somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমঃ ফিরে দেখার প্রয়াস

২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বালকাশ্রম প্রতিষ্ঠার পটভূমিকা
১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি কোলকাতার কাশীপুর উদ্যানবাটিতে শ্রীরামকৃষ্ণ তখন চিকিৎসাধীন। বিকেল ৩টে। দোতলা থেকে সিড়ি বেয়ে প্রধান দরজার কাছে বেল গাছের কাছে নেমে এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁকে পেয়ে উপস্থিত গৃহীভক্তেরা ঘিরে ধরেছেন। গিরিশ ঘোষের সঙ্গে কথা হচ্ছে তাঁর অবতারত্ব সম্বন্ধে। এমতবস্থায় ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন। বললেন তোমাদের চৈতন্য হোক। গিরিশ ঘোষ সকলকে ডেকে বললেন তোরা ছুটে আয়, ঠাকুর কল্পতরু হয়েছেন। আজ তিনি অহেতুক করুণা বিলোবেন। যা প্রয়োজন তোরা চেয়ে নে।
সে দিন ঠাকুরের গৃহী-ভহক্তদের অন্যতম ছিলেন কোলকাতার নিমু গোস্বামী লেনস্থ উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। পেশায় হকার, কাঁধে ঝোলা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে লক্ষ্মীর পাঁচালী, ধারাপাত, আদর্শলিপি বেচেন। ঠাকুরের কাছে সেদিন তিনি আর্থিক উন্নতির প্রার্থনা জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে ঠাকুরের শরীর গেছে ভক্ত উপেন্দ্রনাথ ছোট প্রেস খুলে বসেছেন। উদ্দেশ্য অন্য প্রকাশনার বই নয়, নিজের প্রকাশিত বই বেচবেন। তাই হল। নিজের রকমারি বই ছাপিয়ে বিক্রি করতে লাগলেন। দেখতে দেখতে বই এর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল। তিনি প্রেস টিকে ক্রমান্বয়ে বড় করতে থাকলেন। এখান থেকে পরবর্তী কালে বের হতে থাকলো দ্বিপাক্ষিক পত্রিকা ‘বসুমতী’। পরে বেরোল দৈনিক ও মাসিক বসুমতী। কোলকাতার বউবাজার স্ট্রীটে অট্টালিকা সম বাড়িতে গড়ে উঠল ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’। উপেন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পর (১৯১৯) তার পুত্র সতীশচন্দ্র সেই সম্পদ আরও বাড়ালেন। তিনি বেলুড় মঠে দীক্ষিত এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযুক্ত ছিলেন। কিন্তু ছন্দপতন ঘটল সতীশচন্দ্রের মেধাবী পুত্র রামচন্দ্র ও দ্বিতীয় কন্যা প্রীতিলতার অকাল মৃত্যুতে। সতীশচন্দ্রের মনে তখন অবিরাম বৈরাগ্য, ঠাকুর ভিন্ন আর কিছু ভাবতে পারছেন না। যেহেতু তিনি বিশ্বাস করতেন ঠাকুরের আশীর্বাদে তাঁর বাবা উপেন্দ্রনাথ বর্তমান বিপুল সম্পদ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী হয়েছেন তাই তিনি কিয়দংশ ঠাকুরের পাদপদ্মে নিবেদন করতে মনস্থ হলেন। বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের দেখভাল করার জন্য তৈরি করলেন একটি ট্রাস্ট। আর রামকৃষ্ণ মিশনে দরিদ্র মানুষের সেবার জন্য রহড়া গ্রামের চারটি বৃহৎ বাগান বাড়ি ও কিছু অর্থ দান করলেন। সব মিলিয়ে জমির পরিমাণ ছিল ১৩ বিঘা ১৫ কাঠা। ইচ্ছে ছিল সেই সেবাকর্মে যুক্ত থেকে অকাল বিধবা পুত্রবধূ অঞ্জলি বাকি জীবন অতিবাহিত করবেন। এদিকে সতীশচন্দ্রও ১৯৪৪ সালের মে মাসে মাত্র ৫১ বছর বয়সে দেহত্যাগ করলেন। সতীশচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী ইন্দুপ্রভাদেবী তিন লক্ষ টাকার সরকারী কাগজ ও নগদ দশ হাজার টাকা দান করলেন।
পরবর্তীকালে অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় অবশ্য আশ্রমের সেবা কর্মের সঙ্গে যুক্ত না থেকে উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করে বিজ্ঞান সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু ‘রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম’ এই নামের সঙ্গে সাইন বোর্ডে ও চিঠির লেখার প্যাডে ‘রামচন্দ্র প্রীতি মেমোরিয়াল’ কথাটি রইল দানের শর্ত হিসাবে। পরবর্তী কালে অবশ্য ব্যক্তিনাম পুরোপুরিই বাদ দেওয়া হল বেলুড় মঠের নির্দেশে।
বালকাশ্রমের মূল কারিগরঃ
রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের প্রথম কর্মসচিব স্বামী পুণ্যানন্দ। মঠ ও মিশনের অলিখিত নিয়মানুযায়ী শাখাকেন্দ্রের ‘প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক’ কথাটি ব্যবহৃত হয় না। এমনকি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ক্ষেত্রেও স্বামী লোকেশ্বরানন্দকে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক না বলে প্রথম কর্মসচিব বলা হয়। তা সত্বেও ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলতেই হয় স্বামী পুণ্যানন্দ ছিলেন রহড়া বালকাশ্রমের মূল কারিগর ও প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । তিনি তিল তিল করে যে প্রতিষ্ঠান টি কে মায়া মমতা স্নেহ ভালবাসা দিয়ে গড়েছিলেন, তাই আজ মহীরূহ হয়ে উঠেছে। নিজের সফলতা প্রসঙ্গে তিনি বলতেন যেদিন তিনি এই আশ্রমের অনাথ ছাত্রদের মন থেকে ‘অনাথ’ কথাটি মুছে দিতে পারবেন সেদিনই তিনি সফল হবেন।
স্বামী পুণ্যানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল প্রিয়নাথ চট্টোপাধ্যায় । গ্রাম বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার নিকটে শিমুলিয়ায়। ১৯০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি তাঁর জন্ম। পিতা পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাতা বিধুমুখীদেবী। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় দুটি বিষয়ে লেটার সহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ন্যাশানাল কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তীদেবীর বক্তৃতা শুনে দেশপ্রেমে উদ্বুব্ধ হলেন এবং কলেজ পরিত্যাগ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়লেন। ১৯২০ সালে গান্ধিজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিলেন এবং কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। মুক্তিলাভের পর সম্পূর্ণ ভাবে রাজনীতি পরিত্যাগ করে জনৈক জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগীর সঙ্গে বেলুড় মঠ আসলেন। সেখানে মঠ ও মিশনের প্রেসিডেন্ট স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী শিবানন্দের সাথে সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য হল।
বেলুড় মঠের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি ব্রহ্মচারী রূপে যোগদান করলেন। নতুন নাম হল পরচৈতন্য। ব্রহ্মচারী হিসাবে মঠে থাকাকালীন তিনি মঠে ব্যবহারের জন্য গঙ্গা থেকে বাঁকে করে জল তুলতেন। কেননা তখন মঠে ট্যাপ কলের জল ছিলনা। বাজার করতেন আর মন্দিরের ভাণ্ডারে কাজ করতেন। ব্রহ্মচারী থাকা অবস্থাতে তিনি মহাপুরুষ মহারাজ (স্বামী শিবানন্দ) এর কাছে থেকে মন্ত্রদীক্ষা লাভ করেন একটি মাত্র হরিতকী গুরুদক্ষিণা দিয়ে। অতঃপর ১৯২২ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি কাঁথি শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম পরিচালনার কাজে যুক্ত হন। এরপর তিনি গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে রেঙ্গুন গেলেন এবং রামকৃষ্ণ মিশন দাতব্য চিকিৎসালয়ের দায়িত্বভার গ্রহন করলেন। রেঙ্গুনে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সোসাইটি গঠিত হয়েছিল। তার দায়িত্বভার মূলত তাঁর কাঁধে না থাকলেও সোসাইটি পরিচালনা করতেন স্বামী রঙ্গনাথানন্দ। পরবর্তী কালে যিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন (১৯৯৮-২০০৫)। যুদ্ধের সময় তিনি যেভাবে নির্ভীক সৈনিকের মত আহত ও অর্ধমৃত মানুষকে কোলে তুলে এনে হাসপাতালে সেবাযত্ন করতেন তাঁর তুলনা হয় না। তাঁকে অনেকসময় মাটির ভেতর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বাঙ্কারের মধ্যেও কাটাতে হয়। এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য দীর্ঘসময় (প্রায় এক দশক) তিনি রেঙ্গুনে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯৪২ সালে জাপানী আগ্রাসনে রেঙ্গুনের পতন হলে তিনি কয়েক হাজার শরণার্থীকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়-অরণ্য সমাকীণ বিপদ সঙ্কুল আরাকানের পথে পদব্রজে ভারতে আসেন। দেশেও তখন ভয়ঙ্কর পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩) এবং প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় (মেদিনীপুরের বন্যা)। ত্রাণের কাজে তিনি নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিলেন।
তখন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক। বর্মার বাঙালী শরণার্থীদের জন্য কলকাতায় তৈরি হয়েছে রিলিফ ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার। মুখ্যমন্ত্রী এই কাজ পরিচালনার দায়িত্ব নেবার জন্য রামকৃষ্ণ মিশনকে আহ্বান করলেন। যেহেতু রেঙ্গুনে থাকাকালীন স্বামী পূণ্যানন্দের দুঃসাহসিক কাজের খবর রামকৃষ্ণ মিশনের জানা ছিল তাই রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে রেঙ্গুন থেকে আসা বাঙালিদের রিলিফের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হল স্বামী পুণ্যানন্দকে। কলকাতার ১০ নং নলিনী সরকার স্ট্রিটের বাড়িতে তাঁর কার্যালয় তারই এককোণায় একটি ছোট্ট ঘরে তিনি থাকতেন যেহেতু তিনি সন্ন্যাসী তাই সরকারের তরফ থেকে মাসিক দশ হাজার টাকা বেতন গ্রহণের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। নিলেন কেবল জলখাবারের মাসিক চারহাজার টাকা এবং ড্রাইভার সমেত একটি সরকারী গাড়ি। এই টাকার বেশিরভাগটাই তিনি ব্যয় করতেন নিজের তত্বাবধানে রাখা অনাথ ছাত্রদের লেখাপড়ার জন্য সেই সময় থেকেই অনাথ ছাত্রদের শিক্ষাদান করার পরিকল্পনা করতে থাকেন।
রহড়া বালকাশ্রম স্থাপনকার্যঃ
হিন্দু মহাসভার কর্ণধার ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হত। বর্তমানে বাংলাদেশের খুলনার সেনহাটি হাইস্কুল এই রকম একটি প্রতিষ্ঠান। নানান কারণে তিনি এই স্কুলটি চালাতে পারছিলেন না। তিনি স্বামী পুণ্যানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং এই সমস্ত ছেলেদের পাঠাতে চাইলেন রামকৃষ্ণ মিশনে। স্বামীজি রাজি হলেন। পরবর্তীকালে ওই ছাত্রদের জন্য একটি গৃহ নির্মাণের ব্যাপারে তিনি হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা দান করলেন। এই টাকায় তৈরী হল ‘হিন্দু মহাসভা ধাম’। এটি রহড়া বালকাশ্রমে প্রথম সারির দ্বিতীয় হোস্টেল। ১৯৪৫ সালে তিনি একবার রহড়ায় এসেছিলেন ছাত্রদের দেখতে। পুরনো আশ্রম বাড়ীর বাইরে প্রাচীন সাধুনিবাসের উল্টোদিকে প্রাচীন আমগাছের তলায় সভা হয়েছিল। আবাসিক ছাত্ররা সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন।
‘দরিদ্র নারায়ন’ অনাথ ছাত্রদের শিক্ষাদানের আকুতি, ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’ –এর দান সামগ্রী, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধ ও পৃষ্ঠপোষকতা , সর্বোপরি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের নির্দেশে স্বামী পুণ্যানন্দকে সক্রিয় করে তুলল। সঙ্গে যুক্ত হল তৎকালীন সরকারী অনুরোধ । তখন শিক্ষা অধিকর্তা ছিলেন জ্যাকেরিয়া সাহেব। তিনিও বন্যা ও দুর্ভিক্ষে কবলিত মানুষজনের ত্রাণের জন্য গঠিত রিলিফ কমিটির সদস্য স্বামী পুণ্যানন্দকে অনুরোধ করে বসলেন বন্যা ও দুর্ভিক্ষে মৃত মানুষের অনাথ পুত্র সন্তানদের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। স্বামী পুণ্যানন্দ সেই বার্তা পৌঁছালেন রামকৃষ্ণ মিশন কে তখন মঠ ও মিশনের প্রেসিডেন্ট স্বামী বিরজানন্দ, ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বামী বিশুদ্ধানন্দ, ও জেনারেল সেক্রেটারি স্বামী মাধবানন্দ ( যিনি পরবর্তী কালে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন)। স্বামী পুন্যানন্দের সঙ্গে মঠ ও মিশনের বহু প্রাচীন সাধুর, গভীর যোগাযোগ ছিল-অনেকের কাছে তিনি ছোট ভাই, অনেকের আধ্যাত্মিক বন্ধু, অনেকের স্নেহভাজন অনুজ। কাজেই মঠ ও মিশনের সবুজ সংকেত পেলেন। ১৯৪৪ সালের ১৬ অগাস্ট বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের দ্বিতল গৃহে শ্রী রামকৃষ্ণের পট স্থাপন করে রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের আধ্যাত্মিক উদ্বোধন হল। শ্রী রামকৃষ্ণ, সারদাদেবী ও স্বামী বিবেকানন্দের ছবি বসিয়ে বিশেষ পুজো, হোম ও প্রার্থনার মাধ্যমে এর উদ্বোধন করলেন তৎকালীন মঠ ও মিশনের জেনারেল সেক্রেটারি স্বামী মাধবানন্দ। কিন্তু প্রকৃত উদ্ভোধন হল দীন-দুঃখী শিশুদের মাধ্যমে, শিবজ্ঞানে জীবসেবার বাস্তব রূপায়নে। বালক নারায়ণ রূপে শ্রীরামকৃষ্ণকে আনলেন’ ১৯৪৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এটি আশ্রম প্রতিষ্ঠার দিবস। প্রাথমিক কর্মী বলতে স্বামী পুন্যানন্দ, ব্রহ্মচারী বঙ্কিম (যিনি রেঙ্গুনে থাকাকালীন রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মী), মেদিনীপুরের মুগবেড়িয়া নিবাসী শিক্ষক বিধুভুষণ নন্দ (বিধুবাবু), বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি নিবাসী সঙ্গীতঞ্জ জানকী মুখোপাধ্যায়। ছাত্রদের দেখাশুনার ভারপ্রাপ্ত অকৃতদার অনিল চন্দ্র দে (অনিল দা) এবং আশ্রম করণিক দ্বিজেন্দ্রলাল দে (দ্বিজেন দা ) । বালকাশ্রমে তখন হাজিরা খাতায় ছাত্রের সংখ্যা ৩৭ যার প্রথম নাম লক্ষ্মণ দে। অন্যান্যরা হলেন কৃষ্ণকমল চক্রবর্তী, (যিনি বর্তমান রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনের প্রধান মহন্ত স্বামী নিত্যানন্দ), সুনীল (পরবর্তী কালে মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী ভারগবানন্দ ভারগবানন্দ), অজিত (পরবর্তী কালে যার নাম স্বামী ভবেশানন্দ), সরোজ কুমার নন্দী, অর্ধেন্দু শেখর দত্ত, সুশীল, কালীপদ চৌধুরী, মাধাই, রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর মাসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য স্বামী পুণ্যানন্দ কোলকাতা থেকে খড়দহ এলেন। তিনি আরও চারজন ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে উঠলেন চিত্তবিশ্রাম এর বাড়িতে। চিত্তবিশ্রাম ছিল ১৯৩২ সালে রহড়ার চৌধুরী পাড়ায় নির্মিত বসুমতী সাহিত্যমন্দিরের ছাপাখানা।
আশ্রমের নামকরণ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। স্বামী পুণ্যানন্দ ‘রামকৃষ্ণ মিশন অনাথ আশ্রম’ নাম রাখা হবে স্থির করেছিলেন। সুচনালগ্ন থেকে যিনি আশ্রমের শিক্ষক বিধুবাবু (বিধুভুষণ নন্দ) নামটি পছন্দ করলেন না। তিনি সবিনয়ে স্বামীজিকে বললেন, ঠাকুর রামকৃষ্ণ আর শ্রীমা সারদা যাদের পিতা-মাতা তারা অনাথ হবে কেন? স্বামী পুণ্যানন্দ ছিলেন অসীম দূরদর্শী অথচ স্পর্শকাতর – স্নেহময় সন্ন্যসী তিনি বললেন, ‘বিধু তবে তুমিই বল কি নাম হবে’। বিধুবাবু প্রস্তাব করলেন ‘রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম’ । স্বামীজি দুটো নামই মঠ এর কাছে পাঠালেন। মঠ জানিয়ে দিলেন ‘রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম’ নামটিই তাদের পছন্দ। অতঃপর বিধুবাবুর দেওয়া নামটি বহাল রইল।
বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের আশ্রম পরিদর্শনঃ
(১৯৪৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর) ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয়-পত্নী লেডি ওয়াভেল রহড়া বালকাশ্রম পরিদর্শনে এসেছিলেন স্বামী পুণ্যানন্দ অবশ্য লেডি ওয়াভেলকে জানিয়েছিলেন রহড়ায় ভাল রাস্তাঘাট নেই, আশ্রম এর পরিসরও ক্ষুদ্র এবং অসম্পূর্ণ। তা সত্বেও লেডি জমলগ্নেই আশ্রমটিকে পরিদর্শন করতে চাইলেন। কারণ স্বামী পুণ্যানন্দের সেবাকাজ সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু শুনেছেন। লেডি ওয়াভেল তখন কোলকাতার রাজভবনে ছিলেন। স্বামী পুণ্যানন্দ ও অপরাপর সন্ন্যাসীরা ফুলের তোড়া দিয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছিলেন। লেডি ওয়াভেল বসুমতীর আশ্রম বাড়িতে গিয়ে ছাত্রদের বসবাসের ডরমিটরি দেখেছিলেন। আশ্রমের অন্যান্য স্থান ভ্রমণ করে তিনি স্বামীজির সঙ্গে বেশ খানিক সময় কথা বলেন। চলে যাবার আগে তিনি স্বামীজিকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘What is your standard of success?’ স্বামীজি তাঁর উত্তরে বলেছিলেন, ‘I shall achieve 100% success on the day when I shall be able to remove from the mind of children that they are orphan’. লেডি এই জবাবে ভারী অবাক হলেন। বললেন, ‘I have visited many institutions in and other states. Every where they told me that it is only lack of money for which they are unable to do good work. Your is only place where I am not told anything about difficulty. স্বামীজি পুনরায় বললেন ‘ I do believe if any good work is done sincerely, money will not create any difficulty’
পরের দিন স্বামীজি রাজভবন থেকে চিরাচরিত পোশাক পরা এক চাপরাসির মাধ্যমে লেডি ওয়াভেলের লেখা একটি চিঠি ও চেক পেলেন। চিঠিতে লেডি পুণ্যানন্দকে লিখেছেন-
My dear Swamiji,
A friend of mine gave me Rs 25,000/- for some good work, particularly for the poor children. At this moment I cannot think of any other institution better than yours. Hence this cheque for Rs. 25,000/- . Use it in the manner you think best.
With love and regards,
Sincerely yours,
Lady Wavell.
১৯৪৭ (সম্ভবত) সালে মিসেস মাউন্টব্যাটেন রহড়া বালকাশ্রমে এসেছিলেন একটি সুন্দর বিকেলে। নেহেরু, পরিবারের এক কন্যা চন্দ্রাকুমারী হান্ডু রেঙ্গুনে গিয়ে স্বামী পুণ্যানন্দের অনবদ্য কাজের পরিচয় পূর্বেই পেয়েছিলেন। উনার স্বামী ছিলেন তদানীগুন ইম্পিরিয়ল ব্যাঙ্কের গভর্নর। মিসেস হান্ডুর বান্ধবী ছিলেন মিসেস মাউন্টব্যাটেন। তিনিই মিসেস মাউন্টব্যাটেনকে রহড়া আশ্রমে পরিদর্শনে এনেছিলেন। তখন আশ্রমের ইস্কুল বাড়ি বলতে একতলা টিনের চালা একটি বাড়ি। সেখানেই টিচার্স রুমে তাঁদের বসানো হল। চা পানের ব্যাবস্থা করা হল। তাঁর জন্য উপযুক্ত কাপ, প্লেট, চামচ আনা হয়েছিল রাজ ভবন থেকে। কারণ আশ্রমের আর্থিক অবস্থা তখন এমনই খারাপ যে সেগুলির কেনার সামর্থ্য ছিল না। মিসেস মাউন্টব্যাটেন, মিসেস হান্ডু ও অন্যান্য আধিকারিক দের চা, বিস্কুট, মুড়ি খাওয়ানো হয়েছিল। মিসেস মাউন্টব্যাটেনের অত্যন্ত সহৃদয় ব্যবহার দেখেছিল রহড়া আশ্রম।
১৯৫১ সালে রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট তথা সঙ্ঘগুরু স্বামী বিরজানন্দ বালকাশ্রমে পরিদর্শনে আসেন। সঙ্গে এসেছিলেন স্বামী অভয়ানন্দ (ভরত মহারাজ), স্বামী নির্বানানন্দ মহারাজ (সূর্য মহারাজ), স্বামী ক্ষমানন্দ প্রমুখ সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারী। স্বামী বিরজানন্দকে বালকাশ্রমে বসুমতীর পুরানো বাড়িতে বসানো হয়েছিল। শতরঞ্চির উপর রক্ষিত একটি ইজি চেয়ারে তিনি বসেছিলেন। স্বামী পুন্যানন্দ গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে ও অন্যান্য সাধুদের অভ্যর্থনা করেছিলেন। সংঘগুরুর সামনে রাখা হয়েছিল কোশাকুশি, পুষ্পপাত্র, ঘন্টা, কমণ্ডলু ইত্যাদি। পুজকের আসনে বসেছিলেন আশ্রমিক কৃষ্ণকমল চক্রবর্তী (পরে স্বামী নিত্যানন্দ)। পুজো হল মাটির মূর্তিতে নয় সাক্ষাৎ মানব দেহে।
এরপর মঠ মিশনের প্রায় সকল সংঘগুরু বালকাশ্রম পরিদর্শন করেছেন। স্বামী পুণ্যানন্দ তাঁদের সকলকে গভীর শ্রদ্ধা ভক্তি প্রদর্শন করে অভ্যর্থনা করেছিলেন। যেমন স্বামী শঙ্করানন্দ, স্বামী মাধবানন্দ, স্বামী বিরেশ্বরানন্দ প্রমুখ। তাঁদের যে গৃহে রাখা হত তাঁর প্রবেশ পথে থাকতো লাল কার্পেট তাঁদের সম্মুখে পরিবেশিত হত নানান খাদ্য সামগ্রী। স্বামীজি তাঁদের গলায় ফুলের মালা পড়িয়ে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এছাড়াও মঠ মিশনের বহু পদাধিকারী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রহড়ায় এসেছেন। বালকাশ্রমে পালিত বাৎসরিক রামকৃষ্ণ, সারদা – বিবেকানন্দের জন্মোৎসবে বেলুড় মঠের সাধু ব্রহ্মচারীরা আসতেন। একদিন বরাদ্দ থাকত ‘সাধু ভান্ডারা’ দিবস উপলক্ষে। পরিবেশিত খাদ্যের মধ্যে অবশ্যই থাকত চিতল মাছের পেটি, ঢাকাই অমৃতি আর গামছা বাঁধা দই।
তিল কুড়িয়ে তাল
১৯৪৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর মাত্র ৩৭ জন অনাথ শিশুকে নিয়ে স্বামী পুণ্যানন্দ যে ক্ষুদ্রায়তন আশ্রম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সকল সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী-শিক্ষক-কর্মীর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আজ তা বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়েছে। কিভাবে তিল থেকে তাল, রাই কুড়িয়ে বেল হল সে এক দীর্ঘমেয়াদী ইতিহাস।
আশ্রম গড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্বে স্বামী পূণ্যানন্দ সকালে হেঁটে খড়দহ স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে করে শিয়ালদহে যেতেন। সারা দিনের প্রচেষ্টায় পরিচিতদের কাছে গিয়ে কিছু দান সংগ্রহ করে সন্ধ্যার পরে আশ্রমে ফিরে আসতেন। রহড়া তখন এক ছোট গ্রাম – অনুন্নত, জঙ্গলাকীর্ণ, রাতে ঘোর অন্ধকার। সন্ধ্যার পর স্টেশন থেকে বালকাশ্রম যাবার পথ মোটেই নিরাপদ ছিলনা। তাই আশ্রমের কর্মীরা লাঠি আর লন্ঠন নিয়ে স্বামীজিকে আনতে যেতেন। আর্থিক দান ভালমত পেলে স্বামীজি আনন্দ পেতেন। আর মুখেও থাকত নির্মল প্রশান্তি। আবাসিকরা সেটাই আশা করে স্বামীজির মুখের দিকে চেয়ে থাকত। কারণ পরদিন তবে ভাল খাবার পাওয়া যাবে। তখন আশ্রমে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা ছিল।
পুরনো আশ্রমবাড়িতে সন্ধ্যায় লন্ঠনের আলোতে পড়াশুনা চলত। বিদ্যুৎ ছিল না। স্বামীজি পরিমিত কেরোসিনের বন্দোবস্ত অনেক সময় করতে পারতেন না। তাই তেল ফুরোলে বাতি নিভে যেত, পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যেত। অন্ধকারে আবাসিকরা চেঁচামিচি করত। আশ্রমের অনতিদূরে সানুবাবুর বাড়ি। সানুবাবু (সুশীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়) তখন খড়দহ পুরসভার পুরপ্রধান। চেঁচামিচি শুনে তিনি বুঝতে পারতেন আশ্রমে তেল ফুরিয়েছে। চাকরকে দিয়ে টিন ভর্তি কেরোসিন পাঠালে তবে ছাত্ররা পড়তে বসত। আশ্রমে আয়তন ও বিস্তার যে বেড়েছে তাঁরজন্য স্বামীজিকে কম পরিশ্রম করতে হয়নি। সরকারী বদান্যতা প্রয়োজনের তুলনায় কম, বাকিটা বেসরকারী ভাবে সংগ্রহ করতে হত। উদার হৃদয় অনেক গৃহীভক্ত বালকাশ্রমকে বিভিন্ন সময় নগদ অর্থ ও গৃহদান করেছেন। তাঁদের উদার দানে ধীরে ধীরে বালকাশ্রম উন্নীত হল। নতুন গৃহ উঠল বহু শিক্ষায়তন-প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত।
রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের অন্তর্ভুক্ত শিক্ষায়তনগুলি হলঃ নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক বৃত্তি মূলক শিক্ষায়তন, বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়, ব্রহ্মানন্দ কলেজ অফ এডুকেশন, নিম্ন বুনিয়াদি শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, নিম্ন কারিগরি বিদ্যালয়, বৃত্তিমূলক বিদ্যালয় এবং উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা গ্রন্থাগার-বিঞ্জান শিক্ষণ কেন্দ্র।
বালকাশ্রমে বর্তমানে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পশ্চিমদিকের একতলার ঘরে বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তীর দানে গড়ে উঠেছিল রাজকুমার পাঠাগার। পরে তা স্থানান্তরিত হয়েছে বিবেকানন্দ হলের উত্তরে নিজস্ব ভবনে। আবাসিক ছাত্রদের জন্য এখানে রক্ষিত আছে বহু পুস্তক ও পত্র পত্রিকা।
বালকাশ্রমের অভ্যন্তরে আশ্রমিকদের জন্য রয়েছে পঞ্চাশের অধিক শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল। তাঁর নাম ‘সারদা বিনোদ অরোগ্য ভবন’। ছোটোখাটো অস্ত্রপচার সমেত সাধারণ রোগব্যাধির চিকিৎসা করা হয় এই হাসপাতালে। কয়েকজন বিশিষ্ট চিকিৎসক রুগীর চিকিৎসা করতে এখানে নিয়মিত আসেন। এখানে হোমিওপ্যাথিক বিভাগও রয়েছে। সাধারণের জন্য বালকাশ্রম পরিচালিত দাতব্য চিকিৎসালয় রয়েছে জেলা গ্রন্থাগারের পশ্চিমদিকে আশ্রমের নিজস্ব একতলা দালানে। রয়েছে রোগ নির্ণায়ক একটি প্যাথোলজি ল্যাবরেটরি।
রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা গ্রন্থাগারে বর্তমান বইয়ের সংখ্যা আনুমানিক ৫৫ হাজার। গ্রন্থাগারের নতুন ভবন নির্মিত হবার সময় সেই সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের কিছু বেশি। ১৯৫৭ সালের ২৭ জানুয়ারি গ্রন্থাগারের নতুন ভবনের দ্বারোদঘাটন হয়েছিল। প্রথিতযশা ঐতিহাসিক আচার্য যদুনাথ সরকার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন। গ্রন্থাগারের নতুন ভবন নির্মাণের পূর্বে প্রকৃত উদ্বোধন হয় ১৯৫৬ সালের ৪ জানুয়ারি। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতির পদ অলংকরণ করেন রাজ্য সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তরের প্রধান পরিদর্শক নিখিলরঞ্জন রায়। গ্রন্থাগারের নব নির্মিত ভবন যে জমিটির উপর প্রতিষ্ঠিত তা কেনা হয় ১৯৫৩ সালে। রামকৃষ্ণ মিশনের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক স্বামী মাধবানন্দকে দিয়ে প্রস্তাবিত ভবনের শিলান্যাস করানো হয়। এই গ্রন্থাগারের প্রায় সুচনা লগ্ন থেকেই (১৯৫৬ সালের ২ অক্টোবর) রয়েছে ভ্রাম্যমাণ বিভাগের পরিষেবা যার দরুন এই জেলার কয়েকটি গ্রন্থাগারের পাঠকরা পরোক্ষে জেলা গ্রন্থাগারের নির্বাচিত গ্রন্থ পড়ার সুযোগ পেয়ে আসছেন। ১৯৬২ সাল থেকে এখানে ৬ মাসের সরকারি গ্রন্থাগার শিক্ষণ কোর্স চালু হলেও ১৯৯৭ সাল থেকে তা বন্ধ হয়ে যায়।
স্বামী পুণ্যানন্দের উত্তরাধিকার
১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর রাত ৮টা ১০ মিনিটে কর্মযোগী সন্ন্যাসী ও রহড়া বালকাশ্রমের রূপকার স্বামী পুণ্যানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে স্বামী নিত্যানন্দের কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর বালকাশ্রমে কর্মসচিব নিযুক্ত হলেন তাঁর ভাবশিষ্য স্বামী নিত্যানন্দ। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৪৪ বছর।
১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি স্বামী নিত্যানন্দের জন্ম হয় বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালে। পূর্বাশ্রমের নাম কৃষ্ণকমল চক্রবর্তী, সংক্ষেপে ‘কৃষ্ণ’ এবং জাগতিক প্রয়োগ এ ‘কেষ্ট’। পিতা হরিভূষণ চক্রবর্তী, মাতা মানদাসুন্দরী দেবী। বাবা ছিলেন বৈষ্ণব, বাড়িতে পৃথক ঠাকুর ঘর, গোপালের নিত্য পূজা এবং সকাল-সন্ধ্যায় খোল-করতাল সহযোগে কীর্তন। বর্তমানে তাঁর জন্মভিটা মেঘনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
নিত্যানন্দের বাল্যকালে পড়াশুনা গ্রামের পাঠশালায়। অতঃপর মেদিনীপুরের কাঁথিতে বড়মামার বাড়িতে থেকে ‘গুরু ট্রেনিং স্কুল’ এ ভর্তি এবং বছর খানেক পড়াশুনার পর পুনরায় বরিশালে ফিরে যাওয়া। এরপর হিন্দু মহাসভার শাখা কেন্দ্র কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটে ৮নং শিবনারায়ণ দাস লেনের স্কুলে ভর্তি হলেন। কিছুদিন পর চলে গেলেন হিন্দুমহাসভার খুলনা জেলার সেনহাটি হাইস্কুলে। হিন্দু মহাসভা উঠে গেলে ১৯৪৪ সালের গোড়ায় কলকাতার ১০ নং নলিনী সরকার স্ট্রিটে ড. শ্যামাপ্রসাদ মখোপাধ্যায়ের ব্যবস্থাপনায় স্বামী পুণ্যানন্দের কাছে উপস্থিত হলেন। রহড়া বালকাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হলে কয়েকমাস ঘরে বসেই পড়লেন, পড়ালেন শিক্ষক বিধুভূষণ নন্দ। এর পর এক বছরের জন্য খড়দহ শিবনাথ স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি। রহড়া বালকাশ্রমে জুনিয়ার হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা হলে অষ্টম শ্রেণীতে এক বছর পড়াশুনা। নবম ও দশম শ্রেণী পড়েছেন বারাকপুর সরকারি বিদ্যালয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু বছর পড়াশুনা করে ১৯৫৫-৫৬ সালে মঠে যোগদান করলেন। মঠে যোগদানের পশ্চাতে বিশেষ অনুপ্রেরণা ছিলেন তৎকালীন PGBT কলেজের অধ্যক্ষ ও বারাকপুর সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তামসরঞ্জন রায়। স্বামী পুণ্যানন্দের ভালবাসা আর অনুপ্রেরণাও কম ছিলনা। শৈশবেই তিনি দেবাসুর সংগ্রাম শীর্ষক আধ্যাত্মিক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন।
তাঁর দীক্ষাগুরু ছিলেন সারদাদেবীর মন্ত্রশিষ্য স্বামী বিরজানন্দ। স্বামী মাধবানন্দের কাছে তিনি ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হন। অতঃপর ১৯৬৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের তিথি পুজোর দিন তিনি স্বামী বীরেশ্বরানন্দের কাছে সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের পার্ষদদের পর থেকে যারা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্ঘগুরুর আসনে বসেছিলেন তাঁদের সকলের সঙ্গে ছিল তাঁর সম্পর্ক। শৈশবেও তিনি বহু সাধু-মহাত্মাদের স্নেহ –সাহচর্য লাভ করেছিলেন। শ্রী রামকৃষ্ণের সন্তানদের না দেখলেও শ্রী রামকৃষ্ণকে দেখেছেন ও তাঁর কৃপালাভ করেছেন এমন দুজন ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর বিশেষ যোগাযোগ ছিল। উনারা ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্ত এবং বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের ঠাকুমা তথা প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী ভবতারিনী দেবী, যিনি শ্রীরামকৃষ্ণ কে দুধের সর তুলে খাওয়াতেন। মঠ মিশনের অন্যান্য প্রাচীন ও ভারপ্রাপ্ত সন্ন্যাসীদের মধ্যে তিনি স্বামী বিশুদ্ধানন্দ, স্বামী শান্তানন্দ(খগেন মহারাজ), স্বামী আত্মস্থানন্দ, স্বামী রঙ্গনাথানন্দ, স্বামী গহনানন্দ প্রমুখের স্নেহ আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন।
রহড়া বালকাশ্রমে তিনি ছাত্রজীবন ও সন্ন্যাসজীবন মিলিয়ে মোট ৩২ বছর অতিবাহিত করেন। রহড়া বালকাশ্রমে একসময় তিনি একাধারে কর্মসচিব, বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব সামলেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে যেকোন নির্মাণ কাজে তদারকির করতে দেখা গেছে।আশ্রমের সমস্ত কাজেই ছিল তাঁর সদাসতর্ক দৃষ্টি এবং অমোঘ উপস্থিতি। তারই নেতৃত্বে রহড়া বালকাশ্রমের সৌকর্য আরও বৃদ্ধি পেল। কিন্তু ১৯৭৬ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের আভ্যন্তরীণ গোলযোগে তাঁকে কর্মসচিব পদ থেকে সরে যেতে হল। তিনি মঠ মিশন থেকেই দূরে সরে গেলেন। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে মাত্র ২০টি আদিবাসী অনাথ ছেলেকে নিয়ে ব্যারাকপুরের একটি ভাঙ্গা বাড়িতে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে যে মঠ মিশনের কাজ নূতন উদ্যমে শুরু করেছিলেন কালের গতিতে তা আজ পুষ্প পত্রে পল্লবিত হয়ে উঠেছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘের নাম রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন, যার মূলকেন্দ্র ৭নং রিভার সাইড রোড, বারাকপুর। ‘তত্ত্বমসি’ এই প্রতিষ্ঠানের মাসিক পত্রিকা যা ১৪২০ বঙ্গাব্দে বিংশতি বর্ষে পদার্পণ করেছে। কিন্তু রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন পরিত্যাগ করার কথা তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত ভুলতে পারেন নি।
১৯৭৬ সালে বালকাশ্রমে কর্মসচিব হয়ে এলেন স্বামী রমানন্দ । বিরুদ্ধ প্রতিবেশে কাজ শুরু করলেও তিনি ক্রমে ক্রমে সকল আশ্রমিক ছাত্র ও কর্মীদের মন জয় করে ফেললেন। প্রবল আর্থিক সঙ্কট থেকেও প্রতিষ্ঠানটিকে বের করে আনার অনবদ্য প্রচেষ্টা চালালেন। বর্তমানে তিনি বেনারস রামকৃষ্ণ মিশনে অবসর জীবন যাপন করছেন।
বালকাশ্রমের চতুর্থ তথা বর্তমান কর্মসচিব স্বামী জয়ানন্দ। তাঁর সুযোগ্য তত্ত্বাবধানে রহড়া বালকাশ্রম আজ দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে।
লেখক - Kalyan Chakraborti
তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
"প্রস্তুত প্রবন্ধ রচনার জন্য আমি রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম প্রাক্তন ছাত্র সংসদের সম্পাদক করুনাময় চন্দের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। আমাকে সহযোগিতা করেছেন প্রাক্তন আবাসিক ছাত্র ও বর্তমানে পাতুলিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের সহ-প্রধান শিক্ষক সুভাষ পোদ্দার।"

লেখকের ব্যবহার করা তথ্যসুত্রঃ
১. নিখিলরঞ্জন দে (২০১৩), খড়দহ-রহড়া – অতীত ও বর্তমান,
২. স্বামী নিত্যানন্দ, রহড়া বালকাশ্রমে বত্রিশ বছর (ধারাবাহিক রচনা), ‘তত্ত্বমসি’-র বিবিধ সংখ্যা।
৩. বিধুভূষণ নন্দ (১৯৯৫), রহড়া আশ্রমে দুর্গাপূজা, দিব্যায়ন (প্রাক্তন ছাত্রদের মুখপত্র), পঞ্চমবর্ষ, বিশেষ সংখ্যা।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৪
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×