পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বর্তমান বাজেটে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত টাকা বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই দেশের দুটি পুঁজিবাজারে আবার দরপতন শুরু হয়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পুঁজিবাজার পরিস্থিতি উন্নয়নে গৃৃহীত সব পদক্ষেপই ব্যর্থ হয়েছে। অস্থিরতার হাত থেকে কোনোভাবেই মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যেই অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী স্থায়িভাবে পুঁজিবাজার- বিমুখ হয়েছেন। অথচ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য ব্রোকারেজ হাউস গজিয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল অসংখ্য নবীন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। যেকোনো অপরিণত পুঁজিবাজারের জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই মূল চালিকাশক্তি। অসংখ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগকৃত টাকাই পুঁজিবাজারের সামগ্রিক বিনিয়োগের উত্স। মনে রাখা আবশ্যক, একজন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী শুধু পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীই নন, তিনি দেশের একজন নাগরিকও বটে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে একজন নাগরিক সরাসরি দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পান। উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখতে সাধারণ জনগণকে সে দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। এই সম্পৃক্ততা যত নিবিড় হবে, অর্থনৈতিক গতিশীলতা তত বেশি শক্তিশালী হবে। আর অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম পুঁজিবাজার বা ঈধঢ়রঃধষ গধত্শবঃ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। একজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সম্পৃক্ত তার পরিবার। কোনো বিনিয়োগকারী যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তার সঙ্গে ওই পরিবারটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবে দেশের একটি বৃহত্ জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বলা হয়েছিল ’৯৬ সালের তুলনায় বর্তমানের পুঁজিবাজার অনেক বেশি পরিণত। প্রথমদিকে দরপতনকে স্বাভাবিক বলা হলেও ক্রমাগত দরপতন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত ও হতাশ করেছে। ইতোমধ্যেই এর প্রভাব আমরা লক্ষ করেছি। গত দুটি ঈদের বাজারে ক্রেতার সংখ্যা যেমন কম ছিল, তেমনি কম ছিল ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণ। আবাসন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও মনে করেন পুঁজিবাজারের খারাপ পরিস্থিতির কারণেই এ খাতে ক্রেতা কমে গেছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাজার অস্থিরতার কারণে নতুন কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে পারছে না। বর্তমানে পুঁজিবাজারের লেনদেন দুই বছর আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। অনেকেই মনে করেন, এর ফলে দেশের অর্থনীতি অনেক পিছিয়ে গেল। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর একটি বড় অংশ ছিল তরুণ প্রজন্মের। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ব্যাপারে তারা ছিল উত্সাহী ও আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে তরুণ প্রজন্মের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। দেশের ভবিষ্যত্ অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অস্থিতিশীল পুঁজিবাজার বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য বড় অন্তরায়।
বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন, শিগগিরই এ বাজার ভালো হবে। সে আশা কি সফল হবে? অনেক তরুণ ও নবীন বিনিয়োগকারী বাজার থেকে স্থায়িভাবে দূরে গেল। কিন্তু আমাদের একটি তরুণ উদ্যোক্তা শ্রেণী দরকার, যারা দেশের শিল্পায়নের বিকাশে এক সময় বড় ভূমিকা রাখবে। শিল্পের বিকাশ ভালোভাবে ঘটলে বেকার সমস্যা অনেকাংশেই দূর হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য পুঁজিবাদের ষড়ষন্ত্র ও জাঁতাকলের নৃশংসতায় আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সব সময়ই ছিটকে পড়েছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই ভবিষ্যত্ বড় উদ্যোক্তা, শিল্পের কারিগর। পুঁজিবাজারের প্রণোদনার ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কখনই সঙ্গে রাখা হয় না। কেন রাখা হয় না? এই প্রশ্নের উত্তর রহস্যের জালে বন্দি। দেশের মন্ত্রীরা ঘোষণা দিয়েই বলেন, তারা পুঁজিবাজার বোঝেন না, এটা অদ্ভুত বাজার। তাই পুঁজিপতিরা সহজেই বাজারের বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার সুযোগ পান। যার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সুকৌশলে উপেক্ষিত থাকে। পুঁজিবাজার বিষয়ে সবাই প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের প্রশংসা করছে। কিন্তু বারবার দাবির মুখেও সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দূরে সরিয়ে রেখে গৃহীত সরকারি সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীর আস্থা কম থাকবে, এটাই স্বভাবিক। এই আস্থাহীনতা শুধু পুঁজিবাজার বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই তৈরি হয়নি, দেশের সার্বিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই আস্থাহীনতার প্রভাব পড়বে।
এ অবস্থায় তরুণ প্রজন্মকে শুধু পুঁজিবাজার নয়, সামগ্রিক বিনিয়োগে উত্সাহী করতে করণীয় সম্পর্কে ভাবতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টি আসবে সেটি হচ্ছে, একটি প্রশিক্ষিত উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি। প্রথমত, তরুণদের বিনিয়োগে উত্সাহিত করতে হবে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, তরুণ উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বৃদ্ধির জন্য পরামর্শ সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে দক্ষ পরামর্শক নিয়োগ দিতে হবে। তৃতীয় হচ্ছে ঋণদান। তরুণ উদ্যোক্তারা টাকার অভাবে অনেক সময় ব্যবসা শুরু করতে পারেন না। অথচ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার মতো সম্পদ ও জামানতও তাদের থাকে না। এর ফলে তারা বিনিয়োগে উত্সাহ হারিয়ে ফেলেন। সরকার থেকে অল্প সুদে ঋণ পেলে অনেক ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তারা উত্সাহিত হবেন। চতুর্থত, একটি ছোট শিল্পের সঙ্গে আরও অনেক পারিপার্শ্বিক বড় শিল্পের সংশ্লিষ্টতা থাকে। সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে যদি ছোট শিল্পগুলোকে সহযোগিতায় উত্সাহিত করা যায়, তবে ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের কার্যক্রম অনেক সহজ হবে।
Click This Link page_id= 74

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




