somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

...অসমাপ্ত দিনের গল্প।

১৭ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ৮:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
অফিস শেষের সময়টা তপুর খুব টেনশনে যায়। কারণ যত ঝামেলার কাজগুলো এই শেষ সময়ে এস ঘাড়ে চাপে। আজকে এরকম কোন ঘটনার জন্য বরাবরের মত দেরি করে বাড়ী ফিরলে সত্যিই খুব ঝামেলায় পড়তে হবে। আজকে একটা বিশেষ দিন। ...কথাটা মনে আসতেই তপুর টেনশনে শক্ত হয়ে আসা চেহারাটা বেশ কোমল হয়ে যায়।

...আহ তিন বছর!! সময়টা কেমন করে যেন খুব হুট করে চলে গেল। এখনও আভা'কে ঠিক বউ বউ মনে হয় না। বরং তিনবছর আগের জীবণের অর্ধেক রহস্যময়ী কোন তরুণীর ছাপটাই প্রবল। আধো রহস্যটুকু মনে হয় সারাজীবণই থাকবে। ...আকর্ষনের রসায়নের খুব জরুরী অনুঘটক হচ্ছে রহস্য।

এইসব আবজাব হাইথটের চিন্তা করতে করতে তপু আইডি-কার্ডটা বের করে এটেনডেন্স রেজিস্টারের স্ক্যানারে সামনে ধরতে যাচ্ছিল। পেছন থেকে অফিস এসিস্ট্যান্ট কবিরের ডাক শুনে হাত কেপে গেল। ঘুরে দাড়াতেই বুঝতে পারল বিপদ উপস্থিত। কারণ কবিরের হাতের ফাইল আর মুখের হাসিই বলে দিচ্ছে কলুর বলদের জন্য খোরাক উপস্থিত।
'তপু ভাই, ফাইলে দরকারি সব আছে। স্যার একটা প্রেজেন্টেশান দাড় করাতে বলেছে। কালকে সকালের মিটিংয়ের জন্য। খুব জরুরী...।'
আজকের জন্য মাফ চাই, জাতীয় কিছু বলার ইচ্ছে ছিল তপুর। কিন্তু সামনের মাসেই সেকশনাল হেডের রিপোর্টের উপর জুনিয়র লেভেল থেকে প্রমোশন আর ইনক্রিমেন্ট নির্ভর করছে ভেবে তেতো মুখে বাধ্য হয়ে ফাইলটা হাতে নিয়ে ডেস্কের দিকে এগুতে হল।

২.
'রাত দশটার সময় বাসস্ট্যান্ডে যারা দাড়ায় ...বুঝতে হবে তাদের সময় খারাপ যাচ্ছে, অথবা তারা কোন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প টাইপের অফিসে স্যাডিস্ট বসের আন্ডারে কাজ করে।' ...গুলশান ২ এর আধো অন্ধকারাচ্ছন্ন আর প্রায় ফাকা বাসস্টপে দাড়িয়ে প্রায় চিবিয়ে চিবিয়ে নিজের মনে কথাগুলো বলল তপু। অনেক আগেই ভাল বাসগুলোর লাস্ট ট্রিপ চলে গেছে। এখন ফিরতে হবে মুড়ির টিন মার্কা কোন বাসে সহযাত্রির ঘামের আর সস্তা সিগারেটের কটু ঘন্ধের সাথে আধপোড়া পেট্রোলের তীব্র গন্ধের সুবাস মেখে।

ইচ্ছে ছিল বিকালে অফিস থেকে বের হয়ে আভার জন্য আলাদা করে রাখা টাকা দিয়ে কিছু কিনতে। আভার পছন্দের জিনিস একটাই ...চকোলেট। কিন্তু সব গড়বড় হয়ে গেল। এখন ফিরতে হবে তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীর উপহার ..ফাকা হাত আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে।

৩.
বিকেল থেকেই আভা তাদের চিলেকোঠার ওপরের তিন কামরার ছোট্র বাসাটা যতটুকু সম্ভব সুন্দর করে সাজাবার চেষ্টা করছে। সাজাবার মত খুব বেশি কিছু হয়ত এই তিন বছরে তারা ঘরে আনতে পারেনি। কিন্তু যেটুকু আছে ...তার প্রতিটির সাথেই জড়িয়ে আছে অসম্ভব ভাল লাগার স্মৃতি। খুব বড় কিংবা দামী কিছু না হলেও প্রতিটা জিনিসের পেছনে একটা করে গল্প আছে। তাই গোছাতে গোছাতে আভা বার বার নস্টালজিক হয়ে পড়ছিল। গোছানো আর রান্না শেষ করে সাতটা সাড়ে সাতটা বাজতেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে তার অপেক্ষা শুরু হয়।
বিয়ের পরেই আভাও একটা চাকরি শুরু করেছিল। এনজিওর চাকরি... তাই বেশ ছোটাছুটি ছিল। কিন্তু নিজের মাঝে আরেক জনের উপস্থিতির কথা জানার কিছুদিন পরেই চাকরি ছেড়ে দেয়। এখন প্রায় প্রতিদিনই আভা তপুর জন্য অপেক্ষায় থাকে ...কিন্তু আজকের অপেক্ষাটা অন্যকম হওয়াই স্বাভাবিক। বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল ইউনিভার্সিটি জীবণের অপেক্ষার কথা। ...অপেক্ষার সময়টুকু সব সময় বিরক্তিকর হলেও প্রিয় মানুষের জন্য অনন্তকাল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করা যায়। যেমন এখন আভার খুব প্রিয় অপেক্ষা তার ছোট্ট রাজকণ্যার জন্য, আর সন্ধায় তপুর ঘরে ফেরার জন্য।

ভাবতে ভাবতে সামনে বিসিএসের ঢাউস বইটার উপর আভা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। ছাদের পানির ট্যাঙ্ক ভরে পানি উপচে পড়ার শব্দে চোখ খুলে যায়। ...ঘড়িতে এগারোটা পনের বাজে।
সম্ভবত মন খারাপ হওয়া দরকার ...কিন্তু তপুর উপর মনে হয় কোনদিনও সে রাগ করতে পারবে না। চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে আভা দরজা খুলে ছাদে বের হয়ে আসে।
চারপাশের আলোর জন্য ফিকে অন্ধকারেও আকাশটা কালো লাগছে। সম্ভবত মেঘের জন্য। পেটের উপর হাত রেখে আভা তার মেয়ের সাথে কথা বলে ওঠে ... 'আজকে আমরা দুজনেই তোমর বাবাকে একসাথে বকা দেব ...ঠিকাছে মা? ...আহারে বেচারাকে আজকে মনে হয় বৃষ্টিতে ভিজে ফিরতে হবে।' ...

৪.
মুমূর্ষ হয়ে যাওয়া গোলাপদুটো আর একটা গোলাপি হাওয়াই মিঠাইয়ের কাঠি ধরে বাসের মানুষের ভিড় বাচিয়ে তপু কোনমতে রড ধরে দাড়ায়। ভেতরের ভ্যাপসা গরমে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বাসের দোলনির সাথে সাথে পাশের মানুষর কপাল বেয়ে পড়া ঘামে তপুর শার্টের একপাশে ফোটা ফোটা ভেজা ভেজা দাগ পড়ে। তারপরও সে সব কিছু বাচিয়ে গোলাপদুটো সাবধানে রাখে।
...নেতিয়ে যাওয়া প্রায় শুকনো ফুল দুটোর দিকে তাকিয়ে মনটা খুব ছোট হয়ে আসে তপুর। বাসস্টপের পাশে প্লাস্টিকের বালতি হাতে পিচ্চিটার কাছে শুধু এইদুটো ফুলই অবশিষ্ট ছিল। আর চকোলেটের সব দোকান আটটার পরেই বন্ধ হয়ে গেছে।
...ষোলোকলা পূর্ণ করতেই বড় বড় ফোটায় বৃষ্টিও আরম্ভ হয়ে গেল।

৫.
মোহাম্মদপুরের রিং রোডে যখন তপু নামল তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। আর বৃষ্টির বেগ ঝির-ঝিরে। ভিজতে ভিজতে আদাবরের ভেতরের রাস্তা দিয়ে লঘুপায়ে এগোয় সে। আর মাত্র কিছুক্ষণ পরেই ৫ জুলাই শেষ। বৃষ্টির ভেতরে মানুষ সাধারণত দ্রুত চলতে চায়। কিন্তু তপুর ক্লান্ত পা যতটা না শারীরিক ক্লান্তিতে শ্লথ তারথেকেও বেশি আভার কথা ভেবে।

বাসার সামনে এসে তপু গোলাপ দুটোর দিকে তাকায় ...বৃষ্টির পানি পথে দেরি করিয়ে দিলেও গোলাপ দুটোতে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে। অবশ্য পলিথিনে মোড়ানো হাওয়াই মিঠাইয়ের কোন পরিবর্তন হয়নি।
গেটে ধাক্কা দিয়ে শব্দ করে বাড়ীওয়ালার কেয়ারটেকারের গেট খোলার অপেক্ষায় বাইরে দাড়িয়ে ভিজতে থাকে তপু। ঝাপসা চোখে উপরে তাকিয়ে তাদের চিলেকোঠার দিকে তাকায়। বৃষ্টি আর অন্ধকারের মাঝেও তাদের জানালার কাচ ভেদ করে আসা আলোটুকুর উষ্নতায় তপুর ভেতরের স্যাতসেতে ভাব কেটে যেতে থাকে।

৬.
আর এক মিনিট আছে ৫ জুলাই শেষ হয়ে ৬ তারিখ আরম্ভ হবার। মিস না করার আনন্দে আমি খুব আগ্রহের সাথে আমাদের বাসার দরজায় নক করে অপেক্ষায় আছি। ...দরজার দিকে এগিয়ে আসা আভার স্যান্ডেলের আওয়াজ পাচ্ছি...। এইসব অপেক্ষার নামইতো জীবণ।

মানুষ অনেক কিছু জমায়। কেউ তার স্মৃতি জমায়, কেউ পছন্দের জিনিস, বেশির ভাগই সম্পদ জমায়। ব্যাংকে টাকা বা সিন্দুকে মনি, মুক্তো...। আমাদের আপাতত ভালবাসা আর ভালবাসার মানুষগুলো ছাড়া আর কোন সম্পদ নেই। ...তাই চড়ুই পাখির বাসার মত এই চার দেয়ালের ভেতরে ...আমরা ভালবাসা জমাই।


...আমার খুব প্রিয় দুইজন মানুষের জীবণের আরম্ভটা এরকম ছিল। আমি শুধু অনুভূতিগুলো তাদের মুখে শুনেছিলাম। ...এখন পর্যন্ত আমার দেখা সেরা সুখি কাপল তারা :)। জমাবার মত সবকিছু ...প্রয়োজনের অনেক বেশি থাকার পরও তারা এখনও ভালবাসা জমায়। ...আর তাদের প্রথম রাজকণ্যা জন্মের সময়ই পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিল।

এই গল্পের শিরোনাম আমার নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না....
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ১১:১৮
৩০টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×