন খোপের নিচ থেকে মুরগীর ঠাং ছিঁড়ে নেয়ার চেষ্টা করত।আমি নিজ চোখে দেখেছি এমন ঘটনা।তখন বাড়ির গেরস্তের কাছে তখনি মুরগীটা জবাই করা ছাড়া উপায় থাকত না।
এখন দিন বদলেছে।পোল্ট্রি ফার্মের কারনে আমাদের ঘরে এখন মুরগী ও ডিম দুইটিই খুব সহজলভ্য জিনিস হয়ে গিয়েছে।আমাদের ঘরে ডিমের ব্যবহার এখন পেঁয়াজ বা আলুর মত,আর মুরগীর ব্যবহার অনেকটা ডিমের মত।অর্থাৎ খুব সহজেই যেকোনো খাবারে এগুলো ব্যবহার করা হয়।হোটেল রেস্তোরা, হলের ডাইনিং- ক্যান্টিন এগুলো এই ডিম আর মুরগীর উপর খুবই নির্ভরশীল। চাষের মাছ আর মুরগী-ডিম না থাকলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হতো কারন গরু এবং দেশি মাছের দাম সবসময় বায়ুমন্ডলের উপরের দিকে থাকে।
এখন আমরা সভ্য হয়েছি।এখন আমরা আর ঘরে মুরগী পালিনা।এসব করার সময়ই বা কোথায় আমাদের?এখন আমরা হিন্দি সিরিয়াল দেখা শিখেছ, ফেসবুক টেপাটেপি করা শিখেছি আর টিকটক ভিডিও বানাতে শিখেছি।তাই মুরগী ও ডিমের জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয়
পোল্ট্রি ফার্মের উপর।ফার্মের মুরগী তো ঘরের খাবার খায়না।খাবার আসে ফ্যাক্টরি থেকে।মাঝে মাঝেই সেখানে নাযনা রকমের দূষিত পদার্থ পাওয়া যায়।এই নিয়ে কথাও হয়,লেখালেখিও হয় তার চেয়ে বেশি হয় গুজব।তবে কাজের কাজ যেটা (দূষণমুক্ত পোল্ট্রি ফিড বানানো নিশ্চিত করা) সেটাই হয়না।
আমাদের দেশে যাদের অবস্থা ভাল তাদের অনেকেই আজকাল ব্রয়লার মুরগীর নাম শুনলে কেঁচো দেখার মত আঁতকে ওঠে।তারা দেশি মুরগী দেশি মাছ ছাড়া খেতে চায় না।গাদাগাদা টাকা খরচ করে তারা দেশি মাছ ও মুরগী কেনে।এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে বাড়াতে মহাশূন্যে নিয়ে যায়।এটা অনেকের কাছেই ফ্যান্টাসির মত।অনেকেই নেকু নেকু গলায় বলে ফার্মের জিনিস আমি খেতে পারিনা(অথচ সারা পৃথিবী এখন ফার্ম নির্ভর)। কেউ কিছু বললে এরা বলে ফার্মের মুরগীতে স্বাস্থ্যঝুঁকি।আমি মানি রুচির ব্যাপারটা আলাদা এবং টাকা থাকলে মানুষ খরচ করতেই পারে।তবে যারা স্বাস্থ্যঝুঁকির দোহাই দেন তাদের চুপিচুপি বলে রাখি--গ্রামেও কিন্ত ডিস লাইনসহ টেলিভিশন আছে সেখানেও বউঝিরা হিন্দি সিরিয়াল দেখে এবং কেউই মুরগী তেমন পালেনা। তাই আপনার টেবিলে যে দেশি মুরগী যাচ্ছে তা কিন্ত ওই পোল্ট্রি ফার্মেই পালা মুরগী(বিশ্বাস না হয় খোঁজ নেন) এবং তা ঐ একই ফীড খায়।তাই ভারী ধাতু ও এবং অন্যান্য দূষক দেশি মুরগীতেও আছে।এখন ধান চালের অনেক দাম তাই দু একজন যারা বাড়িতে মুরগী পালে তারাও বাজার থেকে ফীড কিনে আনে।মুদি দোকানে এসব খুচরা বিক্রয় হয়।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে মুরগীর জাত বলে একটা ব্যাপার আছে।ব্রয়লার গোষ্ঠীভুক্ত জাতগুলো তৈরি মাংসের জন্য, লেয়ার ডিমের জন্য,সোনালী রোস্ট বা এ জাতীয় খাবারের মাংসের জন্য ইত্যাদি। দেশি মুরগী ভিন্ন ভিন্ন জাতের যথেচ্ছা মিশ্রিত ব্যাপারস্যাপার।ফার্মে মুরগীকে এন্টিবায়োটিক বা অন্য হরমোন দিয়ে যতদিন পরে বাজারে ছাড়া উচিৎ অনেক অসাধু খামারি তার আগেই ছেড়ে দেয় বলে প্রমান আছে।এতে মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি বাজে প্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার ।তবে সোনালী মুরগীকে হরমোন দিয়ে ব্রয়লার বানানো যাবে না।অনেকেই অবশ্য এটাই মনে করে যে যেকোনো মুরগী হরমোন দিয়ে ব্রয়লারের মত গোলগাল বানানো যায়!
অনেকে মনে করেন ব্রয়লার ক্ষতিকর কিন্ত সোনালী বা লেয়ার নয়।আসলে যেসব ক্ষতি নিয়ে আমরা চিন্তিত সেটা থেকে বাঁচতে হলে দুটো উপায় এক মুরগী খাওয়া একদম ছেড়ে দিতে হবে।নয়ত সেই যে সভ্যতার আগের যুগে ফিরে যেতে হবে অর্থাৎ নিজের বাসায় পালন করে খেতে হবে।
অনেকে ভাবতে পারেন এই দুঃসময়ে মুরগী নিয়ে পড়লাম কেন?লিখলে করোনা নিয়ে লেখা উচিৎ নয়ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে!
আসলে কয়েক জেলায় আত্মীয়স্বজনদের কাছে শুনলাম মুরগী ও ডিমে নাকি করোনা ভাইরাস আছে তাই খাওয়া যাবে না। এটা একদমই গুজব এবং এমন কোনো প্রমান পাওয়া যায়নি বলে আইসিডিইয়ার ও ব্রিফিং দিয়েছে।করোনা ভাইরাস শুধু স্তন্যপায়ী প্রানীকেই আক্রমণ করতে পারে বলে জানা গেছে। কিন্ত যে বা যাহারা এই গুজব ছড়িয়েছে তারা নরকের কীট ছাড়া আর কিছুই নয়।যাদের টাকা আছে তারা গরুর মাংশ ও দামী মাছ কিনে চালাতে পারবে কিন্ত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ফার্মের মুরগী ও ডিম এখন জীবন বাঁচানোর রসদ।একটু বেশি করে কিনে জমিয়ে রাখলেও বেশ অনেকদিনের প্রোটিনের অভাব পূরন হয় এবং বারবার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়না।গুজবের জন্য অনেকেই ভয়ে মুরগী ও ডিম কেনেননি।মুরগী নিয়ে নানা গুজব প্রায়ই হয় কিন্ত এই খাদ্যাভাবের সময় এমন গুজবের ফলে নিন্ম আয়ের অনেক মানুষ বিপদে পড়েছেন।
খবর
এমনিতে ক্রেতা কম তার উপর গুজবের কারনে বিভিন্ন স্থানে মুরগী ও ডিমের দাম অত্যাধিক নেমে এসেছে।অনেক খামারি মুরগীর বাচ্চা মাটিচাপা দিয়ে ব্যাবসা গুটিয়ে ফেলছেন।অনেকে নতুন মুরগী তুলছেন না।এতে করোনা কেটে গেলেও বাজারে অনেকদিন এধনের খাবারের ঘাটতি থাকবে।এখন মানুষ কিনছে না কিন্ত কয়দিন পর আর চাইলেও পাবে না। এতে যেমন বাড়তি দাম গুনতে হবে তেমনি সাধারন নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে সাধারণ এ খাবারটি।পথে বসবে অনেক পোল্ট্রি ফার্মের মালিক।যেখানে চারিদিকে খাবারের জন্য হাহাকার চলছে সেখানে এমন গুজব কতোটা ক্ষতিকর ভাবুন একবার। অথচ এখন দেশে সবরকম খাদ্য উৎপাদন চলমান থাকা খুব জরুর। নয়ত অনেক মানুষ না খেয়ে মারা যাবে।সারা বিশ্বের সবদেশের জন্য এটা প্রযোজ্য। আর কিছু থাকুক বা না থাকুক যদি খাদ্য উৎপাদন হয় তবে এই মহামারীর ধকল সামলে নেয়া যাবে। প্রোটিনের অভাব শরীরের জন্য খুবই খারাপ,বিশেষ করে করোনা ভাইরাস এর সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হলে দরকার সুস্থ দেহ।প্রানীজ প্রোটিন এখানে খুবই দরকারী জিনিস
মাঝেমাঝেই দেখি ফার্মের মুরগী আর চাষের মাছ(বিশেষ করে পাংগাস আর তেলাপিয়া) নিয়ে রগরগে থ্রিলার টাইপ কিছু প্রতিবেদন বের হয়।তাতে বলা হয় এসব একেবারেই খাবেন না কারণ এই -এই -এই। কিন্ত ভাই তাইলে মানুষ খাবেটা কি সেটা একটু বলেন।শুধু সমস্যা দেখালেই তো হবে না তার সমাধানও তো হওয়া চাই। এগুলো তো সিজেনাল ফল না যে এক মৌসুমে না খেলেই পরের মৌসুমে সব ঠিক হয়ে যাবে।নিত্যকার প্রয়োজনীয় জিনিস ক্ষতিকর দূষনমুক্ত যেন হয় সে চেষ্টাই করা উচিৎ। খাওয়া বাদ দেয়া কোনো সমাধান হতে পারেনা এখানে।আমাদের দেশের মাছ বাইরে রপ্তানি হয় কিন্ত দেশের মধ্য আমরা খেতে ভয় পাই।কিন্ত সত্য কথা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ এগুলো খেয়েই বেঁচে আছে।দেশের যে জনসংখ্যা যদি এই পোল্ট্রিশীল্পের উন্নতি না হতো তবে আমাদের আজও শেয়ালের সাথে মুরগী ভাগাভাগি করে খাওয়া লাগত। আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিৎ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে এধরণের ফালতু গুজবে নয়।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৩:০১