মাস খানেক সময় ধরে চলছে প্রস্তুতি। দোকানের গায়ে, রিকশার পেছনে, মোটা গাছগুলির গায়ে পোস্টার পড়েছে। দলবেঁধে ছেলেরা সকাল বিকেল বাজারের দোকানে চাঁদা তুলছে। ব্লক অফিসের বড়বাবু পঁচিশটাকা দিয়েছেন, ফাংশনের রাতে স্কুল ঘরে টেম্পরারি ইলেকট্রিক লাইন টানার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন চেনালোককে দিয়ে। পুরো অঞ্চলটাই সরগরম। এ এলাকার চাষাভুষো, দোকানী, এলপি স্কুলের মাস্টার, রিক্সাওয়ালা, প্রত্যেকেই বছরের এ সময়টার জন্যেই বসে থাকে। গান বাজনা, যাত্রার আসরকে কেন্দ্র করে হুলুস্থুল শুরু হয়ে যায় চারদিকে। বছরের আর বাকি দিনগুলো কেমন যেন মন্থর এ অঞ্চলটা। নির্জন না, নিঃস্তব্ধও নয়, তবু যেন ঝিমিয়ে থাকা। ঘন্টায় ঘন্টায় লাইন বাসের আনাগোনা, তার আনুষঙ্গিক চেঁচামেচি, বাজারের বেচাকেনার শোরগোল, সন্ধ্যায় দূরগ্রামের যাত্রীদের বাজার সেরে, কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সরব ব্যস্ততা- সমস্ত কিছু সত্ত্বেও তা ঝিমিয়ে থাকারই শামিল। সমস্ত ঘটনাগুলো এত বেশি প্রাত্যহিক যে উৎসবের মরশুম ছাড়া এ অঞ্চলটা আপাতদৃষ্টিতে প্রাণহীন ঠেকে। বছরে একবার চেহারা পাল্টে যায়। চাঞ্চল্যে মুখর হয় চারদিক। এবার আবার একটু বেশী। ছোকরার দল একমাস ধরে বড় গলায় বলে বেড়াচ্ছে, ’ইবার হুনাইমু তুমারতানরে এমন গান যেতা তুমরা হারি জীবনেও হুনছ না।’ এই নিরন্তর সগর্ব ঘোষণা স্বাভাবিক ভাবেই লোকের আগ্রহকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত করেছে। শহরের নামী দল। শুধু নাটক না। গানবাজনা সব কিছু একসাথে। তাও একেবারে নতুন ধরণের। এবার আর রাত জেগে তরোয়াল যুদ্ধ নয়।
অনুষ্ঠান সন্ধ্যে সাতটায় হলেও বিকেল থেকেই স্কুলের আশে পাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে একপাল খালি গা, হাফ প্যান্ট, ছেঁড়া লুঙ্গি গেঞ্জি বাচ্চারা। অতি আগ্রহ প্রায়ই তাদের উদ্যোক্তাদের ব্যস্ত প্রস্তুতির মাঝপথে ঠেলে দেয়। ধমক খায়। খানিকটা গুটিয়ে যায়। আবার ভিড় করে।
বাজারের কাছে এসে ডাইনে বাসটা মোড় নিতেই আকাশের কোণে জমে থাকা কালো মেঘে চোখ পড়ে সমীরের। আশঙ্কা হয় তার, সেদিকে চোখ পড়ার পর বাকি সকলের- বৃষ্টিতে ফাংশন না শেষ পর্যন্ত মাটি হয়। এই না-গ্রাম না-শহরে অনুষ্ঠান করার আগ্রহ তাদের অনেক দিনের। এতদূর এসে শেষপর্যন্ত বৃষ্টি বুঝি বৈরি হলো। পোষাক বদলের জন্যে গ্রীনরুম পাওয়া যাবে কি না এ নিয়ে উদ্বেগপূর্ণ আলোচনা বন্ধ করে মেয়েরা তাকিয়ে থাকে দূরে ধানক্ষেতের ওপারে বাঁশবনের মাথায় ঝুলে থাকা মেঘের দিকে। বৃষ্টি এলে কি আর করা যাবে। বৃষ্টি না এলে ফাংশনটা যাতে ভালোভাবে করা যায় তার জন্যে প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। এ কথা ভেবে দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য অরুণ সেন সমীরকে দুটো অসমীয়া গান গাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিলেন। ব্লক অফিসের কয়েকজন অসমীয়া স্টাফদের সপরিবারে ফাংশনে আসার কথা। চারদিকে যা চলছে দেশে, দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন। হঠাৎ চলন্ত বাসের ভেতর থেকে চোখে পড়ে স্কুলের সামনে জটলা। বড় ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা ’বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান,...’। সবাই নড়েচড়ে বসে। বাসটা দাঁড়ায় রাস্তার পাশে।
ফেস্টুন লাগানো বাসটাকে দাঁড়াতে দেখে দূর থেকে ছুটে আসতে থাকে মানুষ। বাসের চারদিক মুহূর্তে পরিণত হয় লোকারণ্যে। কম বয়সী, মাঝ বয়সী, বয়স্ক গেঁয়ো লোকগুলো হাঁ করে তাকিয়ে দেখে ছোটো, বড়, মেজ, সেজ হরেক সাইজের অজস্র কাঠের বাক্স, টিনের বাক্স, লোহার ডান্ডা, হারমোনিয়াম, তবলা, আর তার সঙ্গে শহুরে ছেলেমেয়েরা কেউ হাসতে হাসতে কেউ এ অঞ্চল সম্পর্কে কৌতুহলপূর্ণ আলোচনা করতে করতে একের পর এক নেমে আসছে বাস থেকে। বয়স্ক কর্মকর্তারা ঝটপট বন্দোবস্ত সমঝে নেন উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে। প্রচণ্ড চেঁচামেচি ও ব্যস্ততার মধ্যদিয়ে করিৎকর্মা উদ্যোক্তারা জিনিষপত্র নিয়ে যায় স্কুলে। হট্টগোলে হতভম্ব চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো ফ্যালফ্যাল করে এই দৃশ্য দ্যাখে, আর দেখে এটা বোঝে যে আজ ’গান’ জমবেই। মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় বাজারের দোকানে দোকানে, আজ ’গান’ দারুণ জমবে।
সময়মত আকাশ ঝেঁপে নামে বৃষ্টি। গ্রিনরুমে বসে থাকে সবাই মন খারাপ করে। ফাংশনটা বুঝি মাটি হলো। ঘন্টা খানেক পর বৃষ্টিটা একটু ধরতেই চারদিক থেকে পিলপিল করে আসতে থাকে মানুষ। ভাঙা ছেঁড়া ছাতা নিয়ে কোলে বাচ্চা মেয়ে বুড়ো ছোকরারা এসে স্কুল ঘর ভরিয়ে দেয়। বছরে একবার মোটে বসে গানের আসর, সামান্য বৃষ্টির জন্যে ঘরে বসে থাকলে তো বছরটাই মাটি। তা ছাড়া এবারের গান একদম নতুন ধরনের। তাদের কৌতুহল, তাদের বছরব্যাপী প্রতীক্ষার কাছে এই বৃষ্টি কিছুই না। বিস্ময় নেত্রে সবাই তাকিয়ে থাকে বেঞ্চজোড়া করে বানানো মঞ্চের দিকে। কখন পর্দা খুলবে, আর খুললেই তারা প্রবেশ করবে বিস্ময়ের দেশে। তিলধারনের জায়গা থাকে না স্কুল ঘরের ভেতর। উদ্যোক্তা আর আমন্ত্রিত, প্রত্যেকই হাঁফ ছাড়ে।
মঞ্চের পর্দা সরে। ধোপদুরস্ত পোশাকপরা ছেলেমেয়েরা নানা রকম বাদ্যযন্ত্র সহযোগে শুরু করে গান। একের পর এক গান চলতে থাকে। বিস্মিত, হতবাক হয়ে ঘোরের মধ্যদিয়ে কেটে যায় সময়। শূণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মঞ্চের দিকে মানুষগুলো। ধাক্কা খেয়ে ঘোর কাটে, টের পায় গানের কোনো হদিশই পায় না তারা। এ কেমন গান, যার ভাষা বোঝা যায় না। যার সুর ঢেউ তোলে না মনে। অজানা ভাষায়, অচেনা সুরে চলতে থাকে গান। নড়ে চড়ে বসে মানুষগুলো। ডাইনে বাঁয়ে তাকায় একে অন্যের দিকে। আস্তে আস্তে ঘর ভরে যায় চাপা গুঞ্জনে। পেছন দিকে সে গুঞ্জন চীৎকারের রূপ নেয়। তাদের পছন্দ হয় নি এই দুর্বোধ্য গান গুলো।
হারমোনিয়ামে পরের গানের প্রারম্ভিক সুরে আঙুল চালিয়ে থমকে দাঁড়ায় সমীর। লোকজন চেঁচাচ্ছে। তাদের মুখ আলোকজ্জ্বল করায় ব্যবহৃত মিরর স্পটের প্রচণ্ড আলোয় চোখে আঁধার দেখে সমীর। মঞ্চের ওদিকে দর্শক আসন সম্পূর্ন অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। মানুষগুলো চীৎকার করছে। কী ব্যাপার? কেন? ওরা তো খারাপ গাইছে না গানগুলো। তা ছাড়া, সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ বেদনা নিয়েই তো তাদের গান। সুদূর আমেরিকার জন হেনরি থেকে এ দেশের চাশনালার শ্রমিক, সবই তাদের গানের বিষয়। যেখানেই লোক বঞ্চিত হয়, আর্তের কান্না শোনা যায়- তারা চেষ্টা করে অত্যন্ত সৎ ভাবেই, গানে তার অনুরণন ঘটানোর। তাদের আদর্শ বিশ্বাসেও কোনো ফাঁকি নেই। যাই করে, মনে প্রাণে বিশ্বাস থেকেই করে। হৈ হট্টগোলে অবাক হয়ে কোনোমতে গান শেষ করে নেমে আসে মঞ্চ থেকে ওরা ।
পরবর্তী অনুষ্ঠান নাটক। অন্ধকার বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সমীর। বাইরে ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ে। নাটক তাড়াতাড়ি শুরু করার জন্য ভেতরে লোকজন গোলমাল করতে শুরু করার বেশ কিছুক্ষণ পর শুরু হয় নাটক। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা নাটক। এবারে লোকজন যেন আস্তে আস্তে শান্ত হয়। ঘুমহীন চোখগুলো মঞ্চের উপর আটকে যায়। বাইরে অন্ধকারে সমীরের ভেতরে তখন ঝড় বইছে। প্রত্যন্ত গাঁয়ের কোণে পড়ে থাকা ছেঁড়া খোঁড়া মানুষগুলোর মনের ব্যথা অভাবের কথা নিয়ে তারা গান গায়, যদিও তাদের বেশির ভাগ অনুষ্ঠান শহরকেন্দ্রিক। তবে লোকে তাদের ভালবাসে। গ্রামে তারা সবসময়ই যেতে চেয়েছিল, সুযোগ হয় নি। এবার সুযোগ আসতেই এককথায় রাজি হয়েছে। তারা এসেছে আন্তরিক ভাবেই, মানুষকে তারা সত্যিই ভালবাসে। কিন্তু তাদের আরাধ্য মানুষ, তাদের গ্রহণ করল না। এদিকে ভেতরে নাটক ক্রমেই জমে উঠছে। খল চরিত্রের মঞ্চে প্রবেশের সাথে সাথে দর্শকরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সমীর ভাবে, যত আন্তরিকই হোক তাদের গাওয়া, তাদের গানের পরিধি ওই শহর অবধি-ই। সেখানে তারা সম্রাট, মানুষ ভিড় করে তাদের গান শোনে, হাততালি দেয়। শহরে হাততালি জাগানো ওই গানগুলি এখানে, গ্রামে কোন সাড়া জাগায় না। এখানে তাদের গানের সুর দুর্বোধ্য, কথা জটিল- কোনও অনুরণন জাগায় না। এই এত কাছের অথচ এত দূরের পৃথিবীতে সমীরদের গানের জন্য মানুষের হৃদয়ে কোনও ঘর বাড়ি নেই। সমীর অন্ধকারে চেয়ে থাকে। মঞ্চে নাটক প্রায় শেষের পথে। লোকের হর্ষ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। খানিক থামার পর আবার বৃষ্টি আসে আকাশ ভেঙে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




