২০১৫ সালের নভেম্বর মাস। অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি বাংলাদেশ। একসময় অপার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা রাষ্ট্রটি আরো একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিগত তিন বছরএ একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রাজনৈতিক সহিংসতা, বাঙালি-আদিবাসী সংঘর্ষ, খন্ড খন্ড সিমান্ত যুদ্ধের ফলাফল এই ব্যর্থ বাংলাদেশ।
২০১২ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমান বনাম বৌদ্ধ রাখাইনদের সংঘর্ষ থেকে শুরু। বৌদ্ধ বনাম মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলে এবং তার জবাবে মায়ানমারে, শ্রীলঙ্কায়। অল্পকিছুদিনের মধ্যেই হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাও পায় নতুন মাত্রা। পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোড়দার হয়, শুরু হয় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ। মায়ানমার আর ভারত দুই দিক থেকেই হুমকি এবং চাপের সম্মুখিন হয় বাংলাদেশ। ভারতএর পেছনে আমেরিকা আর মায়ানমারএর পেছনে চীনএর মতো প্রধান দুই পরাশক্তির উপস্থিতিতে প্রবল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চাপ এবং হস্তক্ষেপএর মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ পরবর্তি দুই বছরে। ভারতএর আসাম এবং নাগাল্যান্ড এর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলা হঠাৎ করেই তৎপর হয়ে ওঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। প্রায় একি সময়ে মায়ানমারএর আরাকান রাজ্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামএর অংশ বিশেষ নিয়ে স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আবির্ভুত হয় এক নতুন রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার ভারত-মার্কিন উইংএর সাথে সমঝোতা করে মায়ানমার-চীনা উইংএর আগ্রাসন ঠেকাতে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ কঠোর ভাবে দমন করার চেষ্টা করে সরকার। ভারত-মার্কিন পরামর্শে বৌদ্ধ এবং আদিবাসীদের বিরুদ্ধে উগ্র ধর্মান্ধ ইসলামিস্ট রাজনৈতিক দল ও জঙ্গী সংগঠনগুলোকে সাময়িকভাবে ছাড় দেয় আওয়ামী সরকার। সামরিক সমর্থন ও নিরাপত্ত্বার বদলে বঙ্গপোসাগর ও পার্বত্য চট্টগ্রামএর জ্বালানী সম্পদের উপর মার্কিন নিয়ন্ত্রন মেনে নেয়া, টিফা চুক্তি বাস্তবায়ন, ভারতএর ট্রানজিটএর নিরাপত্ত্বা দিতে ভারতিয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমুতি দেয়া সহ নানান দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা হয় বাংলাদেশকে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরএর নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। আওয়ামী সরকার বিরোধী সকল রাজনৈতিক সংগঠন এবং ব্যক্তিকে এই সময় কঠোর ভাবে দমন করা হয়। বিএনপি প্রায় অকার্যকর রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় ২০১৪ সালে এসে। সরকার বিরোধী ইসলামিস্ট সংগঠনগুলো এই সময়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। বৃদ্ধি পায় জঙ্গি তৎপরতা। আলগা করা ফাস আবার জোড়দার করতে চায় সরকার। কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। ইসলামিস্ট সামরিক সংগঠনগুলো চলে গেছে নিয়ন্ত্রনএর বাইরে, এদের প্রতিনিধী হিসাবে নিজেদের দাবি করে নানান রকম রাজনৈতিক দরকষাকষি করতে থাকে হঠাৎ করেই ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সর্বোচ্চ মাত্রা পায় ২০১৫ সালের শুরুর দিকে। সারা দুনিয়ার টনক নড়ে, বসে জাতিসংঘে একের পর এক অধিবেশন। দাবি ওঠে আন্তর্জাতিক সামরিক হস্তক্ষেপএর। ভারতিয় এবং মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রবেশ করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্ত্বার খাতিরে, জঙ্গি দমনে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায়। সময়টা ২০১৫ সালের নভেম্বর মাস।
শোনা যাচ্ছে শান্তি চুক্তি হবে। বহুপক্ষিয় সমঝোতা চুক্তি হবে। সেই চেষ্টা চলছে। আমেরিকা ও চীনএর মধ্যে এখনো বঙ্গপোসাগর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামএর ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে সমঝোতা হয় চুড়ান্ত হয়নি। ভারতএরও নিজস্ব কিছু দাবি দাওয়া আছে। মায়ানমার রোহিঙ্গাদের জন্যে কোনরকম ছাড় দিতে এখনো রাজি হয়নি। শোনা যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামএ এক বা একাধিক বাফার রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে। বঙ্গপোসাগরএ স্থায়ী ভাবে ভারতিয় ও এবং মার্কিন সামরিক উপস্থিতি মেনে নিতে হতে পারে।
...................................................
উপরের ঘটনাটা কাল্পনিক। কিন্তু এই কাল্পনিক ঘটনাটাই পরিনত হতে পারে কঠোর বাস্তবে। কিভাবে? সেই সম্ভাবনা নিয়াই আলোচনা করবো।
বাংলাদেশ এখন ‘নিউ গ্রেট গেম’ বা ‘নয়া মহা খেলা’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ময়দান। খবরটা এই দেশের সিংহভাগ লোকের জানা নাই। কিন্তু বিগত এক যুগএর আন্তর্জাতিক রাজনীতির খবরাখবর যারা তাখেন তারা মোটামুটি এই সম্পর্কে ধারণা রাখেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির নয়া মহাখেলা পশ্চিমা দুনিয়ায় অনেক দিন ধরেই ওপেন সিক্রেট।
“যুক্তরাজ্য, পশ্চিম ইউরোপ এবং তোমরা মার্কিনিরা, আমরা আবার ‘গ্রেট গেম’ খেলতে ফেরত এসেছি। এবং এইবার আমরা জয়ের লক্ষ্যেই আছি”। -ব্রিটিশ প্রিন্স এন্ড্রু (উইকিলিক্সে ফাস হওয়া তারবার্তা থেকে)
The great game শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিক্সথ ব্যঙ্গল লাইট ক্যাভেলরি’র একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আর্থার কনোলি, উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে। শুরুর দিকে শব্দটা এসপিওনাজ জগতে ব্যবহার করা হতো। পরে ইউরোপিয় গণমাধ্যমেও শব্দটা ব্যাবহৃত হয়। এই গ্রেট গেমএর ইতিহাস শত বছরের ইতিহাস, এই ইতিহাসএর ধারাবাহিকতা এখন পর্যন্ত বর্তমান। ভারতিয় উপমহাদেশের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা বা টিকিয়ে রাখার খাতিরে মধ্য এশিয়া বিশেষ করে আফগানিস্তান নিয়া ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং রাশিয়া সাম্রাজ্যের মধ্যকার নানান ঠান্ডাযুদ্ধ, রাজনৈতিক কূট কৌশল এবং সম্মুখ সমরএর ময়দানে যেই নানামূখি দ্বন্দ সংঘাতের খেলা একশ বছরএরও বেশি সময় ধরে চলেছে তার নাম ‘মহা খেলা’। ১৮০১ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত এই মহাখেলায় ব্রিটেন এবং রাশিয়া ছারাও অংশগ্রহণ করে আরো বহু ইউরোপিয় শক্তি। নিজেদের মধ্যে নানামূখি দ্বন্দ সংঘাত থাকলেও উপনিবেশিত জনগণের শোষন এদের সবার প্রধান লক্ষ্য এবং এইক্ষেত্রে লাভ বেশি হলে যুদ্ধের বদলে পারস্পরিক ভাগ বাটোয়ারার নীতিতে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলা বরাবরি পারস্পরিক ঐক্য রক্ষা করে। মহাখেলা’র ইতিহাসও তাই।
তবে যেই গ্রেট গেমএর ময়দানে পরিণত হতে চলেছে বাংলাদেশ, তা কোন ইতিহাসএর বিষয় না, বরং বর্তমান বাস্তবতা। কবে থেকে শুরু হয়েছে এই নয়া মহা খেলা তা নির্ণয় করা কঠিন। আগের খেলার মূখ্য বস্তু ছিলো সিল্ক রুটএর উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা আর ভারতএর উপর নিয়ন্ত্রন রক্ষা করা। আমরা দেখেছি মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক গুরুত্ব গত শতাব্দির গোড়ার দিকে একটু একটু করে পরিবর্তন হয়ে গেছে, ঔপনিবেশিক শ্রেণীর আরাধ্য বস্তু হয়ে উঠেছে খনিজ তেল এবং অন্যান্য জ্বালানি সম্পদ। গত শতাব্দিতে মার্কিন বনাম সোভিয়েত মেরুকরণ এবং স্নায়ু যুদ্ধের সময়টাতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেহারা ছিল দ্বিপাক্ষিক। অর্থনৈতিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হয়ে না উঠতে পারলেও মধ্য এশিয়া এবং আফগানিস্তানএর জ্বালানি সম্পদ সবসময়ই সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রেখেছে। আফগানিস্তান ঘিরে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন প্রতিদ্বন্দীতা আর তাতে মার্কিনিদের জয় গত শতকের বিশ্ব রাজনীতির চেহারাই পরিবর্তন করে দিয়েছে।
মার্কিনিদের বিজয়, তাদের সহযোগিতায় তালিবান এবং আল কায়েদার জন্ম দ্বিতীয় মহাখেলার প্রস্তুতি পর্ব হিসাবে কাজ করেছে। কিন্তু এখন আমরা যেই মহাখেলার কথা বলছি তা মোটা দাগে শুরু হতে আরো প্রায় এক দশক সময় লেগেছে। ৯/১১এর সুবাদে আফগানিস্তান এবং তারই ধারাবাহিকতায় ইরাক আক্রমন। সেই থেকে পুরোদমে শুরু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো মিত্র এবং জ্বালানি ব্যাবসার ভাগিদার রাষ্ট্রগুলোর সামরিক বাহিনী বিগত এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করেছে। রাশিয়া এখনো মধ্য এশিয়ার নিয়ন্ত্রনে থাকলেও আফগানিস্তানে মার্কিন নিয়ন্ত্রন তাদের জন্যে হুমকিস্বরূপ। আরো বেশি জ্বালানি সম্পদএর উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কৌশলী ভুমিকা পালন করছে তারা দীর্ঘদিন ধরে। মার্কিন, রাশিয়া, ব্রিটেন প্রভৃতি রাষ্ট্রের মধ্যকার নানারকম কূটনৈতিক এবং সামরিক দ্বন্দ এবং সমঝোতার যে নতুন ইতিহাস তৈরি হচ্ছে তাকেই এখন বলা হচ্ছে ‘নয়া মহাখেলা’।
পাশ্চাত্য গণমাধ্যমে নয়া মহাখেলা একটি নিয়মিত আলোচিত বিষয়। উইকিলিক্স ক্যালেঙ্কারির পরে এই আলোচনা আরো বেরেছে। কিন্তু তার আগে থেকেই এটা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিকদের উক্তি এবং মধ্যপ্রাচ্য ও তৃতীয় বিশ্বের সাথে তাদের বিভিন্ন চুক্তি, দরকষাকষি ও মাতবরির ঘটনাগুলো খুটিয়ে বিশ্লেষন করলেই এই মহাখেলার বর্তমান চেহারা পাওয়া যায়। এই খেলার মূখ্য বস্তু মধ্য এশিয়ার তেল, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানির খনি, আন্তর্জাতিক পাইপলাইন, জ্বালানি বানিজ্য পথ ইত্যাদি।
খেলার প্রতিপক্ষ একদিকে মূলত মার্কিন নেতৃত্বাধিন ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো এবং তাদের বিপরীতে রাশিয়া এবং চীন। চীন এই মহাখেলায় অপেক্ষাকৃত নতুন প্রতিপক্ষ। কিন্তু অল্প সময়েই জ্বালানি ব্যাবসার ক্ষেত্রেও মার্কিনীদের জন্যে শক্তিশালী হুমকিতে পরিণত হয়েছে চীন। আর চীনএর আবির্ভাবেই নয়া মহাখেলা এখন আর মধ্য এশিয়ায় আবধ্য নাই। তার ময়দান বিস্তৃত হয়েছে। চীনএর আবির্ভাব আর জ্বালানি সম্পদএর উপর মার্কিন নেতৃত্বাধিন ন্যাটো রাষ্ট্রগুলো এবং রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দী মনোভাবের কারনেই মহাখেলার ময়দান মধ্য এশিয়ার মানচিত্র পেরিয়ে বিস্তার লাভ করেছে দক্ষিন এশিয়ায়। ঠিক কি কি কারনে এবং ঠিক কিভাবে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বর্তমান বিশ্বের সুপার পাওয়ারদের স্বার্থ ও ক্ষমতার লড়াইএর এই নয়া মহাখেলার গুরুত্বপূর্ণ ময়দানে সেই আলোচনা আমরা পরবর্তি পর্বে করবো।
কিছু সম্পূরক লিংকঃ
After Afghanistan, a New Great Game
China Enters the ‘Great Game’
The great game in the Indian Ocean
http://en.wikipedia.org/wiki/The_Great_Game
Click This Link