তারল্য সঙ্কটের প্রভাবে শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি সরকারের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। রেকর্ড দরপতনের কারণে আতঙ্কগস্ত বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যেই দু'দফা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। সরকারের দিক থেকে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর পথে বসার অবস্থা হবে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। সে ধরনের অনাকাঙ্ৰিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে '৯৬ সালের মতো রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হবে শেয়ারবাজার, যা সরকারের সব অর্জনকে মস্নান করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এ কারণে পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে।
সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে ঘন ঘন বড় দরপতনের কারণে সরকারের ভেতরে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বাজারে বড় কোন বিপর্যয় হলে সরকারের ইমেজ ব্যাপকভাবে ৰুণ্ন হবে বলে মনে করছেন তারা। এ কারণে ইতোমধ্যেই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে সংশিস্নষ্টদের তাগিদ দেয়া হয়েছে। ৰুদ্র বিনিয়োগকারীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন_ সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদৰেপ গ্রহণেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করে কোন বিশেষ মহল যাতে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার সুযোগ না পায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সরকারের সংশিস্নষ্ট সকল সংস্থার প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি বৈঠক করেন। অর্থমন্ত্রীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অর্থ সচিব, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান, এসইসি চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিসহ সংশিস্নষ্ট বিভিন্ন সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠকে পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বাজারে বড় ধরনের দরপতনের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে ৰতিগ্রসত্ম না হন সে বিষয়ে পদৰেপ গ্রহণের জন্য সংশিস্নষ্টদের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসির মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ বৃদ্ধির তাগিদ দিয়ে অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পদৰেপ নেয়ার তাগিদ দেন। বাজার এখনও অতিমূল্যায়িত হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যে যাতে বড় কোন সংশোধন না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি কমাতে চায়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে বড় সংশোধন হলে অনেক বিনিয়োগকারী ব্যাপকভাবে ৰতিগ্রসত্ম হবেন। ফলে এমন কোন পদৰেপ নেয়া যাবে না, যাতে পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।
সূত্র আরও জানায়, শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বেশ কয়েকটি কঠোর পদৰেপের কারণে শেয়ারবাজারে অর্থ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে হঠাৎ করে এসইসির কিছু সিদ্ধানত্ম যুক্ত হওয়ায় পুঁজিবাজারে পর পর কয়েক দিন ধস নেমেছে। এসইসির পৰ থেকে ইতোমধ্যেই ওই সব সিদ্ধানত্ম বাতিল করার পাশাপাশি অর্থ সরবরাহ বাড়াতে বেশ কিছু পদৰেপ নেয়া হলেও মন্দা কাটাতে তা যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পদৰেপের কারণে বাজারে যে অর্থ সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, এখনও তা কাটানো সম্ভব হয়নি। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে। এতে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ৰতিগ্রসত্ম হবেন_ যার দায়ভার সরকারের ওপর এসে পড়বে। এ কারণে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় পদৰেপ নেয়া প্রয়োজন।
এদিকে পুঁজিবাজারে বড় কোন বিপর্যয় ঘটলে সরকারের জন্য বড় ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে বিশেস্নষকরা মনে করছেন। কারণ, লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ৰতিগ্রসত্ম হলে পুঁজিবাজার হবে রাজনীতির সবচেয়ে বড় ইসু্য। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, নীতিনির্ধারকরা যথাযথ মনোযোগ না দিলে বর্তমান পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে কোন কোন মহল থেকে পরিকল্পিতভাবে ধস নামিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করা হতে পারে। দুই স্টক এঙ্চেঞ্জে বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের আধিপত্য থাকায় খুব সহজেই এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। বিশেষ করে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে (ডিএসই) বিগত জোট সরকারের আমলে বিএনপি-জামায়াতের প্রথম সারির নেতাদের নামে-বেনামে অনেক সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল। বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অনেকেরই ব্রোকারেজ হাউস রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত বেশ কয়েক নেতাও রয়েছেন। ১৯৯৬ সালের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মহাজোট সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারের মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে শেয়ারবাজারে ধস নামানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) এক প্রভাবশালী সদস্য জানান, শেয়ারবাজার ঘিরে রাজনৈতিক ইসু্য তৈরির জন্য বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা বেশ কিছুদিন ধরেই চিনত্মাভাবনা করছেন। এই সরকারের মেয়াদকালে যে কোন সময়ে তারা পরিকল্পিতভাবে ধস নামাতে পারেন। বর্তমানে এদের ওই পরিকল্পনা বাসত্মবায়নের মতো অনুকূল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরকারের জনপ্রিয়তা ধ্বংস করার জন্য তারা যে কোন সময় বাজারে বিপর্যয় ঘটানোর চেষ্টা করতে পারেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাসত্মবায়নের জন্য ডিএসইর কিছু সদস্য নিজেদের ব্যবসা ধ্বংস করতেও দ্বিধা করবেন না। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এরা সবকিছুই করতে পারেন।
পুঁজিবাজার বিশেস্নষকরা মনে করেন, বর্তমান সরকারের আমলে পুঁজিবাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এখানে বিপুলসংখ্যক বেকারের কর্মসংস্থান হচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে বড় আকারের মূলধন যোগান দেয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু পুরো পরিস্থিতিকে দৰতার সঙ্গে কাজে লাগাতে না পারলে তা সরকারের জন্য দুশ্চিনত্মার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সরকারের ভাবমূর্তি ৰুণ্ন করতে পরিকল্পিতভাবে পুঁজিবাজারে ধস নামানোর চেষ্টা অস্বাভাবিক নয়। এ বিষয়ে সরকারকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
উলেস্নখ্য, মুদ্রাবাজারে অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে গত প্রায় এক মাস ধরে দেশের পুঁজিবাজারে মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নগদ টাকার সঙ্কট থাকায় একদিকে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন না। একই কারণে এসইসি মার্জিন ঋণ সুবিধা বাড়ালেও টাকার অভাবে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো বর্ধিত হারে ঋণ দিতে পারছে না। সব মিলিয়ে শেয়ারবাজারে বড় রকমের তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গত ৫ ডিসেম্বর ডিএসইতে ৩২৫০ কোটি টাকার লেনদেন হলেও মঙ্গলবার তা ১১৫৬ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। গত ১৮ কার্যদিবসে লেনদেনের পরিমাণ একদিনের জন্যও ২ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করতে পারেনি। অথচ সেপ্টেম্বর থেকে নবেম্বর পর্যনত্ম তিন মাস ধরে অধিকাংশ দিনই লেনদেনের পরিমাণ ছিল দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা। নবেম্বরের শেষ সপ্তাহে যেখানে দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ২৭৩৩ কোটি টাকা, সেখানে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন লেনদেন হয়েছে ১৫১৪ কোটি টাকা। এক মাসের ব্যবধানে সপ্তাহের মোট লেনদেনের পরিমাণ কমেছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। অধিকাংশ শেয়ারের দর ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় এক মাসের ব্যবধানে ডিএসই সাধারণ সূচক কমেছে প্রায় ১০০০ পয়েন্ট। সুত্র জনকন্ঠ

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




