নীলিমা যেখানে মিশেছে নীলে: বান্দরবানের গহীনে - পর্ব ১
নীলিমা যেখানে মিশেছে নীলে: বান্দরবানের গহীনে - পর্ব ৩
নীলিমা যেখানে মিশেছে নীলে: বান্দরবানের গহীনে - ছবি ব্লগ
বগালেকের পথে অবিশ্বাস্য ট্র্যাকিং
২২ এপ্রিল, ২০১১। কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙলো আমার জামালের ডাকাডাকিতে। সহঅভিযাত্রীদের ঘুম থেকে তুলে দিলাম। তারপর হাতমুখ ধুয়ে সকাল ছয়টার দিকে রুমা বাজারের হোটেল আল মামুনে গিয়ে ডিম ভাজি আর গরম পরোটা দিয়ে নাস্তা সেরেই সাড়ে ছয়টার দিকে পায়ে হেঁটে ট্র্যাকিং করে রওনা হলাম বগা লেকের উদ্দেশ্যে। প্রত্যেকের পরনে টি-শার্ট, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, পায়ে মোজা সহ স্যান্ডেল, পিঠে ব্যাক প্যাকে জামা-কাপড়সহ নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, মাথায় ক্যাপ, পানির বোতল আর হাতে বাঁশের লাঠি।
অভিযাত্রীরা ট্র্যাকিং করে রওনা হলাম
শুরুতে কিছুটা অসমতল উঁচু রাস্তা ধরে আমরা উঠলাম। অল্প কিছুদূর যাবার পরেই হাঁপিয়ে গেলাম। রাস্তার পাশের একটা দোকানে কাঠের বেঞ্চের উপর বসতে না বসতেই তৌফিক আর সালেহ বললো এভাবে ট্র্যাকিং করে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
পাহাড় বেয়ে উঠছি অভিযাত্রীরা
সিদ্ধান্ত হলো, ওরা রুমা বাজারে ফিরে গিয়ে চান্দের গাড়ি ধরে বগালেক যাবার চেষ্টা করবে। আর যদি একান্তই গাড়ি না পায়, তাহলে রুমাতেই থেকে যাবে। আর আমি এবং জামাল ট্র্যাকিং করে বগালেক পর্যন্ত যাব। রুমা বাজার থেকে বগা পর্যন্ত প্রায় ১৮ কি.মি. রাস্তা। টানা হেঁটে যেতে সময় লাগে ৭-৮ ঘন্টা। চান্দের গাড়িতেও জনপ্রতি ৭০ টাকা করে যাওয়া যায়। আর রিজার্ভে ২০০০ টাকা পড়ে। গাড়ির রাস্তা খুবই খারাপ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। সারাদিনে অল্পসংখ্যক চান্দেরগাড়ি আসা-যাওয়া করে। বর্ষার সময় এই গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। আর অন্য সময় দু’একটা দুর্ঘটনার খবর হয়তো আমাদের শহুরে মানুষদের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায়না।
সামনে গাইড জামাল, ওই উপত্যকায় নামবো আমরা
তৌফিকদেরকে রেখে আমি আর জামাল হাঁটা শুরু করলাম। তখনও বুঝতে পারিনি যে, সামনে কতটা কষ্ট আর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। আবহাওয়া চমৎকার। দ্রুত পা চালালাম আমরা। রোদ ওঠার আগেই যদি বেশ কিছুটা এগুনো যায়। পাহাড় বেয়ে বেশ খানিকটা উঠলাম। এবার ঢাল বেয়ে নামতে হবে। পাহাড় বেয়ে ওঠাটা কষ্টকর কিন্তু পাহাড়ের ঢাল থেকে নিচের দিকে নামাটা ভয়ঙ্কর। সংকীর্ণ রাস্তা, যেখানে কোন ধাপ নেই। খুব ধীরে ধীরে বাঁশের উপর ভর দিয়ে জামালের সহযোগীতায় নিচের উপত্যকায় নামলাম। নেমেই দেখি পাহাড়ী ঝিরি। গলা শুকিয়ে কাঠ আমার । সঙ্গে থাকা এক লিটারের মাম-এর খালি বোতলে ঝিরির ঠাণ্ডা পানি ভরে নিয়ে পিপাসা মিটালাম।
জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দিয়ে গাছ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে
তারপর আবার শুরু হলো পথ চলা। সঙ্গে থাকা ডিজিটাল ক্যামেরা যেদিকেই তাক করি, অসাধারণ সব ছবি উঠে যাচ্ছে। জামালের সাথে গল্প করতে করতে এগুচ্ছি আমি। পথে দেখা হলো নল দাদার সাথে। নল দা একজন পাহাড়ী, বম গোত্রভুক্ত। তিনিও আমাদের মতোই হেঁটে রুমা থেকে বগা পর্যন্ত যাচ্ছেন। এই নলদা এবং জামাল না থাকলে হয়তো আমি এই দীর্ঘ পথ একা পাড়ি কোনদিনই দিতে পারতাম না।
পাথুরে রাস্তায় ট্র্যাকিং করে পথ চলছি আমরা
দু'’পাশে পাহাড়। মাঝখানের উপত্যকা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমরা। কখনও ঝিরি পার হচ্ছি, কখনও বা বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। নল দা' বললেন, এই বনে কোন পশুপাখি নেই। কিন্তু কিছু দূর যাবার পরেই হঠাৎ সামনে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া জামাল চিৎকার করে আমাকে বললো, '”লাঠিটা দ্যান'”। আমি তাকিয়ে দেখলাম প্রায় এক ফুট লম্বা একটা সাপ রাস্তার ধারের ঝোপে লুকিয়ে পড়লো। পরে অবশ্য জামাল আর সাপটাকে খুঁজে পেলনা। জামালের থেকেই জানলাম, এই সাপের নাম ’'ওরখাবোলা'’। খুব একটা কামড়ায়না মানুষকে। তবে উড়ে উড়ে চলে। কিছু দূর যাবার পর জামাল আবার হাতের লাঠিটা দিয়ে গিরগিটির মতো একটা প্রাণীকে মারার চেষ্টা করলো। এটার নাম 'লোয়াফেনি রক্তচোষা'।
পাহাড়ে চাষ হচ্ছে তামাক গাছ, দূরের ওই বাড়িতে পোড়ানো হয় পাতা
চলার পথে প্রথম বিরতি নিলাম বৃদ্ধ মারমা দোকানদার কেয়ালা-উহ্ -এর ছোট ছন দেয়া ঘরের দোকানটিতে। বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা শুরু হলো। এবার লক্ষ করলাম, বড় বড় পাথর। ক্রমশ:ই রাস্তা কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগলো।
বৃদ্ধ মারমা দোকানদার কেয়ালা-উহ্
চলার পথের পাথুরে রাস্তা
দ্বিতীয় বিরতি নিলাম 'বগার মুখ' বলে একটি জায়গায়। স্থানীয় পাহাড়ীর দোকানে ঝিরির ঠাণ্ডা পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে পাহাড়ী পেঁপে, কলা আর সাথে নিয়ে যাওয়া বিস্কুট খেলাম তৃপ্তি সহকারে। খাওয়া শেষে তার হাতে বানানো চা অমৃত বলে মনে হলো।
উপত্যকা ছেড়ে ধীরে ধীরে আমরা ঝিরি পথ পার হয়ে গহীন বনে ঢুকলাম। চারিদিকে ঝিঝি পোকার মতো সিজন পোকার করাত কাটার মতো কর্কশ আওয়াজ। বনের ভেতরে আমরা তিনটি প্রাণী বড় বড় পাথরের রাস্তায় ধীর গতিতে এগুচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম একটা জায়গায় জামাল পাথরের খাঁজে জমে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার দৃষ্টি খাঁজের পানির ভেতরে নড়তে থাকা চিংড়ী মাছের দিকে। তারপর নল দা' আর জামাল মিলে পাথরের খাঁজের ভেতরের জমে থাকা পানির মধ্যে থেকে ইচা মাছ (চিংড়ী) ধরা শুরু করলো। আমিও হাত লাগালাম। একটা খাঁজে ইচা ধরা শেষ হলে আবার হাঁটা শুরু। আবার পরের খাঁজ গুলোতে সতর্ক চোখে খোঁজ করা কোন ইচা নড়ে কিনা। ইচা ধরা যেন একটা খেলা হয়ে গেল আমাদের।
পাথুরে রাস্তায় এগিয়ে চলেছি আমরা
উপত্যকার আঁকাবাঁকা পথ, পাশেই ঝিরি
ওই যে একটা ইচা নড়ে। সাবধানে নল দা', যেন ফসকে না যায়!
একটা সময় আমরা পৌঁছে গেলাম ন্রেসা ঝর্ণার কাছে। ঘড়িতে তখন প্রায় বারোটা বাজে। বনে ভেতরে গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের কড়া রোদ মাটিতে ঠিকরে পড়ছে। ঝর্ণার সামনের যে গভীর জায়গাটায় পানি জমেছে, সেখানে বিশাল আকৃতির নাম না জানা মাছ দেখলাম। ওখানেই নল দা’' দুপুরের গোসল সারলেন। এরপর আবার আমাদের কঠিন পথ চলা শুরু হলো। সত্যিকার অর্থে ন্রেসা ঝর্ণার পর থেকেই দুর্গম পাহাড়ে ওঠার শুরু। এবারের রাস্তা সব থেকে দুর্গম এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এই প্রথমবার আমার মনে হলো, আমি হয়তোবা পাহাড় বেয়ে আরও প্রায় দু’ ঘন্টা উঠতে পারবোনা। প্রসঙ্গত: জানিয়ে রাখছি, যাদের পাহাড়ে ওঠার অভ্যাস নেই কিংবা এতটা পথ হেঁটে পাড়ি দেবার ধৈর্য্য এবং সাহস নেই, ভুলক্রমেও তারা ট্র্যাকিং করে রুমা থেকে বগা যাবার কথা ভাববেন না।
ন্রেসা ঝর্ণার মুখে
নল দা' গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন
পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম। একধারে গভীর খাদ। পা একটু পিছলালেই সোজা নিচে চলে যাবো। আমার মনে হচ্ছিলো পা দুইটা ছিড়ে যাবে। শরীর আর চলছিলনা। নল দা' সাহস দিলেন আমাকে। তার হাত ধরে উঠতে লাগলাম পাহাড় বেয়ে। এক একটা ধাপ মনে হচ্ছিল এক এক মাইল। এভাবে চলতে চলতে একটা সময় শরীরের সবটুকু শক্তি প্রয়োগ করে পাহাড়ের শেষ ধাপটাতে উঠেই হাতের একটু ডান দিকে চোখে পড়লো নয়নাভিরাম বগালেক। বার বার তাকিয়ে দেখলাম। মন যেন ভরেইনা।
প্রথম দেখা বগালেকের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়লাম আমি
অপরূপা বগালেক
বগালেকের ইতিহাস
বগা, তুমি এ্যাত সুন্দর কেন?
সীমাহীন ক্লান্তি নিয়ে আরও বেশ কিছুটা পথ চলতে হলো সিয়াম দিদির দোতালা কাঠের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে। তৌফিক আর সালেহ রুমা থেকে চান্দের গাড়িতে করে দুপুর বারোটায় পৌঁছে গিয়েছে। ওরাই আমাকে অভ্যর্থনা জানালো। পিঠের ব্যাক প্যাক আর হাতের লাঠিটা ফেলে কোন মতে হাত মুখ ধুয়ে সিয়াম দিদির দেয়া মোটা লাল চালের ভাত, আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজির উপরে হামলে পড়লাম। ঘড়িতে তখন দুপুর দু'’টা বাজে।
সিয়াম দিদির বাড়ির কাছে
সিয়াম দিদির কুকুরগুলো
পুরো শরীর আমার ব্যাথা। পেইন কিলার খেয়ে নিলাম। তারপর গাইড জামালসহ গেলাম আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে। দায়িত্বরত বাংলাদেশ আর্মির সদস্য জনাব আমির আমাদের নাম, ঠিকানা লিখলেন। তিনি জানালেন, এই এলাকায় বিদেশীদের আসতে হলে নিজ নিজ দূতাবাস থেকে আগে থেকেই অনুমতি নিয়ে আসতে হয়।
আমিরের সাথে গল্প করতে করতে রুমা থেকে আসা আর্মি মেডিকেল কোরের ক্যাপ্টেন নাগিবের সাথে দেখা হয়ে গেল। কথায় কথায় জানা গেল, আমাদের বেশ কিছু কাছের পরিচিত মানুষদেরকে তিনিও বেশ ভালভাবেই চেনেন। এরপর ঢাকা থেকে আসা তার এগারোজন বন্ধুর সাথেও আমরা পরিচিত হলাম। এদের অনেকেই আবার আমাদের পূর্ব পরিচিত। এভাবেই আড্ডাটা জমে উঠলো। রাতে একসাথে খেলাম সবাই মিলে। একটা কথা এই ফাঁকে বলে নেই, মুখে দাড়ি ভর্তি এক অপরিচিত লোককে দেখলাম আর্মির লোকজন ঘিরে রেখেছে। সে চুপচাপ একটা গাছের নিচে শুয়ে আছে। কেউ বলছে সে পাগল, আবার কেউ বলছে ভারতীয় লোক, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে হয়তো নিয়ম বহির্ভূত কোন কার্যকলাপের উদ্দেশ্যে।
পরের দিন আমাদের তিন অভিযাত্রীর গন্তব্য বগালেক থেকে কেওক্রাডং ট্র্যাকিং করে যাওয়া। এবার তৌফিক আর সালেহ জানালো, তারাও ট্র্যাকিং করবে আমার সাথে। সারা শরীরে ভালো করে মশা তাড়ানোর ক্রিম ওডোমোস মেখে সিয়াম দিদির বাড়ির দ্বিতীয় তলায় কাঠের পাটাতনে বিছানো ম্যাট্রেসে শুয়ে পড়তেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১১ রাত ৯:১৮