somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সে এবং রুশ মেয়েটি

১৪ ই অক্টোবর, ২০১০ সকাল ১১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘‘মেয়েটির নাম আমি জানতাম না৷ আমার সঙ্গে পরিচয়ও ছিল না৷’’- বলেই থামলো অমি৷
অমি আমাকে গল্প বলে৷ ওর জীবনের নানা গল্প৷শুরার পাত্রে চুমুক দিতে দিতে আমি সেই গল্প শুনে যাই৷ শুরা মহলের তীব্র ঝলমলে আলোয় (এখানকার বারে বেশ আলো থাকে৷ বাংলাদেশের সাকুরা বা অন্য বারগুলোতে যেমন অন্ধকারে ভরা থাকে এখানে ঠিক তার উল্টো) আমি গল্প শুনি৷ অমির গল্প৷

‘‘ওর নাম জেনেছি অনেক পরে৷ তাতায়ানা৷ বন শহরে এক রুমের স্টুডিও এপার্টমেন্টে তখন থাকি৷ একা৷ বাংলাদেশ থেকে এসেছি কিছুদিন হলো৷ কেবল বাড়ির কথা মনে পড়ে৷ ঢাকার কথা মনে পড়ে৷ মনে পড়ে আড্ডার কথা৷ মুখ ভার করে বসে থাকি ছুটির দিনে৷ বন্ধু-বান্ধব বিশেষ কেউ নেই এই শহরে, তাই একা একা ঘুরে বেড়াতে আর কাহাতক ভালো লাগে৷ সে সময় আমার একমাত্র কাজ বাসায় ফিরে নানা ধরণের রান্না করা৷ এটা ওটা রান্না করি, আর খাই৷ ভালোই লাগে!
একদিন এমনি রান্না করছিলাম৷ বাঙালি রান্না মানেই তো নানা মশলাপাতি৷ এক রুমের ঘর৷ ফলে প্রথমে জানালা খুলে দিই৷ তাতেও গন্ধ (আমার কাছে সুগন্ধ) দুর হয় না, তাই খুলে দিই দরজা৷ ঐ দিন আমার একই ফ্লোরে থাকা চশমা পরা মেয়েটি এসে খোলা দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ভাঙা ভাঙা জার্মানে বললো
: তুমি কি রান্না করছো?
: হ্যাঁ৷
: দারুণ গন্ধ৷ আমাদের খাবারে এমনটা হয় না৷ শুনেছি ভারতীয়রা নাকি বেশ মশলা খায়৷ তোমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে৷
: আমি ভারতীয় নই৷ বাংলাদেশি৷ বাঙালি৷
: দুঃখিত৷ আমি বুঝতে পারিনি৷
: না না ঠিক আছে৷ এই ভুল প্রায় সকলেই করে৷ তুমিও সকলের মধ্যে একজন৷ তা তুমি কি আমার করা রান্না একটু চেখে দেখতে চাও?
আমার আহ্বানে অনেকটা লাজশরমে লাল হয়ে মেয়েটি হ্যাঁ বললো৷ রান্না করছিলাম গরুর মাংস৷ বেশ আদা রসুন আর মশলাপাতি দিয়ে ঠেসে কষাচ্ছিলাম৷ কষানো মাংসের কয়েক টুকরো একটা ছোট্ট বাটিতে তুলে দিয়ে বললাম
: চেখে দেখো৷
মেয়েটি খেতে খেতেই সার্টিফিকেট দিয়ে দিল৷ এ প্লাস৷ সঙ্গে ঝালে লেটার মার্ক৷
আমি জানালাম, আমরা এমনই খাই৷
খেতে খেতে নিজের নাম বললো মেয়েটি৷ রাশিয়া থেকে এসেছে৷ পড়ালেখা করছে৷
আমাদের এই ডর্মিটরিটা আজব৷ নানা পেশার মানুষ থাকে৷ বদ্ধ এক উন্মাদও থাকে৷ যে সারাক্ষণ বই পড়ে৷ আর অবসরে করে গালাগালি৷ আমরা লোকটিকে যতটা পারি এড়িয়ে চলি৷ কখন যে গালি দিয়ে বসে!
তাতায়ানা চেয়ারে বসে খেতে খেতে বললো
: আচ্ছা তোমাদের দেশেও কি তোমরা নিজেরাই রান্না করো? মানে ছেলেরা?
: না করিনা৷ ছোট সময় মায়ের হোটেলে, বিয়ের আগে কিছুটা নিজের হোটেলে, কিছুটা বুয়ার হোটেলে৷ আর বিয়ের পর স্ত্রীর হোটেলে৷
: তাহলে তোমরা সকলে হোটেল ব্যবসা করো৷ তাই তো বলি লন্ডনে এত ভালো কারি কি করে রান্না করে বাংলাদেশের মানুষ!
আমি তো এই মেয়ের কথা শুনে অবাক৷ বললাম কি, আর বুঝলো কি!
ওকে বুঝিয়ে বললাম৷ শুনে মেয়েটিতো হেসেই কুটিকুটি৷
সেবার জানলাম ওর প্রেমিকের কথা৷ ছেলেটি বেশ ভালো৷ ওকে খুব ভালোবাসে৷ ওকে পাস্তা রান্না করে খাওয়ায়৷ জিজ্ঞাস করলাম, তার প্রেমিক ইতালির কিনা? প্রশ্নের উত্তরে বললো তুমি একটা বুদ্ধু৷ ইতালি হলেই পাস্তা খাবে, আর কেউ খাবে না!
ছেলেটি জর্জিয়ার৷
ওই পর্যন্তই এগুলো৷ নিজে খাবারের বাসনটি ধুয়ে দিয়ে গেলো৷ আর যাবার আগে সোনালি চুলের তাতায়ানাকে দেখলাম.. মুখ লাল, যেন একটু টোকা লাগলেই রক্ত টুপ করে নিচে পড়বে৷ (আমি টোকা দিইনি)৷

এরপর সপ্তাহে দুই একবার কড়িডোরে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে৷ হাই হ্যালো হয়েছে৷ মেয়েটির প্রেমিককেও দেখেছি৷ দুজনে হাতে হাত ধরে হয়তো কোন পথে ঘুরে বেড়াতে৷ এদেরকে আমার বেশ ভালো লেগেছে৷ হিংসে হয়নি যে, তা কিন্তু বলছি না৷
বেশ কয়েকটি ট্রেনিং, আন্তর্জাতিক ওয়ার্কশপ আর অ্যাসাইমেন্টে জার্মানির বাইরে থাকতে হয়েছে কয়েক মাস৷ আজ এখানে থাকো তো কাল সেখানে যাও- এমন অবস্থা৷ বনে থাকলে খুব ভোরে বের হও, আর ফিরো অনেক রাতে৷ অদ্ভুত একটা সময় গিয়েছে৷
তাতায়ানার দেখা পাইনি৷ বারবার ভেবেছি ওকে যদি একবার দেখতে পেতাম৷ কেন ভেবেছি জানি না৷ মেয়েটির মধ্যে একটা সারল্য দেখেছি৷ ওর প্রেমিক আছে তো কি হয়েছে, থোরাই কেয়ার৷ তবুও দেখা হয় না৷
এরও মাস খানিক পর এক উইকএন্ডের বিকালে আমি ফিরতেই দেখি কড়িডোরে এক ছেলের সঙ্গে বেশ রাগত গলায় কথা বলছে তাতায়ানা৷ আমি হ্যালো বলতেও সাহস করলাম না৷

এর কয়েকদিন পর তাতায়ানাকে আবার দেখলাম৷ এবার কথা হলো৷ অনেক কথা৷ আমি বললাম, চলো আজ খাবে৷ মেয়েটি রাজি হলো না৷ আমি পরে খাওয়াবো বললাম৷ মেয়েটি কিছু বললো না৷ সে তার প্রেমিকের কথা কিছু বললো না৷ তবে জানালো কয়েকদিন আগে কড়িডোরে দেখা ছেলেটি তাকে খুব জ্বালাচ্ছে৷ ছেলেটি স্পেনিশ৷ ওদের এক ক্লাশ উপরে পড়ে৷ চাইলে সে পুলিশকে জানাতে পারে৷ জানাতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়কে৷ কিন্তু ও এই সব করতে চায় না৷ হঠাৎ সে আমাকে জিজ্ঞাস করলো..
: অমি, তোমাদের দেশের মেয়েদেরও কি এভাবে ত্যক্ত করা হয়? আমি অকপটে বলে দিলাম৷ ও বললো, পুলিশ নেই৷ পুলিশকে বললে তো ঠেঙ্গাবে!
আমি বললাম, এসব আমাদের দেশে সাধারণত পুলিশের কাছে যেতে চায়না অনেকে৷ পুলিশকে বললে ঝামেলা আরও বেড়ে যায়৷ উল্টো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি৷
দীর্ঘশ্বাস ছাঁড়লো তাতায়ানা৷ বললো, স্পেনিশ ছেলেটির বিষয়ে তাকে কিছু একটা করতে হবে৷ আমি আর দাঁড়ালাম না৷ বুকের ভেতরের কথা, সেখানেই রয়ে গেলো৷ তাতায়ানাকে আর বলাও হলো না৷
**********************
নাইট ডিউটি ছিল৷ রাতে কাজ সেরে বাসার কাছে পৌঁছালাম ভোরে৷ শনিবার সকাল৷ এক সপ্তাহের নাইট শেষ৷ আহা....শান্তি৷ ডর্মিটরির সদর দরজার আগে কয়েক ধাপ সিঁড়ি৷ একটু দুর থেকে দেখালাম সেখানে লাল গোলাপ ফুল, সঙ্গে বড় বড় ডাটা৷ তাজা৷ কে রেখেছে রে ভাই! কাছে যেতেই দেখলাম প্রতিটি ফুলের সঙ্গে একটি কাগজ লেখা৷ তাতে লেখা তাতায়ানা, তাতায়ানা....৷ ইশ লিবে ডিশ৷ মানে আমি তোমাকে ভালোবাসি, জার্মানে৷ কেবল সিঁড়িতে হতো; এই ফুল বিছিয়ে দেয়া হয়েছে একেবারে লিফটের গোড়া অবধি৷ ফুলকে পাশ কাটিয়ে লিফটে চড়তেই দেখলাম সেখানেও একই গোলাপকান্ড৷ দারুণ! ঘরে গিয়ে বসতেই চিন্তা এলো আচ্ছা এর ছবি তুললে কেমন হয়? দারুণ হবে৷ যা ভাবা তাই কাজ৷ ক্যামেরা বের করে দ্রুত লিফটের কাছে৷ বোতাম চাপার পর কয়েক মিনিট৷ তারপর লিফটের দরজা খুলে যেতেই তাকিয়ে অবাক৷ কি হলো? ফুলগুলো নেই! নিচে নেমে এলাম৷ লিফট থেকে নামতেই সামনে তাতায়ানা৷ ফুল কুঁড়োচ্ছে৷ আঁটি বাঁধছে৷ আর আমাকে দেখে এক রহস্যময় হাসি মুখে এঁকে বললো
: ল্যুবটা যা করে না!

ল্যুব সেই স্পেনিশ ছেলেটির নাম৷’’



সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১০ সকাল ১০:১৫
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×