খুব সাবধানে ঘড়িটা নামালেন;পুরাতন একটা দেয়াল ঘড়ি।বেশ কিছুদিন হলো ঘড়িটা ঠিক মতো চলছে না।ঘড়িটা মুছে তাতে নতুন ব্যাটারি সেট করে আবার দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দিলেন।প্রথম যখন এই সংসারের এলেন তখন তার একমাত্র সম্বল ছিল একটা পিতলের বদনা।না ভুল হলো...পিতলের বদনার সাথে ছিল বোহেমিয়ান স্বামীর খামখেয়ালীপনা।এক এক করে জমি করেছেন,একটা ছোটো কারখানা করেছেন।মজার ব্যাপার হলো যখন কারখানাটা করলেন তখন এখানে চারজন ব্যবসায়ীর মধে উনি একমাত্র মহিলা।একা হাতে সংসার,ছেলেমেয়ে আর স্বামীর খামখেয়ালীপনা সামাল দিছেন অদ্ভুতভাবে।এক দৃষ্টিতে ঘড়টার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষন।
একে একে আপনজনের মৃত্যু দেখেছেন।এক কুরবানী ঈদে মারা গেলেন বড় দুলাভাই...শোক কাটিয়ে উঠবার আগেই পরের কুরবানী ঈদে মারা গেলেন তার স্বামী...এবং তারচে দুঃখজনক ব্যাপার হলো ঠিক পরের কুরবানী ঈদে মারা গেলেন তার স্নেহময়ী পিতা।সন্তান্দের মানুষ করেছেন তিলতিল করে।পড়ালেখা শিখিয়েছেন।একে একে সন্তানেরা উচ্চশিক্ষিত হয়ে সমাজের উচু স্থানে বসেছে কিন্তু তার জন্যে সেই ঘরিটাই সাথী হয়ে গেছে।
বড় ছেলেকে বিয়ে দিলেন...হঠাৎ ছেলের খেয়াল হলো মেয়ে তার উপযুক্ত না।কিন্তু অতিচালাক ছেলে চুপ করে থাকল...এবং এক সময় স্কলারশিপ নিয়ে জাপান চলে গেল কাউকে কিছু না বলে।মাথার উপরে আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।ছেলের শ্বশুর বাড়ির লোকজন বারবার এসে নানান কথা বলে।বেকার ছেলের সাথে কেন বিয়ে দিলাম,ছেলে কি বেঁচে আছে নাকি...একবার খোঁজ পেলে ছেলেকে কেটে টুকরা টুকরা করে নদিতে ভাসায় দিব ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবেই একদিন ছেলের খোঁজ পাওয়া গেল।ভাল আছে সে।কেউ যেন তাকে না জ্বালায়।মেয়েপক্ষ একদিন না পেরে নিজেরাই তালাক দিয়ে দিল।সাত বছর পর ছেলে ফিরে আসে...মা এর সাথে দেখা হবার আধা ঘন্টার মধ্যে বলে তার মা হলো মাছের মা...তার জিবনের সব ঘটনার জন্য তার মা দায়ী।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে।বড় ছেলের সম্পত্তি লাগবে...খুব চাপ দেয়।তারপরও ছেলেকে বিয়ে দেন নিজের সব কিছু বেচে।এদিকে ছোটগুলো এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি...উনি বলেন তুই সব দেখাশোনা কর।ছেলে সব ক্ষমতা পেয়ে মা এর হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে বলে এইটাই এ মাসের খরচ...পারলে চলেন না পারলে না।অবাক হবার আর কত বাকি তা ভাবেন আবার।ছেলে পারলনা দেখে রাখতে...পরের বউ এর বুদ্ধিতে মা এর বিরুদ্ধে মামলা করে দিলো...তার ভাগ তাকে দিতে হবে...।মাঝেমাঝে ফোন করে গালাগালিও করে...উনি শুধু ঘরিটার দিকে তাকায় থাকেন।
একে একে সব সন্তান বড় হয়ে যায়।মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়।মাঝেমাঝে তারা আসে।যতটুকু পারে খোজ নেয়।আসলে এতটুকু খোঁজ ও কিন্তু কম না।তারপর সবাই আবার নিজ নিজ জায়গায় ফিরে যায়।কখনও ছেলেদের কল এর পর কল দেন একটু খোঁজ নেওয়ার জন্যে।কখনও সেটা রিসিভ হয় কখনও না...কখনও ফিরে আসে।কখনও শুধু টাকা,পোষাক বা কিছু পাঠিয়ে দিয়েই দায়ীত্ব পালন করা।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ঘড়িটার দিকে..."রাত থেকে দিন...আধার থেকে ভোর...গ্রীষ্ম থেকে বরষা...একা থেকে কখনও আরও একা...কান্না থেকে হাসি...ব্যাথা থেকে তীব্র ব্যথা...রাত ১২ টা থেকে আবার ১২ টা।
***এই ঘটনাটা একটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা।বাস্তবতার প্রয়োজনে আসল ব্যাক্তিকে এখানে আড়াল করা হয়েছে।আমরা আমাদের বাবা মাকে আসলে কতটুকু সময় দেই?তা কতটুকু তাদের জন্যে আসল ভাললাগা বয়ে আনে?একটু ভেবে দেখি***
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৮:০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




