‘আমারো আছে, আমার বড় ভাইয়ানা একতা গেম খেলে। বলবনা.. হি হি হি। শুধু গুলি করে .. আর .. হি হি ..মেয়ে গুল কোন জামা পরেনা।‘
‘আমার আব্বুওনা কাল রাতে কম্পুতে একতা পোছা ছবি দেখছে... হি হি.. কি পোছা।']
----------------------------------------------------------------
সেদিন আমার এক বন্ধুর মুখে গা-গা-গা গু-গু-গু জাতীয় অদ্ভুত বিজাতীয় ধ্বনি শুনে থমকে গেলাম। বন্ধুটিকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,’কিরে, এরকম করছিস কেন? তোর প্রব্লেমটা কি?’ কে শোনে কার কথা। বন্ধুটি চালিয়ে গেল- উকু বুকু মুকু, ইটলি পিটলি। পরে খোলাসা হোল। ও আসলে ওর আধো বোল শেখা দু’বছুরে বাচ্চার সাথে বাতচিত করছে।
শিশুরা বড়ই নির্মল। ফুলের মত সুন্দর। অবশেষে সব বাদ দিয়ে এই ফেরেশতার মত মানব শিশুদের নিয়ে রসিকতা বড়ই কষ্টদায়ক। আমার আর কি দোষ। আমি জানিনা গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর কয়টি ছিঁচকাঁদুনে ছেলেমেয়ে ছিল। তিনিতো ছেড়েদিলেন এক বাণী- ‘যতসব জীব জানোয়ার বিদ্যমান তার মধ্যে, মনুষ্য পুরুষ সন্তান ম্যানেজ করা সবচেয়ে কঠিন কাজ’।
আসলে যেকোনো শিশুই –ছেলে হোক বা মেয়ে- শিশু লালনপালন করা দুনিয়ার সব চেয়ে কঠিন কাজ গুলির একটি।
আর এই কঠিন কাজে যুগে যুগে ব্রতী হয়েছে মানব কূল, যেমন হয়েছেন আমার এক প্রতিবেশী ইদ্রিস সাহেব। তিনি তার ফেরেশতার মত ৪/৫ বছরের ছেলেটিকে একদিন নিয়ে গেছেন মসজিদে। ছেলেটির নাম লেখা।
মসজিদে ঢুকেই ইদ্রিস সাহেব ছেলেকে সাবধান করলেন, ‘লেখা, কোন দুষ্টুমি করবানা। চুপচাপ আমার পাশে থাকবা। মনে থাকবে?‘
লেখা শান্ত ছেলের মত মাথা নেড়ে জানাল, থাকবে।
নামাজ শুরু হল। আছরের নামাজ। নিয়ম অনু্যায়ী ইমাম সাহেব নিঃশব্দে তেলাওয়াত করছেন। মোটামুটি পিন পতন নিস্তব্ধতা। ঠিক এমনি সময়ে লেখা শুরু করল তার অপারেশন। বাবার পাশ থেকে আস্তে করে কেটে পড়ে তার প্রায় সমবয়সী মসজিদে আসা আর এক বাচ্চার সাথে গল্প জুড়ে দিল-
‘জানো আমারনা ভিডিও গেম আছে’।
‘আমারো আছে, আমার বড় ভাইয়ানা একতা গেম খেলে। বলবনা.. হি হি হি। শুধু গুলি করে .. আর .. হি হি ..মেয়ে গুল কোন জামা পরেনা।‘
‘আমার আব্বুওনা কাল রাতে কম্পুতে একতা পোছা ছবি দেখছে... হি হি.. কি পোছা।'
বেশ কয়েকজন মুসল্লি ইতিমধ্যেই অস্বস্তিতে গলা খাঁকারি দিতে আরম্ভ করেছেন। ঘটনা এই পর্যন্তই থেমে থাকলে তাও চলত। এর পর মুসুল্লিরা সবাই সেজদায় গেলেন। লেখা যা করল তা ভয়াবহ। এক দৌড়ে সেজদারত মুসুল্লিদের এক এক করে টুপি খুলে নিতে শুরু করল। কে বলে শিশুরা অবুঝ? শিশুটি ভাল করেই বুঝেছে, সব নামাজিরা এখন নাচার। নামাজরত অবস্থায় কারো কিছু বলার জো নেই। সৌভাগ্যবশত ইমাম সাহেব ছিলেন মাটির মানুষ। তাই সেই যাত্রা রক্ষা।
শিশুরা শেখেও খুব দ্রুত। যা শোনে, ভোলেনা। আমার এক আত্মীয়ার দেড় বছরের বাচ্চার কথাই ধরুন। সে কোন এক কুক্ষণে শুনল এক গালি ‘কুত্তার বাচ্চা’। বাসায় যেই আসে, অত্যন্ত হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানায়, ‘কুত্তার বাচ্চা’। আমি ওই বাসায় বেড়াতে গেলাম। আদর করে সবাই যা জিজ্ঞাসা করে তাই করলাম, ‘বাবু তোমার নাম কি’? বলার সাথে সাথে দেখলাম বাবা-মার চোখে আতংকের ছাপ। আমি ব্যাপার কিছু বোঝার আগেই শিশুটি লাফাতে লাফাতে বলল, ‘কুত্তার বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা।‘ নিষ্পাপ শিশুটি আর একধাপ এগিয়ে হাততালি দিয়ে বলল, ‘চাচা, কুত্তার বাচ্চা’। এহেন অভ্যর্থনায় বিচলিত না হয়ে পারলাম না। বাবা মা জানাল নিরপরাধ শিশুটির এই নতুন শব্দ জ্ঞানে তাদের প্রায় ঘুম হারাম হবার যোগাড়।
শিশুরা স্বাদ নেবার বেলায় সব সময়ই উদার। ললিপপ থেকে শুরু করে নিজের বিষ্ঠা পর্যন্ত মুখে পুরে দিতে কোন আপত্তি নেই। তবে অবস্থা ভয়াবহ রূপ নেয় যখন তাদের নতুন দাঁত গজায়। আমি একদিন ট্রেনে করে ব্রিজবেনের দিকে যাচ্ছি। পাশের সিটে বসেছেন এক উচ্ছ্বসিত দম্পতি, সাথে কেবল হাটতে শেখা এক বছরের ভয়াবহ সুন্দর এক শিশু। বাচ্চাটি হাটি হাটি পায়ে আমার পাশে এসে বলল, ‘হেলো’। আমিও ‘হেলো’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলাম, পরে বুঝলাম এটি ছিলা আমার জীবনের বড় ভুল গুলির একটি! শিশুটি আর কোন কথা না বলে সোজা আমার ডান হাতের বুড় আঙ্গুলটি মুখেপুরে তার সদ্য ওঠা দাঁত দিয়ে দিল এক মরণকামড়। কিছুতেই হাত আর ছাড়াতে পারিনা। আমারতো জান যায় যায় অবস্থা। অনেক কষ্টে যন্ত্রণা সামলে মরিয়া হয়ে সাহায্যের আশায় শিশুটির বাবা-মার দিকে তাকালাম। মা আনন্দের আতিশায্যে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘He is teething!’ মানে ‘ওর দাঁত উঠছে’। আমি মনে মনে আওড়ালাম ঈশপের গল্পের ব্যাঙেদের মত-‘What’s fun to you, that’s death to me’.
কোমলমতি শিশুদের নিয়ে এত সব খারাপ খারাপ কথা লিখে আমার নিজেরই বিবেকের দংশন হচ্ছে। অ্যালান মার্শাল বেক বলে এক মনীষীর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দোষের দায়ভার থেকে মুক্ত হতে চাই-
“ওদের সব জায়গায়ই পাওয়া যাবে... উপরে, নীচে, ভিতরে, গাছে, সাঁতরাতে, দৌড়াতে, লাফাতে, কিনা করতে। মায়েরা ওদের ভীষণ ভালবাসেন, সমবয়সী মেয়েরা ওদের দু’চোখে দেখতে পারেনা, বড় ভাই ও বোনেরা ওদের সহ্য করে, বড়রা ওদের না দেখার ভাণ করেন, আর ঈশ্বর ওদের রক্ষা করেন। এই শিশুটি সত্যিই শিশু যখন ওর মুখ কাঁদায়-ধুলয় মাখামাখি হয়, ওর সৌন্দর্য ওর আঙ্গুলের কাটা দাগে, ওর বুদ্ধিদীপ্ততার প্রমাণ যখন ওর চুলে বাবল গাম লেগে থাকে..আর ওদের নিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের সব আশাভরসা উঁকি দেয় যখন ওদের পকেটে থাকে ছোট্ট ব্যাঙের বাচ্চা।“
ছবি সূত্রঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৫:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




