ক’দিন আগেই আমাদের রেলমন্ত্রী নিজ নির্বাচনী এলাকা সুনামগঞ্জ সফর করে এসেছেন। সেখানে রেল সংযোগ স্থাপনের দাবি সুনামগঞ্জবাসীর। সুনামগঞ্জ জেলাকে অতি কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাই সম্ভাবনাময় এ জেলাটিকে নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা থেকেই যায়। দেশের অধিকাংশ জাতীয় পত্রিকা ছুটির দিনে বিশেষ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে দেশের কোনো একটি অঞ্চলের সম্ভাবনার নতুন কোনো তথ্য তুলে ধরা হয়। একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় কিছুদিন আগে ‘বিশ্বম্ভরপুরে সবুজ শিমের জয়গান’ শিরোনামে তেমন একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের অবহেলিত এবং সুবিধাবঞ্চিত উপজেলাগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা একটি। এ এলাকার মানুষজন নিজেদের ভাগ্যহত বলেই মনে করত। কিন্তু শিম চাষের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রচেষ্টা শুধু সুসংবাদই দেয় না, নতুন আশারও সঞ্চার করে।
সবুজ শিমের জয়গানের পাশাপাশি আরও অনেক সুসংবাদ রয়েছে সুনামগঞ্জে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক সম্পদের আধার হাওর আর বাঁওড়ের সুনামগঞ্জ জেলা অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। একটি প্রবাদ আছে ‘পাথর, মত্স্য, ধান, সুনামগঞ্জের প্রাণ’। কথাটি কতটা সত্য সেটি অল্প কথায় ব্যাখ্যা করা দুরূহ। সুনামগঞ্জের ছাতকের মানুষের সঙ্গে পাথরের সন্ধি অনেক পুরনো। পাথরের উত্স হিসেবে খ্যাত সুনামগঞ্জে রয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় সিমেন্ট কারখানা দেশের সিমেন্ট উত্পাদনে ও চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অর্থনীতিতে যার ভূমিকা ব্যাপক। সুনামগঞ্জের টাকেরঘাটে রয়েছে কয়লা এবং চুনাপাথরের খনি। কিন্তু বিনিয়োগের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ জেলাটি পর্যাপ্ত বিদ্যুত্ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে গুণগত শিল্পের বিকাশ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। গত সরকারের আমলে সুনামগঞ্জের অনেক জায়গায় শুধু বিদ্যুতের পিলার স্থাপন করে রাখা হয়েছে কিন্তু বিদ্যুত্ সংযোগ দেওয়া হয়নি।
সুনামগঞ্জের শান্তিপ্রিয় মানুষের স্বপ্ন খুব বেশি নয়। সুনামগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সুরমা নদী। নদীর অপর তীরে অবস্থিত বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার উত্পাদিত পণ্য দেশের সর্বত্র পৌঁছায় না। তাই উত্পাদিত ফসলের প্রকৃত সুফল তারা পায় না। বন্যাকবলিত এলাকা হওয়ায় সেখানে বছরের অর্ধেক সময় কোনো ফসল উত্পাদন সম্ভব হয় না। যোগাযোগের খারাপ অবস্থার কারণে কৃষক শীতকালীন সবজি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এমনও দেখা গেছে, যে বছর টমেটোর ফলন ভালো হয়, সে বছর মাত্র দুই-তিন টাকা কেজি দরে টমেটো বিক্রি হয়। ক্ষেত থেকে টমেটো তুলে তারপর বাজারে এনে বিক্রি করে কৃষক লাভবান হতে পারে না। তাই অনেক সময় টমেটো কৃষকের ক্ষেতেই পচে নষ্ট হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সুরমা নদীর ওপর নির্মাণাধীন সেতুর কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি সুনামগঞ্জবাসীর। তাহলে নদীর দুই পারের মধ্যে বিদ্যুত্ ও গ্যাস সংযোগ স্থাপনও ত্বরান্বিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সিলেট-সুনামগঞ্জের ৬৮ কিমি রাস্তা জাতীয় মহাসড়কে রূপান্তর করা হলে সুনামগঞ্জের সবজি পৌঁছে যাবে সারা দেশে। বিদ্যুত্ সংযোগ থাকলে সেখানে হিমাগার স্থাপন করে যথাযথ বাজারজাতকরণের মাধ্যমে সবজি সংরক্ষণ সম্ভব।
সুনামগঞ্জের একাধিক হাওরে বছরের বেশিরভাগ সময় থাকে নানা প্রজাতির মাছ। এক নয়নাভিরাম সৌন্দর্যেরও উত্স এই হাওর। শীতকালে আসে নানা প্রজাতির অতিথি পাখি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তখন কল্পনাকেও হার মানায়। টাঙ্গুয়ার হাওরের কথা কম-বেশি সবাই জানে। ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে রামসার স্থান (জধসংধত্ ঝরঃব) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যেটি হতে পারে পর্যটনের অন্যতম ক্ষেত্র। কিন্তু সঠিক পরিচর্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখানকার হাওর-বাঁওড়গুলো হচ্ছে দূষিত। ইজারা আর দখলদারিত্বের জন্য অতিথি পাখির আবাসস্থল টাঙ্গুয়ার হাওর দিন দিন অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার যথাযথ উন্নতি ঘটলে হাওর-বাঁওড় বেষ্টিত সুনামগঞ্জকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কাজও দ্রুত হবে। বিশিষ্টজনদের অভিমত, একটি আদর্শ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে সেখান থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে।
সুনামগঞ্জ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আর প্রাকৃতিক সম্পদেই নয়, বিখ্যাত আর গুণী মানুষদের জন্যও অধিক স্মরণীয়। হাছন রাজার কথা সবাই জানে। কিন্তু সেই হাছন রাজার নামে নেই কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। হাছন রাজার বাড়িটি এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। বাউল আবদুল করিমের গান লোকের মুখে মুখে।
মাসখানেক আগে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ‘যাওয়ার রাস্তা নেই, ঢেউয়ে দেবে যায় স্কুলের ভিটা’ শিরোনামে সুনামগঞ্জের একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদটি থেকে জানা যায় হাওর অঞ্চলের স্কুলগুলোর দুরবস্থা। শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের জন্য সরকারকে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে। বিশেষ বৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি ছোট শিশুদের জন্য স্কুলেই তাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুত্ ও গ্যাস সংযোগ থাকলে পরিকল্পিত শিল্পায়নের বিকাশ ঘটবে, কর্মসংস্থান হবে, মোটরসাইকেলে করে লোক টানতে হবে না। কেটে যাবে অর্থনৈতিক সঙ্কট। সুনামগঞ্জের সুসংবাদ তখনই সুসংবাদ হবে যখন তার সুফল পাবে সমগ্র দেশ। এই সুসংবাদ যেন হয় প্রতিটি দিনের।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




