অমি আমাকে গল্প বলে৷ ওর জীবনের নানা গল্প৷শুরার পাত্রে চুমুক দিতে দিতে আমি সেই গল্প শুনে যাই৷ শুরা মহলের তীব্র ঝলমলে আলোয় (এখানকার বারে বেশ আলো থাকে৷ বাংলাদেশের সাকুরা বা অন্য বারগুলোতে যেমন অন্ধকারে ভরা থাকে এখানে ঠিক তার উল্টো) আমি গল্প শুনি৷ অমির গল্প৷
‘‘ওর নাম জেনেছি অনেক পরে৷ তাতায়ানা৷ বন শহরে এক রুমের স্টুডিও এপার্টমেন্টে তখন থাকি৷ একা৷ বাংলাদেশ থেকে এসেছি কিছুদিন হলো৷ কেবল বাড়ির কথা মনে পড়ে৷ ঢাকার কথা মনে পড়ে৷ মনে পড়ে আড্ডার কথা৷ মুখ ভার করে বসে থাকি ছুটির দিনে৷ বন্ধু-বান্ধব বিশেষ কেউ নেই এই শহরে, তাই একা একা ঘুরে বেড়াতে আর কাহাতক ভালো লাগে৷ সে সময় আমার একমাত্র কাজ বাসায় ফিরে নানা ধরণের রান্না করা৷ এটা ওটা রান্না করি, আর খাই৷ ভালোই লাগে!
একদিন এমনি রান্না করছিলাম৷ বাঙালি রান্না মানেই তো নানা মশলাপাতি৷ এক রুমের ঘর৷ ফলে প্রথমে জানালা খুলে দিই৷ তাতেও গন্ধ (আমার কাছে সুগন্ধ) দুর হয় না, তাই খুলে দিই দরজা৷ ঐ দিন আমার একই ফ্লোরে থাকা চশমা পরা মেয়েটি এসে খোলা দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ভাঙা ভাঙা জার্মানে বললো
: তুমি কি রান্না করছো?
: হ্যাঁ৷
: দারুণ গন্ধ৷ আমাদের খাবারে এমনটা হয় না৷ শুনেছি ভারতীয়রা নাকি বেশ মশলা খায়৷ তোমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে৷
: আমি ভারতীয় নই৷ বাংলাদেশি৷ বাঙালি৷
: দুঃখিত৷ আমি বুঝতে পারিনি৷
: না না ঠিক আছে৷ এই ভুল প্রায় সকলেই করে৷ তুমিও সকলের মধ্যে একজন৷ তা তুমি কি আমার করা রান্না একটু চেখে দেখতে চাও?
আমার আহ্বানে অনেকটা লাজশরমে লাল হয়ে মেয়েটি হ্যাঁ বললো৷ রান্না করছিলাম গরুর মাংস৷ বেশ আদা রসুন আর মশলাপাতি দিয়ে ঠেসে কষাচ্ছিলাম৷ কষানো মাংসের কয়েক টুকরো একটা ছোট্ট বাটিতে তুলে দিয়ে বললাম
: চেখে দেখো৷
মেয়েটি খেতে খেতেই সার্টিফিকেট দিয়ে দিল৷ এ প্লাস৷ সঙ্গে ঝালে লেটার মার্ক৷
আমি জানালাম, আমরা এমনই খাই৷
খেতে খেতে নিজের নাম বললো মেয়েটি৷ রাশিয়া থেকে এসেছে৷ পড়ালেখা করছে৷
আমাদের এই ডর্মিটরিটা আজব৷ নানা পেশার মানুষ থাকে৷ বদ্ধ এক উন্মাদও থাকে৷ যে সারাক্ষণ বই পড়ে৷ আর অবসরে করে গালাগালি৷ আমরা লোকটিকে যতটা পারি এড়িয়ে চলি৷ কখন যে গালি দিয়ে বসে!
তাতায়ানা চেয়ারে বসে খেতে খেতে বললো
: আচ্ছা তোমাদের দেশেও কি তোমরা নিজেরাই রান্না করো? মানে ছেলেরা?
: না করিনা৷ ছোট সময় মায়ের হোটেলে, বিয়ের আগে কিছুটা নিজের হোটেলে, কিছুটা বুয়ার হোটেলে৷ আর বিয়ের পর স্ত্রীর হোটেলে৷
: তাহলে তোমরা সকলে হোটেল ব্যবসা করো৷ তাই তো বলি লন্ডনে এত ভালো কারি কি করে রান্না করে বাংলাদেশের মানুষ!
আমি তো এই মেয়ের কথা শুনে অবাক৷ বললাম কি, আর বুঝলো কি!
ওকে বুঝিয়ে বললাম৷ শুনে মেয়েটিতো হেসেই কুটিকুটি৷
সেবার জানলাম ওর প্রেমিকের কথা৷ ছেলেটি বেশ ভালো৷ ওকে খুব ভালোবাসে৷ ওকে পাস্তা রান্না করে খাওয়ায়৷ জিজ্ঞাস করলাম, তার প্রেমিক ইতালির কিনা? প্রশ্নের উত্তরে বললো তুমি একটা বুদ্ধু৷ ইতালি হলেই পাস্তা খাবে, আর কেউ খাবে না!
ছেলেটি জর্জিয়ার৷
ওই পর্যন্তই এগুলো৷ নিজে খাবারের বাসনটি ধুয়ে দিয়ে গেলো৷ আর যাবার আগে সোনালি চুলের তাতায়ানাকে দেখলাম.. মুখ লাল, যেন একটু টোকা লাগলেই রক্ত টুপ করে নিচে পড়বে৷ (আমি টোকা দিইনি)৷
এরপর সপ্তাহে দুই একবার কড়িডোরে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে৷ হাই হ্যালো হয়েছে৷ মেয়েটির প্রেমিককেও দেখেছি৷ দুজনে হাতে হাত ধরে হয়তো কোন পথে ঘুরে বেড়াতে৷ এদেরকে আমার বেশ ভালো লেগেছে৷ হিংসে হয়নি যে, তা কিন্তু বলছি না৷
বেশ কয়েকটি ট্রেনিং, আন্তর্জাতিক ওয়ার্কশপ আর অ্যাসাইমেন্টে জার্মানির বাইরে থাকতে হয়েছে কয়েক মাস৷ আজ এখানে থাকো তো কাল সেখানে যাও- এমন অবস্থা৷ বনে থাকলে খুব ভোরে বের হও, আর ফিরো অনেক রাতে৷ অদ্ভুত একটা সময় গিয়েছে৷
তাতায়ানার দেখা পাইনি৷ বারবার ভেবেছি ওকে যদি একবার দেখতে পেতাম৷ কেন ভেবেছি জানি না৷ মেয়েটির মধ্যে একটা সারল্য দেখেছি৷ ওর প্রেমিক আছে তো কি হয়েছে, থোরাই কেয়ার৷ তবুও দেখা হয় না৷
এরও মাস খানিক পর এক উইকএন্ডের বিকালে আমি ফিরতেই দেখি কড়িডোরে এক ছেলের সঙ্গে বেশ রাগত গলায় কথা বলছে তাতায়ানা৷ আমি হ্যালো বলতেও সাহস করলাম না৷
এর কয়েকদিন পর তাতায়ানাকে আবার দেখলাম৷ এবার কথা হলো৷ অনেক কথা৷ আমি বললাম, চলো আজ খাবে৷ মেয়েটি রাজি হলো না৷ আমি পরে খাওয়াবো বললাম৷ মেয়েটি কিছু বললো না৷ সে তার প্রেমিকের কথা কিছু বললো না৷ তবে জানালো কয়েকদিন আগে কড়িডোরে দেখা ছেলেটি তাকে খুব জ্বালাচ্ছে৷ ছেলেটি স্পেনিশ৷ ওদের এক ক্লাশ উপরে পড়ে৷ চাইলে সে পুলিশকে জানাতে পারে৷ জানাতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়কে৷ কিন্তু ও এই সব করতে চায় না৷ হঠাৎ সে আমাকে জিজ্ঞাস করলো..
: অমি, তোমাদের দেশের মেয়েদেরও কি এভাবে ত্যক্ত করা হয়? আমি অকপটে বলে দিলাম৷ ও বললো, পুলিশ নেই৷ পুলিশকে বললে তো ঠেঙ্গাবে!
আমি বললাম, এসব আমাদের দেশে সাধারণত পুলিশের কাছে যেতে চায়না অনেকে৷ পুলিশকে বললে ঝামেলা আরও বেড়ে যায়৷ উল্টো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি৷
দীর্ঘশ্বাস ছাঁড়লো তাতায়ানা৷ বললো, স্পেনিশ ছেলেটির বিষয়ে তাকে কিছু একটা করতে হবে৷ আমি আর দাঁড়ালাম না৷ বুকের ভেতরের কথা, সেখানেই রয়ে গেলো৷ তাতায়ানাকে আর বলাও হলো না৷
**********************
নাইট ডিউটি ছিল৷ রাতে কাজ সেরে বাসার কাছে পৌঁছালাম ভোরে৷ শনিবার সকাল৷ এক সপ্তাহের নাইট শেষ৷ আহা....শান্তি৷ ডর্মিটরির সদর দরজার আগে কয়েক ধাপ সিঁড়ি৷ একটু দুর থেকে দেখালাম সেখানে লাল গোলাপ ফুল, সঙ্গে বড় বড় ডাটা৷ তাজা৷ কে রেখেছে রে ভাই! কাছে যেতেই দেখলাম প্রতিটি ফুলের সঙ্গে একটি কাগজ লেখা৷ তাতে লেখা তাতায়ানা, তাতায়ানা....৷ ইশ লিবে ডিশ৷ মানে আমি তোমাকে ভালোবাসি, জার্মানে৷ কেবল সিঁড়িতে হতো; এই ফুল বিছিয়ে দেয়া হয়েছে একেবারে লিফটের গোড়া অবধি৷ ফুলকে পাশ কাটিয়ে লিফটে চড়তেই দেখলাম সেখানেও একই গোলাপকান্ড৷ দারুণ! ঘরে গিয়ে বসতেই চিন্তা এলো আচ্ছা এর ছবি তুললে কেমন হয়? দারুণ হবে৷ যা ভাবা তাই কাজ৷ ক্যামেরা বের করে দ্রুত লিফটের কাছে৷ বোতাম চাপার পর কয়েক মিনিট৷ তারপর লিফটের দরজা খুলে যেতেই তাকিয়ে অবাক৷ কি হলো? ফুলগুলো নেই! নিচে নেমে এলাম৷ লিফট থেকে নামতেই সামনে তাতায়ানা৷ ফুল কুঁড়োচ্ছে৷ আঁটি বাঁধছে৷ আর আমাকে দেখে এক রহস্যময় হাসি মুখে এঁকে বললো
: ল্যুবটা যা করে না!
ল্যুব সেই স্পেনিশ ছেলেটির নাম৷’’
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১০ সকাল ১০:১৫