somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হারিয়ে গেলেন কিংবদন্তি

২০ শে জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাবার বইয়ের বেশ বড় সংগ্রহ ছিল যার দুইটি দেয়াল আলমারিতে।সেগুলোর নিচের তাকের বইগুলো উইপোকারা নষ্ট করে ফেলেছিল কিছু কিছু।একদিন বাবা সব ঝেড়েমুছে ঠিক করতে বসলেন।আমি তখন প্রাইমারি স্কুল লেভেলে।দেখলাম সাধারন বই থেকে আকার আকৃতিতে ছোট বেশ কিছু বই।যার অনেকগুলোও উইপোকা খেয়ে ফেলেছে।বাবা আফসোস করতে লাগলেন।তারপর ঝেড়ে মুছে ভাল ভাল বইগুলোকে আলাদা করতে লাগলেন।আমিও হাত লাগালাম,আর নেড়েচেড়ে দেখলাম রংচঙে বিচিত্র প্রচ্ছদসহ বইগুলো।বইগুলো ছোট, পাতাগুলো কেমন যেন সংবাদপত্রের মত। এককোনে কেমন যেন প্রজাপতির ছাপ।

হ্যাঁ এভাবেই সেবা প্রকাশনীর সাথে আমার প্রথম দেখা।বাবা মায়ের বই পড়ার অভ্যাসের কারনেই হয়ত ছোট থেকেই বইয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল।গিফটের কিছু বই আর বাবার সংগ্রহের কিছু বই বেছে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করতাম।বাংলা সাহিত্যের মূল ধারার সাথে এসময়েই আমার পরিচয় কিন্ত মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রায় একই সময়ে বাংলা সাহিত্যের রোমাঞ্চ-রহস্য ধারার সাথেও পরিচয় হয়েছিল।

তখন আমি সবে হাইস্কুলে উঠেছি।কোনো এক নির্জন দুপুরে বাবার আলমারির নিচের তাক থেকে কভারপেজ ছেড়া একটি বই তুলে নিয়েছিলাম।আনমনেই উল্টেছিলাম তার পাতাগুলো।একপাতা দুইপাতা করে পড়তে গিয়ে প্রবল চুম্বক আকর্ষণে আটকে গেলাম বইটিতে।সেই তখনই মাসুদ রানার সাথে আমার প্রথম পরিচয়।

মাসুদ রানা!সেই হ্যান্ডসাম প্রবাদপুরুষ।যার রহস্যময় চরিত্রের প্রেমে না পড়ে উপায় নেই।গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম একে একে বই।চোখের সামনে ভাসতে লাগলো দেশ বিদেশের নানা জায়গা, ভাসতে লাগলো রানার নানা অভিযান। পড়তে পড়তে ভাবতাম কিভাবে এত চমৎকার একটা চরিত্র তৈরি করলেন লেখক!
যিনি লেখেন তিনি তাহলে কত বিষয়ে জানেন!একজন মানুষের জানার পরিধি কত হতে পারে?ছোট্ট মাথায় হিসাব কিছুতেই মিলতো না।সেই থেকেই কাজী আনোয়ার হোসেনের গুণমুগ্ধ পাঠক আমি।সেই থেকেই এই কিংবদন্তির সাথে পরিচয়।

আমার বাসায় শিশুকিশোরদের উপযোগী বই ছিল কম।তাই ছোট বয়েসেই বড়দের অনেক বই পড়ে ফেলেছিলাম।এজন্যেই আমি হ্যারি পটারকে চিনতাম না তবে মাসুদ রানাকে চিনতাম। তিন গোয়েন্দার সাথে পরিচয় হয়েছে মাসুদ রানার সাথে পরিচয়ের বেশি কিছু বছর পরে।

বইপড়া ভালোই এগিয়ে চলছিল কিন্ত এরমধ্যেই একদিন বাবার নজর পড়ল।বইটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে মাকে ডেকে বললেন এই বই তো এই বয়েসে পড়ার কথা না! তখনই ভালো করে উপলব্ধি করলাম এটা আসলে বড়দের বই।এখানে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার ব্যাপার আছে।বলা হলো বড় হলে পড়া যাবে মাসুদ রানা এখন পড়া যাবে না।

বাবা-মায়ের কথা মেনে নিতে হলো তখনকার মত।কিন্ত আমি আসলে বই পড়ে ফেলেছি অনেকগুলো। সেই অদম্য আকর্ষণ কি সামলানো যায়?বই পড়া অব্যাহত থাকলো গোপনে।কিছুদিন পর শুরু হলো গোপন সংগ্রহ। কিছু কিছু বই কিনে বাবার বইগুলোর আনাচেকানাচে রেখে দিতাম যাতে আলাদা করে চোখে না পরে।সেই সময়গুলোও ছিল এডভেঞ্চারের মত।এভাবেই আমার নিজের বইয়ের সংগ্রহ গড়ে উঠতে থাকে।বড় হতে হতে স্কুলের বৃত্তির টাকা,আত্মীয়দের দেয়া টাকা সব যেতে থাকে বই কেনার খাতে।এখন আমার সংগ্রহের প্রায় অর্ধেক বই সেবা প্রকাশনীর।আজও দুপুরে যখন রকমারিতে বেশকিছু সেবার বইয়ের অর্ডার দিচ্ছিলাম,বুঝতে পারিনি সন্ধ্যার মধ্যে এই দুঃসংবাদ শুনবো।

এভাবেই কাজী আনোয়ার হোসেন আমার সামনে খুলে দিয়েছিলেন এই বিপুল পৃথিবীর অসীম রহস্যের দুয়ার।সেখান থেকেই আমার বইপড়ার আগ্রহ আর পৃথিবীকে জানার আগ্রহ অদম্য হয়েছে।তার লেখা মাসুদ রানার মাধ্যমেই সেবা প্রকাশনীর সাথে পরিচয়। তারপর যত দিন গেছে একেএকে পড়েছি কত বিচিত্র বই।তিন গোয়েন্দা সিরিজ,সেবা অনুবাদ,ওয়েস্টার্ন, হররসহ আরো সব বিচিত্র বিষয়ের বই।যত পড়ে ততই নিজের সংগ্রহে নেয়ার চেষ্টা করেছি।

প্রথমবার বইমেলাতে সেবার স্টল খুঁজতে গেলে একজন বলেছিল এই গলির শেষে ডানে ঘুরে যে স্টলে সবচেয়ে বেশি ভীড় দেখবেন সেটাই সেবা প্রকাশনী। হ্যাঁ সেই ভীড়ের ব্যতিক্রম দেখিনা আজও। স্বল্পমূল্যে যে মানিক রতন সেবা প্রকাশনী পাঠকদের হাতে তুলে দেন তার কোনো তুলনা হয়না।

কাজী আনোয়ার হোসেন আমার বাবা-মায়ের প্রজন্মকে বইয়ের জগতে টেনে এনেছেন।বাবার মুখে শুনেছি- আমাদের জেলার সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকানের মালিক রাস্তার ধারে চাদর বিছিয়ে কিছু বই নিয়ে বসতেন নির্দিষ্ট দিনে।গ্রাম থেকে আমার বাবা সাত আট মাইল ধূলো কাদা মাড়িয়ে, বেশির ভাগ সময় পায়ে হেঁটে শহরে গিয়ে তার কাছ থেকে বই কিনে আনতেন।মাসুদ রানা আর কুয়াশা সিরিজ।নতুন বই পাওয়ার জন্য কি অধীর আগ্রহে তারা অপেক্ষা করতেন তা বাবার মুখেই শুনেছি।বাবার বর্ননা থেকেই চোখে ভেসেছে এক গ্রাম্য যুবকের প্যান্ট হাটু পর্যন্ত গুটিয়ে রৌদ্র মাথায় করে ধুলো মাখা পায়ে পথ চলা।ধান বা পাট বিক্রির জমানো টাকা থেকে বইয়ের মলাটে বাঁধা একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ঘরে ফেরা।তারপর গভীর রাতে হ্যারিকেনের আলোয় সেই স্বপ্নের পথে প্রান্তরে বিচরণ।বাবার মুখে শুনেই বুঝেছি তাদের সময়ে কি উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজ।সে উন্মাদনার স্বাদ আমি নিজেও পেয়েছি,হয়ত নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়নি সেভাবে কিন্ত পড়ার আনন্দের কমতি ছিলনা এতটুকুও। এভাবেই তিনি আমাদের প্রজন্মকেও বইয়ের সাথে যুক্ত রেখেছেন।না হোক বেশিরভাগটাই মৌলিক বই।কিন্ত বিদেশি কাহিনীর এত নিখুঁত এডাপটেশন আর কোথাও দেখিনি।এত নিপুন ভাষার ব্যবহারও না।উঁচু মানের লেখক না হলে দেশের সাথে বিদেশের কাহিনীর এমন মেলবন্ধন তৈরি করা সম্ভব না।টিনএজ বয়েসে নিঝুম পল্লীর আমার ঘরটিতে বসে যে জানালাটা দিয়ে পুরো পৃথিবীর বিচিত্র ঘটনাগুলো দেখতে পেতাম তা তৈরি করেছিল সেবা প্রকাশনী আর কাজীদা!

কিংবদন্তিতূল্য কাজী আনোয়ার হোসেনের মহাপ্রয়ানে আমার মত অনেক পাঠকের মনই আজ বেদনার্ত।বাংলাদেশের রোমাঞ্চ-রহস্য সাহিত্যে তার অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।শুধু বিনোদনই নয় লাখো তরুন মনে উনি বিচিত্র জ্ঞান আর কৌতুহলের যে দ্বীপশিখা জ্বালিয়ে দিয়েছেন তা কখনো নিভে যাবে না।তার অনুবাদ গল্পগুলো বিশ্বসাহিত্যের সেরা সৃষ্টিগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে।পৃথিবী সম্পর্কে আগ্রহী করেছে,চিন্তা জগতের বিকাশ ঘটিয়েছে,বড় ক্যানভাসে জীবনকে আঁকতে শিখিয়েছে।

ভাবতেও কষ্ট হয়,বইমেলাগুলোতে তার লেখা নতুন বই আর বের হবে না।আরও একটি কাজি আনোয়ার হোসেন কখনো সৃষ্টি হবে না!

লাখো তরুণপ্রাণের কৈশোর, তারুণ্য আনন্দে আলোকিত করা হে কিংবদন্তি, প্রার্থনা করি ওপারে ভালো থাকবেন।


ছবিঃইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১২:৪৮
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×