ভূমি কমিশন আইনের ১৩টি ধারা সংশোধন হচ্ছে
সরকারের কর্তৃত্ব ও সাংবিধানিক অধিকারকে খণ্ডন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারাসহ ১৩টি ধারায় সংশোধনী আনা হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কমিশন চেয়ারম্যানের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে। এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো প্রস্তাবনার ওপর সিদ্ধান্ত নিতে বুধবার ভূমি মন্ত্রণালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা আহ্বান করা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে তার অনেকগুলো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যা মেনে নেয়া হলে তিন পার্বত্য জেলায় সরকারের এখতিয়ার ও দেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী সোমবার যুগান্তরকে বলেন, আইন সংশোধনের বিষয়টি তিনি জানেন না। বুধবার বৈঠক ডাকা হলেও এখন পর্যন্ত তাকে কিছুই জানানো হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে তার কোন মতামত নেয়া হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ অঞ্চলের ভূমি জরিপ না হওয়া পর্যন্ত ভূমি নিয়ে জটিলতা দূর হবে না। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথমে এ বিষয়ে কাজ শুরু করলেও বাস্তবে তা গতি পায়নি। মহলবিশেষের অসহযোগিতার কারণে ভূমি জরিপ হচ্ছে না। থলের বিড়াল বের হয়ে যাবে বলে স্বার্থান্বেষী মহল জরিপ কাজ হতে দিচ্ছে না। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, কমিশন বাস্তবে তার কাজ যথাযথ করতে পারছে না। শিগগির তিনি এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা যুগান্তরকে বলেন, ভূমি কমিশন আইন সংশোধনে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবনাটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও তিনি দেখে দিয়েছেন। বুধবারের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি যোগ দেবেন। সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রণীত হয় ২০০১ সালে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের সংশোধন প্রস্তাব বিল আকারে খসড়া প্রস্তুত করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এখন ভূমি মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করে মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে সংসদে পেশ করবে। সংশোধন প্রস্তাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সংশোধনী আনা হচ্ছে আইনের ৬(১) এর ‘ক’ ও ‘গ’ ধারায়। ‘ক’ ধারায় বলা আছে, পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হবে। সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও অবৈধভাবে বন্দোবস্ত, বেদখল হওয়া জায়গাজমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিল করাসহ সব ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হবে। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, এ ধরনের সংশোধন প্রস্তাব মেনে নিলে সরকারের এখতিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কেননা, মৌলিক অর্থে দেশের সব জমির মালিক সরকার। এখানে অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া জায়গাজমি এবং পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিল করার বিষয়টি শান্তি চুক্তির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। সরকার কোন অবৈধ বন্দোবস্ত দেয়নি। তারা এ সংশোধন প্রস্তাবের পক্ষে শান্তি চুক্তির ৪ অনুচ্ছেদের যে উদ্ধৃতি দিয়েছে সেখানে এভাবে বলা নেই। শুধু বলা আছে, শরণার্থীদের জমিজমা ছাড়াও অন্য সব ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করবে। এর মানে এই নয় যে, সরকার যে সব জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে তা অবৈধ এবং বাতিল করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলÑ পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব সরকার ছাড়া আর কারও হতে পারে না। অথচ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিল করতে হবে। কর্মকর্তারা বলেন, শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী শুধু যেসব শরণার্থী পরিবার (১২ হাজার ২২২টি) চুক্তির আওতায় ১৯৯৬-৯৭ সালে ২০ দফা প্যাকেজে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ফিরে এসেছে তাদের বেহাত হওয়া জমিজমা ফেরত দেবে। কিন্তু সংশোধন প্রস্তাবে কৌশলে তিন পার্বত্য জেলার সব উপজাতি গোষ্ঠীকে এর আওতায় আনা হচ্ছে। এটা কোন দিনই সম্ভব না। ফিরে আসা শরণার্থী পরিবারসহ সরকার যে সব বাঙালিকে জমি বরাদ্দ দিয়েছে তার বৈধ। তারাও এদেশের নাগরিক। তিন পার্বত্য জেলার জমি কোন বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত নেই। নাগরিক অধিকার সবার ক্ষেত্রে সমান। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের ৬(১)গ ধারায় বলা আছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনবহির্ভূতভাবে কোন জমি বন্দোবস্ত দেয়া হলে তা বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি থেকে বেদখল হয়ে থাকলে তার দখল পুনর্বহাল করতে হবে। তবে শর্ত থাকে যে, প্রযোজ্য আইনের অধীনে অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পকারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে ভূমির ক্ষেত্রে উল্লিখিত উপধারা প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু এ ধারায় এখন সংশোধন প্রস্তাব এনে গুরুত্বপূর্ণ এ শর্তটি তুলে দিয়ে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে ফ্রিজল্যান্ডসহ (জলেভাসা জমি) কোন ভূমি বন্দোবস্ত দেয়া কিংবা বেদখল হয়ে থাকলে তা বাতিল করতে হবে এবং বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি থেকে বেদখল হয়ে থাকলে তার দখল পুনর্বহাল করতে হবে। এ সংশোধন প্রস্তাবটি শুধু অযৌক্তিক নয়, বেআইনি। প্রস্তাবটি সরকারের সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণœ করেছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেন, এখানে ফ্রিজল্যান্ড বলতে কাপ্তাই লেকের জমিকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু সরকার কখনও লেকের জমির মালিকানা কোন ব্যক্তিকে দেবে না। আর শর্ত তুলে দেয়া মানে সরকারের অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পকারখানা সব পাহাড়িকে মালিকানায় দিয়ে দিতে হবে? একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ক্ষেত্রে এমনটা চিন্তার মধ্যে আনাও আইনবিরুদ্ধ উদ্যোগ। কর্মকর্তারা বলেন, জরিপে যদি প্রমাণিত হয় অধিগ্রহণ করা জমির মূল মালিককে প্রকৃত ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি তাহলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু বিদ্যমান আইনের শর্ত তুলে দেয়া হলে এ অঞ্চলে সরকারের এখতিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
প্রস্তাবিত সংশোধনীর ৭(৫) ধারা সংশোধন করে ভূমি কমিশন চেয়ারম্যানের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে। এ ধারায় বিদ্যমান আইনে বলা আছে, চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে ৬(১) এ বর্ণিত বিষয়াদিসহ এর এখতিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে চেয়ারম্যানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে। এছাড়া ২১ ধারা নামে আইনে নতুন একটি ধারা সন্নিবেশিত করে বলা হয়েছে, কমিশনের কার্যাবলী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত হবে এবং এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বলবৎ হবে। সূত্র জানায়, বর্তমানে কমিশন এক অর্থে কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। কমিশনের কার্যপরিধি ঠিক করে সরকার কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। তবে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে কমিশনের যাবতীয় লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া হয়। এখন কমিশনকে অকার্যকর করতে এর নিয়ন্ত্রণ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অধীনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে করে সরকারের ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। ৭(৩) ধারায় কমিশন বৈঠকের কোরাম পূর্ণ হওয়ার জন্য বর্তমানে দু’সদস্যের উপস্থিত থাকার পরিবর্তে তিন সদস্য থাকার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সব চাকরিতে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার দিয়ে ১৩ (৩) ধারা নামে নতুন একটি ধারা সংযোজন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রস্তাবে শব্দগত কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। যেমন আইনের ৩(২) এর ঘ’তে বলা হয়েছে, সার্কেল চিফ বা সার্কেল চিফ কর্তৃক মনোনীত একজন প্রতিনিধি। বর্তমানে শুধু সংশ্লিষ্ট সার্কেল চিফের কথা উল্লেখ রয়েছে। ৬(১) খ’তে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী। এ ধারায় পদ্ধতি শব্দটি যুক্ত হয়েছে।
সূত্র: Click This Link
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিকমিশন আইন সংশোধনের নামে সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বিজয়ের কবিতা

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর, লক্ষ প্রাণে লেখা বিজয়ের
সেই সোনালি অক্ষর,
দিকে দিকে শুনি জয়ধ্বনি বাংলাদেশের নামে, এই
স্বাধীনতা কেনা রক্তের দামে;
হৃদয়ে হৃদয়ে বাজে মুক্তির শত গান, ডিসেম্বরে
পেয়েছি আমরা বিজয়ীর সম্মান;
মার্চের সেই অমর... ...বাকিটুকু পড়ুন
বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...
বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।
১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।